মাহবুবা সুলতানা শিউলি


কক্সবাজারের উখিয়ার রত্নাপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়েছিলাম গত ২৪ মে শুক্রবার। এবারে গিয়েছিলাম, হোসাইন সায়েরা ফাউন্ডেশন ও তূর্কির দিয়ানাত ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য নির্মিত স্কুল ও নির্মানাধীন মসজিদ পরিদর্শনে। আলহামদুলিল্লাহ কাজ প্রায় শেষের পথে। শিক্ষা বঞ্চিত রোহিঙ্গা শিশুগুলো শিক্ষার আলো পাবে এবং মসজিদের সুন্দর মনোরম পরিবেশে ইসলাম শিক্ষা ও নিয়মিত পাঁচওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে পারবে এ উদ্দেশ্য নিয়ে এ পথ চলা।

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। গত দুইবছরে আমি বেশ কয়েকবার উখিয়ার বালুখালী, রত্নাপালং, কুতুপালং সহ বেশ ক'টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়েছিলাম মানবিক সহায়তার কাজে। তখনকার পরিস্থিতি এবং বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে। ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের শারিরীক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিক মূল্যবোধ কিছুটা উত্তরণ হয়েছে বলে মনে হয়েছে।

আর্থিক অবস্থা : সবচেয়ে বেশী যেটা লক্ষ্যনীয় তা হচ্ছে তারা আর্থিকভাবে বেশ সাবলম্বী হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রমতে জানতে পারলাম, এখন প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারে কমপক্ষে চার-পাঁচ লাখ টাকা জমানো আছে। এর বাইরে বিভিন্ন এনজিও, সংস্থাগুলো থেকে প্রায় প্রতিদিনই নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী থেকে শুরু করে সবকিছুই এমনকি রান্নার জন্য গ্যাসের চুলা, সিলিন্ডারও তারা পাচ্ছে।

রোহিঙ্গা যুবতী মেয়েরা ওখানে স্থাপিত গার্মেন্টস সহ অন্যান্য সেক্টরে কাজ করছে আর এর দ্বারা তারা আরো উপার্জন করতে পারছে। অবশ্য রোহিঙ্গা যুবকগুলো খুব একটা কাজ করছে কিনা ঠিক বলতে পারছি না কারণ সেরকম তথ্য নিতে পারিনি তাদের বিষয়ে, তবে কিছু যুুুবককে বসে বসে শুধু আড্ডা দিতেই দেখেছি।

শারীরিক ও মানসিক অবস্থা: শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ নির্মাণ করে গত দু’বছরে ওদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছে বিভিন সংস্থাগুলো। ওখানে প্রায় অনেক ঘর থেকে কোরআন তেলোওয়াতের মধুর ধ্বনিও শুনা গেছে।

ছোট শিশুদের জন্য অনেক উন্নতমানের বিনোদনের ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ভালো ভালো রাইড সহ শিশুপার্কের ন্যায় বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেখানে রোহিঙ্গা মাতা-পিতা তাদের শিশুদের নিয়ে সুন্দর সময় কাটাতে পারবে। এতে শিশুদের পাশাপাশি বড়দেরও শারীরিক মানসিক বিকাশ ঘটাতে পারবে। নির্যাতিত নিপীড়িত এ জনগোষ্ঠীর জন্য এ যেন স্বর্গের উদ্যান। যদিওবা তাদের শিশুদের জন্য বিশাল মাঠ দেওয়া সম্ভব নয় তবুও ওরা যা পাচ্ছে, আমাদের দেশের গরীব দুঃখী বাঙ্গালীরা ছিটে ফোঁটাও পাচ্ছে না বলে মনেহয়। সেটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ।

সামাজিক অবস্থা: সামাজিক ভাবে বলতে গেলে বা বর্ণনা করতে গেলে আমি যতটুকু তথ্য পেয়েছি তা আঁৎকে উঠার মত। এখানে গত দু’বছরে কত লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে তার সঠিক জরিপ করা গেলেও বুঝা যাবে না। আমি নিজ চোখে দেখলাম প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে ৬ মাস/এক-দেড় বছরের বাচ্চার ছড়াছড়ি। শুনলাম, কেউ কাউকে পছন্দ হলেই নামকাওয়াস্তে বিয়ে পড়িয়ে সংসার করে নিচ্ছে আর পেটে বাচ্চা আসা মাত্র ভালো না লাগলে আবার অন্য কারও সাথে সম্পর্ক। একজন পুরুষ চার-পাঁচটা মেয়েকে বিয়ে করছে। এটা নিয়ে কারও মাথাব্যথাও নেই। আঠার-ঊনিশ বছরের ছেলে থেকে শুরু করে পরিপূর্ণ যুবক সবাই বিবাহিত। আর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সন্তানের পিতামাতা। এ যেন অনিয়ন্ত্রিত একটি পরিবার পরিকল্পনার চরম অভাব। জীবন ধারণ ও সংসার কিংবা শিশু জন্মের বিষয়ে তাদের নূন্যতম জ্ঞান নেই। সবকিছু যেন গড গিফটেড নিয়মে পরিচালিত।

