কবীর চৌধুরী তন্ময়


সব অনুভূতিরই একটা ভালো দিক আছে যদি অনুভূতিটাকে আলোর পথে প্রবাহিত করে, জনকল্যাণকর হয়। কিন্তু একান্তভাবে নিজেস্ব অভূতির বাস্তবায়ন করা ব্যক্তিগুলো অনেক সময় কট্টরপন্থী হয়ে পড়ে। নিজের আবেগের কাছে পরাজয় হয় তার বিবেক, ধ্বংস হয় সভ্যতা। আর হুমকির মুখে পড়ে মানবতা।

মানবতা আজ সত্যিই হুমকির মুখে কারণ, একান্ত আবেগে গড়া নিজেস্ব চিন্তাধারা আর ধ্যান-জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটাতে কতিপয় মানুষ তাদের পেশি শক্তির অপব্যবহার করে থাকে, করছেও...। এখানে একশ্রেণির মানুষ আছে, যারা এই আবেগকে পুঁজি করে অপতৎপরতা সংঘঠিত করতে পৃষ্ঠপোষক করে আবার আরেক শ্রেণির মানুষ আছে, তাদের নিজেস্ব আবেগ বাস্তবায়নের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত ধ্বংস করতে দ্বিধা করে না, করছে না।

এই ধরনের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে মৌলবাদী বলে মনে করি। এখানে শ্রেণি বিন্যাস করলে দেখবেন, ধর্মীয় মৌলবাদ, রাজনৈতিক মৌলবাদ, জাতিগোষ্ঠী বা সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ আবার ব্যক্তি কেন্দ্রিক মৌলবাদের চিন্তাও আমাদের সমাজে প্রকট আকারে দেখা যায়। হয়তো এই ব্যক্তি কেন্দ্রিক মৌলবাদীরাই একটা সময় বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীতে একীভূত হয়ে পড়ে।

বিশ্ব মানবতা আজ ধর্মীয় মৌলবাদ দ্বারা আক্রান্ত, ভীত। কখন কোন দেশ, কোন জাতিগোষ্ঠী এই মৌলবাদের আত্মঘাতী বোমা হামলার শিকার হয়-এ নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দসহ সচেতন নাগরিক উদ্বিগ্ন।
যেমন, মিয়ানমারের বৌদ্ধধর্মীয় মৌলবাদের নোংরা থাবায় রীতিমত জাতিগত নিধন হতে হয়েছে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এই নিধনের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী দেওয়ার পরেও রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধ হয়নি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমার সরকার আজও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে নিধন করতে পৃষ্ঠপোষক করেছে স্বয়ং মিয়ানমার সরকার। সেখানে বৌদ্ধ মৌলবাদীদের সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী একীভূত হয়ে রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘঠিত করেছে। বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, মিয়ানমার সরকারকেও পৃষ্ঠপোষক করেছে তৃতীয় কোনো শক্তিধর রাষ্ট্র।

আর রাষ্ট্র নিজেই যখন মৌলবাদী আচরণ করে বা মৌলবাদী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে তখন ব্যক্তি পর্যায় থেকে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মৌলবাদী শক্তির আবির্ভাব হয়। প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে পড়ে। ব্যক্তি পর্যায় আক্রমন করতে না পারলে তখন গ্রুপকে শক্তিশালী করে তোলে। এখানেও এক বা একাধিক ব্যক্তি পর্যায় থেকে পৃষ্ঠপোষক পেয়ে থাকে। অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়িয়ে তখন প্রতিশোধ নিতে মাঠে নেমে পড়ে। যদিও এই ধরনের মৌলবাদ শক্তি বেশি দিন টিকতে পারে না। কারণ, এখানে আদর্শের চেয়ে প্রতিশোধ প্রবল আকারে কাজ করে।

কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদ শক্তি দীর্ঘদিন বিরাজ করে কারণ, এখানে ধর্মীয় আদর্শ আছে এবং সে সাথে মৃত্যুর পরে পুরস্কৃত হওয়ার আশা-আকাক্সক্ষা কাজ করে। তাই নিজের শরীরে বোমা বেঁধে নিজেকেসহ অন্যকে বোমার আঘাতে উড়িয়ে দিয়ে হত্যা করার প্রবণতা দেখা যায়। মৃত্যুর পরে তার এই কর্মকান্ডের জন্য ভালোভাবে পুরস্কৃত হবে-এই লোভ তাকে অনেক দিন ধরে মৌলবাদী আদর্শ নিয়ে চলতে সহায়তা করে, গ্রুপ ভিত্তিক কাজ করতে শক্তি পায়, উদ্বুদ্ধ হয়।

