প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

বখতিয়ারভাই যখনই ক্যাম্পাসে আসতেন আমার রুমেই সভা হতো। অনেক দিন থেকেছেনও। তবে সবসময় চর নিয়ে ঘুরতেন। দুর্দান্ত, দুর্ধর্ষ বাপ্পি সাহা ছিল তাঁর ডান হাত। তখনকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি পরিচালিত হতো উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের দুই প্রতাপশালী আওয়ামী লীগের শ্রমিকনেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী ও বিখ্যাত শিল্পপতি আখতারুজ্জামান বাবুর প্রভাবে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুভাগে বিভক্ত ছিল। বখতিয়ার ছিলেন আখতারুজ্জামান গ্রুপের তখন আখতারুজ্জামানের প্রচুর প্রভাব ছিল আওয়ামী লীগের ওপর মূলত মোটা অঙ্কের চাঁদা প্রদানের কারণে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি ছাত্রলীগের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও সব দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল আমার। বিশেষ করে কুমিল্লায় যাদেরকে আমি চিনতাম না, তাঁদের সঙ্গে ক্যাম্পাসেই পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়। যেমন কুমিল্লার প্রখ্যাত ছাত্রনেতা রুস্তম আলী মজুমদারের ছোটভাই তোফাজ্জলভাই, আফজাল, কালাম; সুপ্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রউফের শালা আলম; প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মুসাভাইয়ের ছোটভাই টিপু; বাশার, পার্থ, ফেরদৌস, কমল, আহাম্মদ আলী, রমিজ, কবি মমীম শাহাগীর প্রমুখের সঙ্গে। এছাড়া ছিল চৌদ্দগ্রাম থেকে আসা তাহের। এদের মধ্যে বাশার, টিপু ও শাহাগীর জাসদের শক্তিশালী কর্মী ছিল। বড়ভাইদের মধ্যে পেয়েছিলাম অল্প সময়ের জন্য খায়রুল আলম খসরুভাইকে, ডান পা হারানো শিমুলভাইকে, কাজমিভাইকে, পুটুভাইকে। এখনো খসরুভাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে। কুমিল্লায় ফিরলে কবি বিজন দাসের লন্ড্রিতে আড্ডা হয়। মনে পড়ে জিয়াভাই ছিলেন ইংলিশ বিভাগের একজন লেকচারার, দীর্ঘদেহী কিন্তু ছিপছিপে, চোখে ভারী চশমা পরতেন। একসঙ্গে ‘ভুইল্যা’ টেনেছি। এমনকি ছাত্রশিবিরের তুখোড় নেতা মোঃ জসিমউদ্দিন সরকার তিনি ছিলেন কুমিল্লা ধর্মসাগর পশ্চিম পাড়স্থ আমার প্রতিবেশী। খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। একবার আঞ্চলিকতার প্রশ্নে আমরাই তাঁকে চাকসুর ভিপি নির্বাচিত করেছিলাম। তিনি আবার মানিকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ও ছিলেন। জসিম ভাইয়ের ছোটভাই ছিলেন আবার মুজিববাদী সমর্থক অ্যাডভোকেট। কী বিচিত্র সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে মানুষের আর এটাই একটি সমাজের বৈচিত্র্য। এদের প্রায় সবাইকেই বাবা খুব ভালো করে চিনতো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার বছরকাল সময়ের