এভাবে যেতে থাকলে এ জনসংখ্যার বিষ্ফোরণ ঠেকানো কোন ভাবেই সম্ভব নয়। আর এ জনসংখ্যা হয়তো বসে বসে খাবার পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু এদের বসবাসের জায়গা বা বাসস্থানের ব্যবস্থা কে করবে? আগামী ৫ বছরে কোন পর্যায়ে যাচ্ছে এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও বিশ্ব মানবতা এবং জাতিসংঘ কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন? তাও স্পষ্ট কিনা জানিনা। তবে দ্রুত একটি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরী। কেননা গত কয়েক দিনে পত্রিকায় দেখেছি রোহিঙ্গা জনগোষ্টির কাছে ২৯টি বাংলাদেশী পাসর্পোট সহ গ্রেপ্তার নারীপুরুষ। এমনকি সাগর পথে মালেয়েশিয়া যেতে ৪৮ নারীপুরুষ আটক। অস্ত্রসহ ১৭টি রোহিঙ্গা গ্রুপ ক্যাম্পে সক্রিয়। এসব শিরোনাম দেশের জন্য কিংবা উখিয়ার জন্য হুমকি স্বরুপ নিশ্চয়! বাঙ্গালী প্রবাদ আছে, ‘নিজেকে পথে বসিয়ে কখনো কাউকে উপকার করা ঠিকনা’।

আরো অনেক বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। কিছু বাঙ্গালী রোহিঙ্গাদের সাথে মিলেমিশে কুকর্ম করে বেড়াচ্ছে। এরা একাধারে তিনচারজন রোহিঙ্গা মেয়েদের বিয়ে করে নিজেদের থাকা খাওয়ার সুবিধা করে নিচ্ছে। তাছাড়া বাঙ্গালী এসব অপরাধীরা অসৎ রোহিঙ্গাদের সাথে হাত মিলিয়ে এখনও মিয়ানমার থেকে ইয়াবা সহ আরো অনেক মাদকদ্রব্য আমদানি করছে ও সারাদেশে পাচার করছে। যতটুকু শুনলাম যেসব দায়িত্বে যারা রয়েছেন সবার চোখেই যেন ধুলো পড়েছে। কেউ দেখছেন না বা কেউ দেখেও দেখছেন না অদৃশ্য শক্তির বলে।

মিয়ানমার থেকে আনা পঞ্চাশ-ষাট টাকার প্রতি ইয়াবা ট্যাবলেট উখিয়ায় একশ/দেড়শো টাকা, কক্সবাজার পৌঁছতে পারলে আড়াইশ/তিনশো, চট্টগ্রামে হাজার/বারোশো আর ঢাকা/সিলেটসহ অন্যান্য এলাকায় দেড় হাজারের ওপর বিক্রি হচ্ছে। এরকম আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বিজনেস প্রশাসন ও লোকচক্ষুর অন্তরালে চলছে দেদারছে অথচ মাদক নিয়ন্ত্রণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি প্রায় সফল হয়েও আবারও বিফলতার মুখ দেখছে। এ যেন শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।

ফলশ্রুতিতে উখিয়ার উঠতি যুবকযুবতী, কক্সবাজারের যুবকযুবতী সহ কর্মরত নারী পুরুষ সবার কাছে খুব সহজলভ্য এ ইয়াবা আবারও যেন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। আরও কিছু অনাচারের কথা শুনেছি। মাত্র পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণী পাস করা স্থানীয় উখিয়া-কক্সবাজারের মেয়েরা এসএসসি পাসের সার্টিফিকেট তুলে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার কাজ পাচ্ছে রোহিঙ্গাদের সেবা সহায়তার প্রেক্ষিতে আর এ লোভনীয় চাকরীর বদৌলতে বিসর্জন দিচ্ছে নিজেদের সম্ভ্রম। তাছাড়া বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত নারীদের অবাধ চলাফেরা উখিয়া কক্সবাজারের পরিবেশ নষ্ট করছে। এসব কর্মজীবী নারীরা ওপেন প্লেসে ধূমপান, মদ্যপান করছে যা আমাদের সামাজিক মুল্যবোধ হুমকীর পথে ঠেলে দিচ্ছে।

এদেশ থেকে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ বা রোহিঙ্গা এদেশ ছেড়ে যাবার সম্ভাবনা যেমন জিরো পারসেন্ট ঠিক তেমনি রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ইয়াবার আগ্রাসন বিস্তার রোধ করাও কি জিরো পারসেন্ট!!!? কে পদক্ষেপ নেবেন তাদের বিরুদ্ধে। প্রশ্নটা সূধী সমাজের সচেতন নাগরিকদের কাছে ছুড়ে দিলাম। ধন্যবাদ।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। সম্পাদক লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল]

লেখক:প্রবন্ধ লেখক,সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।