সাম্প্রতিক শ্রীলঙ্কার ঘটনা নিয়ে একটু চিন্তা করলে স্পষ্ট বুঝা যায়, মৌলবাদী ব্যক্তিগুলো ছোট ছোট আকারে নিজেদের একত্রিত করে। সাংগঠনিকভাবে একটা সময় নিজেদের কার্যক্রমও দৃশ্যমান করে তোলে। অর্থ ও অস্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে একটা সময় ধর্মীয় এই মৌলবাদগোষ্ঠী আত্মঘাতী বোমা হামলাও চালিয়ে থাকে। শ্রীলঙ্কার হামলার মাধ্যমে ধর্মীয় মৌলবাদগোষ্ঠী বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতার ভয়াবহতা দেখানোর চেষ্টা করেছে। যার বাতাস বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের মৌলবাদগোষ্ঠীকে স্পর্শ করেছে।

অন্যদিকে মৌলবাদ চিন্তাধারার গোষ্ঠীর চেয়ে ব্যক্তির হামলা ততটা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে না। দেখুন, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে চল্লিশজন মুসল্লিকে হত্যা করেছেন ব্রেন্টন ট্যারেন্ট নামে অস্ট্রেলিয়ার এক শ্বেতাঙ্গ মৌলবাদী। আর ওই হামলা নেপথ্যে কী ছিল এটিও ব্রেন্টন ট্যারেন্ট তার টুইটারে আপলোডকৃত তিয়াত্তর পৃষ্ঠায় বলেছেন, ২০১১ সালে নরওয়ের অসলোতে অ্যান্ডারস ব্রেভিক নামে এক সন্ত্রাসীর হামলায় সাতাত্তরজন নিহত হয়েছিলেন। ব্রেন্টন ট্যারেন্টের ওই ঘটনা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিউ জিল্যান্ডে এ হামলা চালায়।

নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলা করতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার চেয়ে আমার কাছে কারণটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আর সে কারণটিও ব্রেন্টন ট্যারেন্ট স্পষ্ট করেছেন এই বলে যে, ‘আমি মুসলিমদের অপছন্দ করি। আমি সেসব মুসলিমকে ঘৃণা করি, যারা অন্য ধর্ম থেকে এসে মুসলিম হয়’।

ব্রেন্ট ট্যারেন্ট নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলা করেছে শুধু মুসলিমদের অপছন্দ করত বলে। এখানে ব্রেন্টন ট্যারেন্ট তার নিজেস্ব চিন্তাধারা আর পছন্দ, অপছন্দকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে চল্লিশজন মানুষের জীবন কেড়ে নিল।

ব্রেন্টন ট্যান্টের মতন ব্যক্তি পর্যায় এই ধরনের মৌলবাদী মানুষগুলো আমাদের চারপাশেই বিরাজমান। তার পছন্দ আমাদের উপর প্রয়োগ করতে চাইবে। তার অপছন্দও আমাদের ত্যাগ করতে বলবে। অর্থাৎ এই ধরনের মৌলবাদী ব্যক্তি তার নিজেস্ব একান্ত আবেগ আর চিন্তাধারা দিয়ে সমাজ-সংসার সাঁজাতে চেষ্টা করে থাকে। আর তার ব্যতিক্রম হলে তখন পেশি শক্তির প্রয়োগ করতে চেষ্টা করে।

বাংলাদেশে আলোচিত অনেক ঘটনার মধ্যে একটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র বদরুল আলমের প্রেমের প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় সিলেটের এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ডিগ্রি (পাস) পরীক্ষার্থী খাদিজা বেগমকে হত্যার উদ্দেশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করার ঘটনা আর অন্যটি ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার ঘটনাগুলো মৌলবাদী চিন্তাধারার বাইরের নয়। একটু চিন্তা করলে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠে।

সোনাগাজীর নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনাকারী শাহাদাত হোসেন শামীম বহুবার নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু নুসরাত প্রতিবারই তার প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আবার সিলেটের বদরুলও খাদিজাকে প্রেমের প্রস্তাব করায় খাদিজাও প্রত্যাখ্যান করে।