মধ্যে সব মিলিয়ে দুই বছরও ছিলাম কিনা সন্দেহ আছে। কেননা অধিকাংশ সময়ই ছিল লাগাতার দীর্ঘ ছুটি। ছাত্র অসন্তোষ দমনের জন্য কর্তৃপক্ষের একমাত্র উপায় ছিল যখন-তখন ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়া। কিন্তু এর ফলে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে জাতির সে সম্পর্কে কারো কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এখনো কী আছে? এই চার বছর আমার জীবনের আরেকটি অধ্যায় যা এখানে লেখা সম্ভব নয়। কী করিনি, কী হয়নি এই সময় আমার জীবনে যে কারণে একটি মহাপরির্তনের প্রয়োজন অনুভব করেছিলাম অনার্স পাশ করার পর পরই। ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর যাদের পেয়েছিলাম ঘনিষ্ঠ সহপাঠি হিসেবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গোপাল সেনগুপ্ত এখন কানাডাপ্রবাসী, মেধাবী, ভদ্র ও শান্ত ছাত্র হিসেবে ক্যাম্পাসে সুনাম ছিল। সে ছাত্র ইউনিয়নের একনিষ্ঠ কর্মী ছিল অবশ্য। সবচেয়ে কনিষ্ঠ ছাত্রাবাস হোসেন শহীদ সোহরোয়ার্দি হলে থাকতো। দারুণ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তার সঙ্গে। মাঝেমাঝে যখন ক্লাস করতাম না তখন গোপাল না হয় মন্দিরা রায় নোট ধার দিয়ে সহযোগিতা করতো। গোপাল আমাদের বাসায়ও বেড়াতে এসেছিল। আমি বাবার অফিসে গেলে বাবা বলতো, ‘গোপাল কোথায়? ওকে নিয়ে এলে না কেন?’ গোপালকে খুব পছন্দ করতো বাবা। একবার সে আমাকে শহরে তাঁর প্রেমিকার বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। জানি না নিরাভরণ সেই লাজুক মেয়েটিকেই সে জীবনসঙ্গী করেছে কিনা। মাস্টার্স পাশ করার আগেই সে বিদেশী সাহায্যসংস্থা ‘সেভ দি চিলড্রেন ইউএসএ’র সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে দিল্লীতে ছিল এই সংস্থার বড় কর্মকর্তা হিসেবে জানতাম। আমি মাস্টার্স না করেই জাপানে চলে আসি। গোপাল ১৯৮৬ সালে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনে যোগদান করতে জাপানে এসেছিল। জাপানি বৃহৎ এনজিও সংস্থা শাপলা নীড় এর আয়োজক ছিল যতখানি মনে পড়ে। তখন দেখা হয়েছিল। ব্যস্ততার মধ্যেও তাকে টোকিওর নিকটবর্তী কানাগাওয়া-জেলা শহরে নিয়ে গেছি সেই সম্মেলনস্থলে। সময় করে নিয়ে আড্ডা দিয়েছি আমার জাপানি স্ত্রীসহ। তখন দারুণ একটি কথা বলেছিল, ‘হিন্দু, মুসলমান ছেড়ে শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধই বিয়ে করলি! গৌতম বুদ্ধের উপর লিখিত তোর ‘মহাপরিনির্বাণের কথা’ বেশ বড় প্রবন্ধটি পড়েই বুঝতে পেরেছিলাম, তুই দিকনিশানা পাল্টে ফেলছিস। জ্বলতে জ্বলতে তুই এখন বৌদ্ধবাদী শান্তি চাস। মনে পড়ে বড় অস্থির হয়ে পড়েছিলি থার্ড ইয়ারে উঠার পর। সর্বক্ষণ তোর পকেটে থাকতো ‘ভুইল্যা’র প্যাকেট।’ আমি হেসে বলেছিলাম,‘ হ্যাঁ তখন একটি সময় ছিল এরকম। মাথার উপর একাধিক স্তরবিশিষ্ট ভারী নিম্নচাপ ছিল। আমার রুমমেট আহাম্মদ আলী মিটন আর আমার সকালের নাস্তা শুরু হতো এই ‘ভুইল্যা’ টেনে। সাধারণ সিগারেটের মতোই খেতাম এক সময় এটা অবশ্য সয়েও গিয়েছিল।’ গোপাল বললো, ‘এত কড়া মারিজুয়ানা তোরা কীভাবে যে টানতি মাই গড!’ বললাম, ‘শরীর মহাশয় যা সয়াবেন তাই সয়। রাইজিং এইজে এনার্জি থাকে শরীরে প্রচুর সেটা অ্যাবর্জব করে নেয়। এটা ন্যাচারাল। বাহাদুরি বা মহত্বের কিছুই নেই। নেশা করতাম ভালো লাগতো বলে, ভালো লাগাটা না থাকলে কোনো মানুষই কিছু করতে পারে না। খারাপটাকেও ভালো লাগাতে হবে এটাই মানুষের ধর্ম।’ গোপাল মন্দিরার প্রসঙ্গ তুললো, ‘মন্দিরাও চলে গেল তোর আগে বিশ্বভারতীতে।’ ‘হ্যাঁ, আমি তো মন্দিরা কমপ্ল্যাক্সেও কিছুদিন ভুগেছিলাম। ও যদি শান্তিনিকেতন চলে না যেতো মনে হয় আমরা দুজনেই একসময় হেলে যেতাম। অথবা ভিন্ন কাউকে আবার ভালোলাগতো। তারুণ্য হচ্ছে বন্যঘোড়া তাকে পোষ মানানো বড় কঠিন! কিন্তু আশ্চর্য কী জানিস, মন্দিরার সঙ্গে শিখা নামে একটি মেয়ের চেহারার অদ্ভুত মিল ছিল! প্রথম যেদিন ওকে দেখি চমকে উঠেছিলাম! মন্দিরা শুদ্ধভাষায় কথা বলতো কিন্তু চাঁটগার একটা সুর লেগে থাকতো অথচ কী অসাধারণ গলা ছিল মন্দিরার রবীন্দ্রসঙ্গীতে!’ শুধু মন্দিরাই নয়, নীলিমা, মেহবুবা, মুক্তিযোদ্ধা জুবায়ের, ধনীর ছেলে লুৎফর, দুঃসাহসী সমীরণ বড়ুয়া, চান্দিনার শান্তশিষ্ট মফিজ ছিল ঘনিষ্ঠ সহপাঠী আমার। মেহবুবার বাবা ছিল কাস্টমস অফিসার। মাঝে মাঝে গাড়ি চড়ে আসতো। জিন্সপ্যান্ট ও শার্ট, টাইট সালোয়ার-কামিজপরা এরকম স্মার্ট মেয়ে খুব কমই ছিল ক্যাম্পাসে সেই সময়। অত্যন্ত বড় মনের ছিল মেয়েটি। কত দুষ্টুমি যে করেছি। আমার রুম পর্যন্ত একবার এসেছিল। ওর বুক ছিল বেশ বড় সেটা তার রমণীয় চেহারার আগে বেশি নজর কাড়তো ছেলেদের। অবশ্য সে বিষয়ে মোটেই ভ্রুপে করতো না সে। কতদিন বলেছি, ‘তোমার ওই দুটো আর কিছু ছোট করা যায় না?’ হেসে বলতো, ‘কেন? তুমি কি তোমার হাত ছোট করতে পারবে? তুমি কেবল আমার বুকটাই দেখলে ভিতরটা দেখলে না’, বলে অস্ফুট হেসে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাতো এমনভাবে যে, আমার মনে হতো, আমি যদি ইচ্ছে করি দেখতে, তাহলে সে খুলে দেখাতে চায়। কী রোম্যান্টিক সম্পর্কই না ছিল ওর সঙ্গে! মাঝে মাঝে নিদ্বির্ধায় হাত ধরে বলতো, ‘চলো অডিটরিয়ামের দিক থেকে ঘুরে আসি, ভাল্লাগছে না। একটু সবুজের ঘ্রাণ খাবো।’ নরম তুলতুলে উষ্ণ আঙুলের স্পর্শে ওই বয়সে শিহরণ যে জাগেনি তা নয়, কিন্তু কোনো উন্মাদনার উদ্রেক হতো না। একসঙ্গে কতদিন বাসে বা শার্টল ট্রেনে পাশাপাশি বসে হাসিঠাট্টা করতে করতে শহরে গিয়েছি। প্রেম বিষয়ক কোনো আলাপই কোনোদিন হয়নি। নাটক, চলচ্চিত্র, গান, সাহিত্য নিয়ে আলাপ হতো। চমৎকার নিষ্পাপ এক সম্পর্ক ছিল মেহবুবার সঙ্গে। পরে শুনেছি বিয়ের পর আমেরিকায় চলে গেছে।’ মানিকের বান্ধবীরাও ছিল খুবই রসিক। সুরাইয়া, জ্যোৎস্না ও রীতার কথা মনে পড়ে। রীতার প্রতি মানিকের বেশ দুর্বলতা ছিল। রীতারও কি ছিল? ঠিক জানি না। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়েছিল তার। মানিক অনেকদিন মনমরা হয়েছিল, ভুইল্যার ট্রিটমেন্ট বাড়িয়ে দিয়েছিল হয়তো ব্যর্থ মনস্কামের আগুনকে নেভানোর জন্য। রীতা যখন ক্যাম্পাসে ফিরে এলো হাতে তার তখনো মেহেদির আল্পনা। শরীরে বৌ বৌ গন্ধ। এক ফাঁকে মানিক সজল চোখে হেসে হেসে জিজ্ঞেস করে বসলো, ‘বিয়ে তো করলে, কেমন লাগছে?’ রীতাও খোলামেলা উত্তর দিয়ে দিল, ‘বিয়েটা যে আসলে মাত্র কয়েক মিনিটের অস্থায়ী একটি শিহরণ এটা জানা ছিল না! প্রথম রাতে সেটাই মনে হয়েছে, তারপর একই শিহরণের পুনরাবৃত্তি নতুনত্ব কিছুই নেই, কেবল বিরক্তি আর ক্লান্তি। বুঝলে কিছু?’ মানিক গোঁফ পাকাতে পাকাতে বললো, ‘কি জানি। সেই অভিজ্ঞতার দুয়ারেই তো যেতে পারলাম না এখনো......!’ পরে তারই ক্লাসমেট সুমুর ছোটবোনকে বিয়ে করেছিল আমি জাপানে চলে আসার পর। দুটো শিশুসন্তান রেখে অকস্মাৎ মারা যায় মানিক। বাবা দারুণ শোকাহত হয়েছিল তার এই মৃত্যুতে । একবার আমার স্ত্রীসহ দেশে ফেরার পর ওর বাসায় গিয়েছিলাম তখন ওর বৌসহ একসঙ্গে অনেক আনন্দ করেছিলাম আমরা। আমার জীবনের অনেক ঘটনার সাক্ষী আমার রুমমেট আহাম্মদ আলী মিটন। যখনই টাকার দরকার হতো দুজনে শহরে গিয়ে হাজির হতাম বাবার অফিসে না হয় পুলিশ ক্লাবে। জীর্ণশীর্ণ পড়ো পড়ো বহু পুরনো একটি দোতলা বাড়ির নিচের অন্ধকারপ্রায় একটি কক্ষে বাবা থাকতো। ওখান থেকে কোর্টবিল্ডিং খুব দূরে নয়। কিন্তু অনেক উপরে এক পাহাড়ে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে উঠতে হতো। নিজের চোখে তাই দেখে খুব খারাপ লেগেছিল। গভীর রেখাপাত করেছিল মনোজমিনে। এই কোর্টবিল্ডিংটি ছিল পর্তুগীজদের কুঠিবাড়ি বা প্রশাসনভবন। বাবা আহাম্মদ আলীকে খুব আদরযত্ন করতো। সিটনের বাবাও আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আহাম্মদ আলী হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি, মানিক, আহাম্মদ আলী এবং আফজাল ছিলাম একই বৃন্তের চারটি ফুল। ক্যাম্পাসে একসঙ্গেই থাকতাম। আফজাল ছিল লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্র। কিন্তু ছাত্রলীগের লিডার হওয়ার ফলে পড়ালেখার চেয়ে ব্যস্ত ছিল ছাত্রদের নানা রকম সমস্যা সমাধানের রাজনীতি নিয়ে। বিভা নামে একটি গোলগাল ফর্সা পুতুল-পুতুল সহপাঠিনীর প্রতি এতই দুর্বল ছিল যে, প্রতিদিন বিকেলবেলা বিভার হলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। এবং দুজনে কথা বলতো। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ডিগ্রি অনুষদের নামকরা অধ্যাপিকা জাহানারা বেগমের মেয়ে পিতৃহারা বিভা ছিল বরাবরই হাসিখুশি, চলনেবলনে আধুনিক, উদারমনস্ক। আফজাল ও বিভা দুজনেই আড্ডা দিয়েছে প্রচুর, শহরেও গিয়েছে বেড়াতে একসঙ্গে। কিন্তু তার মনের সমর্থন পায়নি আফজাল। বিভা রাজনীতি পছন্দ করতো না মনে হয় এটাই ছিল প্রধান কারণ, যদিওবা কোনোদিন প্রকাশ করেনি। বিভার সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব ছিল আমার। মাঝেমাঝে একসঙ্গে বাসে করে কুমিল্লা যাওয়া-আসা করেছি। পাশাপাশি বসে কত যে গল্প হয়েছে দুজনের। রেগে বলতো, ‘আমার সঙ্গে থাকা অবস্থায় ভুইল্যা টানতে পারবে না।’ আমি বলতাম, ‘তথাস্তু দেবী।’ মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে বলতো, ‘আফজালকে বুঝিয়ে বলো, যা হবার নয়, সেটার জন্য মন খারাপ করে লাভ নেই। তুমি বললে সে শুনবে।’ আফজাল আমার কথা শোনেনি কোনোদিন। বরং ভদ্রসজ্জন লিডার ছেলেটি এক সময় ভুইল্যাভক্ত হয়ে পড়েছিল প্রবলভাবে। সে থাকতো আলাওল হলেরই তিন তলাতে। মাঝেমাঝে একাই ভুইল্যা টেনে মাতাল হয়ে দেয়াল ধরে ধরে আমাদের রুমের সামনে এসে দাঁড়াতো। কাঁধে ঘি রঙের শাল না হয় খদ্দরের চাদর যা লিডার হিসেবে সে ব্যবহার করতো সারাবছরই---ঘন কালো গোঁফের ওপরে চোখে খুব পাওয়ারফুল চশমা, ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসতে থাকতো অনবরত। হাসতে হাসতে কুঁজো হয়ে যেতো। আবার উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকতো। আমরাও নিঃশব্দে তা উপভোগ করতাম। কেননা আমরাও তো টেনে বুঁদ হয়ে থাকতাম। হাসি যখন থামতো তখন ভিতরে এসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিত ক্লান্তির কারণে। অতিরিক্ত হাসিতে প্রচুর এনার্জি ব্যয় হয়। একবার এরকমই হাসতে হাসতে মরে যাবার দশা হয়েছিল আমাদের! সেবার আফজাল একইভাবে দরজার কাছে এসে নিঃশব্দে হাসতে লাগলো অনবরত। আমি ও মিটন মোটেই ভ্রুক্ষেপ করছিলাম না। একসময় নিজেই হাসি থামিয়ে ভিতরে এসে আবার হেসে হেসে বলতে লাগলো, ‘মামু, আমার অন্তরের দুঃখটা আজও তোমরা আমল দিলা না। আমি কার কাছে বিচার দেই কও?’ আহাম্মদ আলী নির্বিকার চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলের আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে দেখতে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, ‘নিজের জ্বালায় মরি না, তোমার দুঃখের কথা শুনে মনোজ্বালা বাড়াবো নাকি! জুতা হাতে নেয়ার আগে বিদেয় হ!’ ওর বলার ভঙ্গি দেখে আমার উঠলো হাসি! সেকি হাসি! তিন জনেই হাসতে লাগলাম। সেই হাসি শুনে আশেপাশের ছাত্ররা এসে হাজির। নিচতলার প্রক্টর রুমের কেরাণীও এসে হাজির হলো! ...চলবে

আলোকচিত্র : বামে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলে যখন থাকতাম, চেয়ারে হেলান দিয়ে দক্ষিণের খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসতাম। ডানে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর মাত্র কিছুদিনের পেয়েছিলাম কুমিল্লারই বড়ভাই খায়রুল আলম খসরু ভাইকে। অবশ্য এরপর কুমিল্লাতেই অনেক আড্ডা দিয়েছি।

লেখক : জাপানপ্রবাসী