নীলফামারী প্রতিনিধি : বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ইটভাটা মালিকরা।কোন কিছুতেই থামানো যাচ্ছেনা তাদের দৌড়াত্ম। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জড়িমানা আদায় করেও নিয়ন্ত্রনে আসছেনা ইটভাটাগুলি। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যে যার মতো করে ইটভাটা দিয়ে অদৃশ্য শক্তির বলে পার পেয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। কোন কোন ভাটা মালিক আদালতের আদেশ বলে, কেউবা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই, কারোবা কোন কাগজপত্রই নেই, নেই রেজিষ্ট্রেশন। তবুও বহাল তবিয়তে চলছে ইটভাটা।

রাতের রাধারে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ, বাঁশের মুড়া, ভাঙ্গা বোতাম, স-মিল থেকে আনা কাঠের গুড়া, পুরনো টায়ার-টিউব, ইউরিয়া সার, সোয়াবিন তেলের বর্জসহ নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে ভাটার জ্বালানী কাজে। নিয়মনীতি উপেক্ষা করে অপরিকল্পিত ভাবে জেলার যত্রতত্র গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলি চোখের পলকে গিলে খাচ্ছে সোনা ফলা আবাদী জমি। জমির টপছয়েল কেটে ইটভাটিতে ব্যবহার কারায় উর্বরতা হারিয়ে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে হাজার হাজার একর জমির। এখানে ওখানে অভিযোগ করেও লাভ হচ্ছেনা। ইটভাটা মালিকদের হাত এতটাই লম্বা যে তাদের নাগাল পাওয়া যেন দুঃসাধ্য।

এছাড়া প্রতিদিন শত শত অবৈধ ট্রলি ও ট্রাক্টরে অতিরিক্ত ইট ও মাটি পরিবহনের ফলে ভেঙ্গে চৌচির হচ্ছে এলাকার কাচা পাকা রাস্তা ঘাট। কিন্তু দেখার বা বলার যেন কেউ নেই। কুন্ডলী পাকানো কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত কালো ধোয়া পরিবেশের মারাত্মক হুমকি হয়ে দাড়িযেছে। ইটভাটার ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম জনপদ। এতে করে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পরিবেশ। বিনষ্ট হচ্ছে জমির ফসল। ধানে পড়েছে চিটা।এলাকার সবুজগাছগুলি পাতা পুড়ে যাচ্ছে বিষাক্ত ছাইয়ের কবলে পড়ে। ভাটার আশেপাশে বসবাসকারী পরিবারগুলির অবস্থা আরো করুন। নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে উর্বর ও ৩ ফসলী জমির উপর গড়ে উঠেছে ইট ভাটা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোটা জেলায় ৫৫টি ইট ভাটা রযেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক ভাটা রয়েছে সৈয়দপুর উপজেলায় ৩২টি। নীলফামারী জেলা সদরে রয়েছে ১১টি। ডোমার উপজেলায় ৪টি, জলঢাকা উপজেলায় ৭টি এবং কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ৩টি। যার বেশির ভাগই অপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত হওয়ায় এলাকার পরিবেশ, রাস্তা ঘাট ফসলী জমি ও ফসল বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নীলফামারী সদর উপজেলার গোড়গ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেয়াজুল ইসলাম জানান, তার ইউনিয়নে ৬টি ভাটা রয়েছে। ভাটার কারনে এলাকার পরিবেশেই শুধু নয় নীলফামারী-দেবীগঞ্জ সড়কের বেহাল দশা। গোটা সড়ক ফেটে চৌঁচির হয়ে গেছে। এছাড়া পিকনিক স্পট নীলসাগর কাছে মেসার্স এমএসবি ব্রিকসসহ আধা কিলোমিটারের মধ্যে এমকে ব্রিকস ও আরএমবি ব্রিকস নামে আরো ২টি, গোড়গ্রাম স্কুল এন্ড কলেজ ও গোড়গ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে বিওবি ব্রিকস নামের একটি, এছাড়া আধা কিলোমিটারেরও কম দূরুত্বে উত্তর মাছপাড়া গ্রামে টিএবি ব্রিকস-১ ও হাজীগঞ্জ বাজারের কাছে টিএবি নামে আরো একটি ভাটা রয়েছে (যদিও সরকারি তালিকায় এটির নাম নেই)।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভাটা গুলি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৭০ থেকে ৮০টি ট্রলি ও ট্রাক্টরে করে ইট ও মাটি পরিবহনের কারনে গোটা ইউনিয়নের অনেক গুরত্বপূর্ণ সড়ক ভেঙ্গে চৌঁচির হয়েগেছে। বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় চলাচলের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। স্কুলকলেজগামী শিক্ষার্থীরাও পড়েছে চরম বিপাকে। এদিকে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের এমকেবি ব্রিকস ও আরএমবি ব্রিকস ইটভাটার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগন জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করে এ থেকে পরিত্রান চেয়েছেন।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, সশ্লিষ্টদের মাসোহারা দিয়ে নাকের ডগায় ইটভাটাগুলি অনিয়মের রামরাজত্য কায়েম করেছে। অভিযোগ রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় বরাবরই পার পেয়ে যাচ্ছে ইটভাটাগুলি। অতি সম্প্রতি টিএবি, আরএমবি ব্রিকস ও বিওবি ব্রিকস নামের ৩টি ভাটায় মোবাইল কোর্টের মাধমে ৫০ হাজার টাকা করে জড়িমানা আদায় করা হয়েছে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিওবি ব্রিকস ভাটা মালিক দেয়াল দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ায় আসছে বর্ষায় শত শত বিঘা জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ভূমি মালিকরা। এদিকে জেলা প্রশাসককে অভিযোগ করায় এলাকাবাসীকে পুলিশ দিয়ে হুমকি দেয়ার অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। অথচ এতো কিছুর পরও হাত গুটিয়ে বসে আছে সংশ্লিষ্টরা।

ওদিকে সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের কৃষক এলাহী বকস, আবুল হোসেন, রফিকুল ইসলাম ও তোফাজ্জল হোসেনসহ অনেকেই স্থানীয় সাংবাদিকদের অভিযোগ করে জানান, কামারপুকুরের ইট ভাটা গুলো গড়ে ওঠেছে উর্বর আবাদী দো-ফসলী ও তিন-ফসলা জমিতে। ইট তৈরীর জন্য ভাটা মালিকরা নামমাত্র টাকা দিয়ে দুই তিন ফিট গভীর করে মুলতঃ জমির টপসয়েল কেটে নিয়ে যাচেছন।

কৃষকরা অভিযোগ করেন, কিছু কৃষক ইট ভাটায় জমি দেয়ার কারণে জমি গুলো ডোবায় পরিণত হয়েছে। এর ফলে পাশের উর্বর জমিগুলো ভেঙ্গে পড়ছে ওই ডোবায়। ফলে বাধ্য হচ্ছেন অন্য কৃষকরা ইট ভাটায় জমি দিতে। অনেকে মনে করেন, এটা একটা ইট ভাটা মালিকদের কৌশল।

(এস/এসপি/মে ২১, ২০১৯)