স্টাফ রিপার্টার : রাজধানীতে পানি সরবরাহে ওয়াসার চারটি উৎস (সোর্স) এবং ১০টি পছন্দসই এলাকাসহ মোট ৩৪টি নমুনা সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে এ প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।

ওয়াসার দূষিত পানি নিয়ে শুনানিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমান আদালতে তার মতামত তুলে ধরার পর মঙ্গলবার (২১ মে) হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন।

আদালতে আজ মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। রিটকারী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন তানভীর আহমেদ এবং আদালতের নির্দেশে গঠিত ওয়াসার পানি পরীক্ষা কমিটির সদস্য অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমান আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোতাহের হোসেন সাজু সাংবাদিকদের জানান, ঢাকা ওয়াসার ৪টি সোর্স পয়েন্ট, ১০টি জোন, ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১০টি র‌্যানডম এলাকার নমুনা সংগ্রহণ করে পানি পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটি বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইসিডিডিআর,বি-এর ল্যাবে ওয়াসার খরচে পানি পরীক্ষা করে আগামী ২ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১৬ মে) স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষে একটি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। প্রতিবেদনে ঢাকা ওয়াসার লিংকে গত তিন মাসে ময়লা পানির অভিযোগের তালিকা বিশ্লেষণ করে ১০টি জোনের ৫৯ এলাকায় ময়লা পানির প্রবণতা বেশি বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৪ মে কমিটির তৃতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইসিডিডিআর,বি-এর ল্যাবে পানির বিভিন্ন প্যারামিটারের মূল্যহার একীভূত করে মোট বাজেট সংযুক্ত করা হয়েছে।

বাজেটে বলা হয়, ওই ১০টি জোনের প্রত্যেক এলাকা থেকে ৩৫৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হবে। ফলে মোট নমুনার সংখ্যা দাঁড়াবে ১০৬৫টি। এই ১০৬৫টি নমুনা করে তিনটি ল্যাবরেটরিতে রোগ জীবাণু ও ভৌত রাসায়নিক-সংক্রান্ত পরীক্ষা করতে খরচ হবে মোট ৭৫ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা।

প্রতিবেদনের বিষয়ে মতামত শুনতে ওই কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের (মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্ট) চেয়ারম্যান ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমানকে আদালতে আসতে বলেন হাইকোর্ট। ওই আদেশ অনুসারে অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমান আজ (মঙ্গলবার) হাইকোর্টে আসেন।

আদালত বলেন, মূলত বেশি বাজেট সম্পর্কে জানতে আপনার (ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমান) মতামত জানতে চাচ্ছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্যে দূষিত পানি সরবরাহের বিষয়টি নিয়ে। কেন এটা সাপ্লাই হচ্ছে? এটা পরীক্ষার জন্য। এ এক্সামিনে এত লার্জ স্কেল কেন? স্যাম্পল কীভাবে নেওয়া হবে। মূলত পরীক্ষায় খরচ কীভাবে কমানো যায়। সে বিষয়ে জানতে আপনাকে আসতে বলেছি।

এ সময় অধ্যাপক সাবিতা বলেন, পানি দূষিত এমন ঢালাও অভিযোগের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বিগত দিনগুলোতে অর্থাৎ ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার সংযোগ ছিল ২ লাখ ৭২ হাজার ৮৪৪টি। যার বর্তমান সংখ্যা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ১৭৭টি। সুপেয় পানিতে কোনো রকম রং, গন্ধ বা অস্বচ্ছতা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। সুপেয় পানি সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এ সব লক্ষণাবলি থাকলে অভিযোগ কেন্দ্রে আনা পানির নমুনা চূড়ান্তভাবে অগ্রহণযোগ্য বিবেচনায় কর্তৃপক্ষের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

