ছাদেকুল ইসলাম রুবেল, গাইবান্ধা : পলাশবাড়ীতে সরকারের দেয়া কৃষকদের জন্য কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির বিভিন্ন ফসলের উন্নতমানের বীজ ও সার লুটপাটের অভিযোগ করেছেন তালিকাভুক্ত কৃষকেরা।

অভিযোগ রয়েছে, পলাশবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট উপ-সহকারী কৃষি অফিসার (এস.এ.এ ও) মিলে সরকারের এই কৃষি উপকরণ উন্নতমানের বীজ ও সার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। এছাড়া কৃষি অফিসার আজিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে কৃষি যন্ত্রপাতির ভর্তুকীর টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।

ফলে একদিকে যেমন প্রকৃত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা সরকারের এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, অন্যদিকে সরকারের উদ্দেশ্য ও সফলতা হুমকির মুখে পড়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর গাইবান্ধার উপ-পরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে রবি ও পরবর্তী খরিপ-মৌসুমে গাইবান্ধার সাত উপজেলায় প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় দুই কোটি ৪০ লাখ ৯৬ হাজার ৭৫২ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। এই টাকায় উপজেলা ভিত্তিক ফসলের বিভাজন বিবেচনা করে মোট ১৮ হাজার ২৩০ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে এই প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় তালিকাভুক্ত করা হয়।

এর মধ্যে সদর উপজেলায় এই সুবিধাভোগী কৃষকের সংখ্যা এক হাজার ৮০০ জন। পলাশবাড়ীতে একহাজার ১৫০ জন, সাদুল্লাপুরে এক হাজার ৮৫০ জন, গোবিন্দগঞ্জে চার হাজার ৭০০ জন, সুন্দরগঞ্জে দুই হাজার ৪৮০ জন, সাঘাটায় দুই হাজার ১০ জন ও ফুলছড়ি উপজেলায় চার হাজার ২৪০ জন।

বাস্তবায়ন নীতিমালা অনুযায়ী, একজন কৃষক ১বিঘা জমির জন্য বিশ কেজি করে গম বীজ অথবা পাঁচ কেজি করে ধান বীজ অথবা দুই কেজি করে ভুট্টা বীজ অথবা এক কেজি করে সরিষা বীজ অথবা এক কেজি করে তিল বীজ অথবা দশ কেজি করে চীনা বাদাম বীজ অথবা পাঁচ কেজি করে মুগ বীজ অথবা আট কেজি করে খেসারি বীজ অথবা পাঁচ কেজি করে মাসকলাই বীজ অথবা সাত কেজি করে ফেলন বীজ অথবা বিশ গ্রাম করে বিটি বেগুনের বীজ পাবেন।

এতে বলা হয়েছে, এই কর্মসূচির সকল উপকরণ উপজেলা সদর থেকে বিতরণ করতে হবে। সকল উপকরণ কৃষক নিজে গ্রহণ করবেন। কোনো অবস্থাতেই প্রকৃত তালিকাভুক্ত কৃষক ছাড়া অন্য কাউকে উপকরণ প্রদান করা যাবেনা বা একজনের উপকরণ অন্যজনকে প্রদান করা যাবেনা।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকের উপকরণ সহায়তা তালিকায় কৃষকের মোবাইল নাম্বার সংযুক্ত করতে হবে এবং ওই কৃষক কোন ওয়ার্ডের বাসিন্দা সেটিও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোনা কোনো ইউনিয়নের কৃষি উপকরণ প্রাপ্তি তালিকাতে একজন কৃষকের মোবাইল নাম্বারও নেই। আর অধিকাংশ ইউনিয়নে যাদের নামের পাশে যে মোবাইল নম্বরটি দেওয়া হয়েছে সেটিও ভুয়া। আবার একই নম্বর একাধিক কৃষকের নামের পাশে লেখা হয়েছে।