তিনি বলেন, যেসব পানিতে ময়লা দেখা যাচ্ছে বা ঘোলা সেটা তো পরীক্ষার দরকার নেই। সেটা রিজেক্টেড। যেটা সাধারণত স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ- এমন পরিষ্কার পানি পরীক্ষায় অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি, যা পান করে কোনো এলাকার রোগ ছড়াবার তথ্য মেলে। আমাদের মনে রাখতে হবে, অভিযোগ আছে এমন এলাকার পানি আমাদের সাতদিনের মধ্যে পরীক্ষা করতে হবে, পদক্ষেপ গ্রহণে দূষণের প্রকৃত চিত্র পাওয়ার জন্য।

ড. সাবিতা রিজওয়ানা আরও বলেন, ওয়াসা যে রিপোর্ট দিয়েছে ৫৯ এলাকা নিয়ে সেটা তো কয়েক মাস আগে। ওয়াসা পানির উৎস হলো- ভূমিস্থ, ভূগর্ভস্থ, শীতলক্ষ্যা বা বুড়িগঙ্গা। এসব উৎসের পানি সিজন টু সিজনে তারতম্য থাকতে পারে। ঢাকা ওয়াসার ১০টি জোনের ৩ লাখ ৬০ হাজার ৩৪৩টি আউটলেট আছে ধরে আমরা ইতোমধ্যে জানিয়েছি ৯৯ ভাগ আস্থা অর্জন করতে হলে ১৫ হাজার ৮৫৮ আউটলেট পরীক্ষার প্রয়োজন। অন্তত ৯৫ ভাগ আস্থা অর্জনে এক হাজার ৬৫ আউটলেট পরীক্ষা করা আবশ্যক।

এ সময় আদালত বলেন, টেস্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাবে না। জানার জন্য এত টকা খরচের দরকার নেই। উদ্দেশ্যে পানি দূষিত আছে কিনা?

জবাবে সাবিতা রিজওয়ানা বলেন, চারটি সোর্সে পানি আসে। তখন আদালত বলেন, চারটি সোর্স পিওর হলে, বিতরণের ১০টি জোন, পর্যায়ক্রমে ১০টি র‌্যানডম এবং ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করা যেতে পারে। মোট ৩৪টি। আপনাদের যতদিন সময় লাগে। প্রতি স্যাম্পলে কত টাকা লাগবে?

এ সময় অধ্যাপক সাবিতা বলেন, প্রতি স্যাম্পলে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হবে। সে ক্ষেত্রে মোট ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ হবে। এরপর আদালত আদেশ দেন।

আদেশের পর অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা বলেন, পানির প্রক্রিয়া হচ্ছে একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আজকে যে পানি সুপেয় দুদিন পরে কোনো রকম জটিলতার কারণে সে পানি সুপেয় নাও হতে পারে। সে কারণে এককালীন পরীক্ষা করে পানির বিষয়টি সমাধান করা যাবে না। পানি সুপেয় না হলে যেটা করণীর সেটার ওপর জোর দিতে হবে। পাইপলাইনে সংস্কার কিংবা পানির মানোন্নয়ন।

আদালত আদেশ দিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে পরীক্ষার জন্য যে চারটি এলাকা থেকে পানি আসে তার পানি স্যাম্পলিং করতে যে, পানির কী অবস্থা এবং যে ১০টি এলাকা থেকে পানি বিতরণ করা হয়, সে ১০টি জোন পয়েন্ট স্টাডি করতে। এখন যদি এখানে ভালো না পাওয়া যায় তাহলে ওয়াসাকে বলতে হবে তোমার এই পয়েন্টগুলোতে সমস্যা আছে। যদি এখানে আপেক্ষিকভাবে ভালো পাওয়া যায় তাহলে ১০টি রিস্ক ও ১০টি র্যানডম এলাকায় পরীক্ষা করতে হবে। মূলত ৩৪টি পরীক্ষা করতে হবে।

এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে গত বছরের ৬ নভেম্বর হাইকোর্ট ঢাকা ওয়াসার পানি পরীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানের নামা উল্লেখ করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করার আদেশ দেন। গত ১৮ এপ্রিল স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।

কমিটির সদস্যরা হলেন- ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মনিরুল আলম, বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম বদরুজ্জামান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সাবিতা রিজওয়ানা রহমান।

(ওএস/এসপি/মে ২১, ২০১৯)