সরেজমিনে পলাশবাড়ী উপজেলার পবনাপুর ইউনিয়নের বালাবামুনিয়া গ্রামের কৃষক এমদাদুল প্রধানের নাম কৃষি প্রণোদনা প্রাপ্তি তালিকায় ৬৮ নম্বরে থাকলেও তিনি সরকারের এই সহায়তা পাননি।
তিনি অভিযোগ করেন, শুনেছি সরকার সার-বীজ দেবে। সেই তালিকায় আমার নাম থাকার পরেও সরকারের এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। একই তালিকার ১৫ ক্রমিক নাম্বার কৃষানী রুপালী বেগমের স্বামী কৃষক রুহুল আমিন বলেন, উপকরণ প্রাপ্তি তালিকায় তার নাম থাকলেও তিনি কোনো কৃষি উপকরণ পাননি। একই অভিযোগ করেন, একই তালিকার ৬৯ ক্রমিক নাম্বার কৃষক আবু তাহের ও ৪ নম্বর ক্রমিকের কৃষক কানু শেখ।

মনোহরপুর ইউনিয়নের তালুক ঘোড়াবান্দা গ্রামের কৃষি উপকরণ সহায়তা প্রাপ্তি তালিকার ৮ নাম্বার কৃষক মোশারফ হোসেন অভিযোগ করে বলেন, তালিকায় নাম থাকলে কি হবে, আমি কোনো সার ও বীজ পাইনি। একই অভিযোগ করেন তালিকার ১০ নাম্বার কৃষক রোস্তম আলী ও ১২ নাম্বার কৃষক বাদশা মিয়া।

হরিনাথপুর ইউনিয়নের হরিনাথপুর গ্রামের কৃষক ফারুক মিয়া (তালিকাভুক্তি নম্বর ২০) অভিযোগ করেন, শুধু শুনি প্রতিবছর তালিকায় আমার নাম থাকে। কিন্তু আমি কৃষি উপকরণ পাই না। আমার নামের উপকরণ কে তোলে তাও জানি না। একই অভিযোগ করেন ওই ইউনিয়নের অনেকেই। পলাশবাড়ী উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের সব ইউনিয়নেই অনুসন্ধানে একই চিত্র দেখা গেছে।

গাইবান্ধা জেলা কৃষি পণ্য উৎপাদক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী আব্দুল খালেক বলেন, গাইবান্ধা কৃষি বিভাগ সরকারের নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জেলার কৃষি খাতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফলে প্রকৃত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক সরকারের এই সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, মাঠ পর্যায়ে এসএএও রা যদি সঠিক ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন তাহলেই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাবেন।

উপজেলা কৃষি বিভাগের একটি বিশ্বস্ত সুত্র জানায়, কৃষি অফিসার আজিজুল ইসলাম এখানে যোগদানের পর থেকেই তিনি নানা অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কৃষি প্রণোদনা ছাড়াও কৃষি যন্ত্রপাতি ভুয়া কৃষকের নামে বিতরণ দেখিয়ে সরকারের ভুর্তকীর টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন।

সূত্রটি আরো জানায়, প্রতিটি ব্লকে একজন করে উপ-সহকারী কৃষি অফিসার দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও তারা নিয়মিত কর্ম এলাকায় যান না। অনেকেই আবার জেলার বাইরে অবস্থান করেও মাস শেষে এসে বেতন ভাতা উত্তোলন করেন। উপজেলা কৃষি অফিসারকে ম্যানেজ করেই তারা এভাবে চলেছেন।

তবে উপজেলার বিভিন্ন ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানরা জানান, এসএএওদের কর্ম এলাকায় খুব কম দেখা যায়। ফলে কৃষকরা সময় মতো তাদের পরামর্শ না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

পলাশবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তালিকাভুক্ত কৃষকরা সরকারের কৃষি উপকরণ সহায়তা না পাওয়াটা খুবই দুঃখজনক। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পত্র পাঠানো হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের গাইবান্ধার উপ-পরিচালক ও জেলা কৃষি পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব এসএম ফেরদৌস বলেন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের উপকরণ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। সেক্ষেত্রে যদি প্রকৃত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা সরকারের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টিও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক ও জেলা কৃষি পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো অভিযোগ বরদাস্ত করা হবে না। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(এস/এসপি/মে ২০, ২০১৯)