এখানে সিলেটের বদরুল আর সোনাগজীর শামীম তাদের নিজেদের পছন্দ প্রয়োগ করতে চেয়েছিল যথাক্রমে খাদিজা আর নুসরাতের উপর। আর সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি বলেই পেশি শক্তির অপপ্রয়োগ করেছে। কারণ, এই ধরনের ব্যক্তিগুলো মৌলবাদ চিন্তাশক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। তাই অপরের পছন্দ, অপছন্দ তাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

আর রাজনৈতিক মৌলবাদী ব্যক্তি নিজে এককভাবে না পারলে সংগঠন বা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে থাকে। নিজের মান-সম্মানের বালাই নেই কিন্তু অন্যের সম্মানে আঘাতে ব্যথিত মর্মে মামলা টুকে দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় কর্মকর্তাকে ব্যবহার করে তারা তাদের নোংরা থাবা অনেক সময় বাস্তবায়ন করে থাকে। বাংলাদেশে এই ধরনের অনেক ঘটনা আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্চগড়ে কারাগারে অগ্নিদগ্ধ আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের মৃত্যুর ঘটনাটি এবং অন্যদিকে বরিশালের কবি হেনরী স্বপনকে গ্রেপ্তার করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায়।

দুটো ঘটনায় এখানে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়েছে।

পঞ্চগড়ের আইনজীবী পলাশ কুমার নিজে ন্যায্য বিচারের প্রার্থনা নিয়ে সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে মানববন্ধন করলে ওই মানববন্ধনেই আবার প্রধানমন্ত্রীকে কটুক্তি করেছে-এমন অভিযোগে ব্যথিত হয়ে আরেক রাজনৈতিক কর্মী মানহানীর মামলা করায় রাষ্ট্র তাকে কারাগারে পাঠায়। আর সেই কারাগারে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রাণনাশের হুমকির পর একটা সময় কে বা কারা টাইগারের বাতল থেকে কী যেন ছুড়ে তার শরীরে আগুন লাগিয়ে অবশেষে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। মৃত্যুর ঠিক আগমুহুর্তে রেকর্ড করা ৫ মিনিট ৭ সেকেন্ডের অডিওতে আইনজীবী পলাশ কুমারের বক্তব্য ‘উুরহম উবপষধৎধঃরড়হ’ হিসেবে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী স্পষ্ট হয় প্রকৃত ঘটনা।

অন্যদিকে নব্বই দশকের কবি হেনরী স্বপন প্রাণনাশের হুমকিতে তার নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি লিখিতভাবে বরিশাল কোতোয়ালি থানা পুলিশকে জানান রবিবার (১২ মে, ২০১৯)। আর মঙ্গলবার (১৪ মে, ২০১৯) বেলা পৌনে দুইটায় কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে নগর বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করা হলে আদালত কবি হেনরীকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়। কারণ, এখানেও খ্রিষ্টান ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ব্যথিত হয়ে মামলা করেছে বরিশাল ক্যাথলিক চার্চের ফাদার লরেন্স লাকা ভেলি গোমেজ আর ব্যবহার করেছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে।

যদিও ১৬ মে, ২০১৯ বেলা ১২টায় বরিশাল নগর বিচারিক হাকিম আদালত আগামী ৩০ জুন, ২০১৯ মামলার পরবর্তী তারিখ পর্যন্ত হেনরী স্বপনের জামিন মঞ্জুর করেন। পাশাপাশি আদালত এ মামলার বাদীকে ভর্ৎসনাও করেছেন।

আমাদের দেশে এই ধরনের চিন্তাধারার মানুষগুলোর অনুভূতি বাস্তবায়নের নোংরা থাবা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রীতিমত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। ভিন্ন মতে যুক্তি বা তথ্য-উপাত্ত থাকলেও আমরা অনেকেই গ্রহণ করতে পারি না। বরং নিজের মতামতকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। অনেক সময় সে চেষ্টায় থাকে পেশি শক্তির প্রয়োগ অথবা রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার।

এই ধরনের মৌলবাদী চিন্তাধারার মানুষগুলো ছোট ছোট গ্রুপ হয়ে তাদের পেশি শক্তি প্রয়োগ করে হত্যা করেছে এদেশের বহুমাত্রিক মননশীল লেখক, গবেষক ডক্টর হুমায়ুন আজাদসহ অনেক ব্লগার, লেখক, প্রকাশককে। হত্যা চেষ্টায় হামলা করেছে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপর। আর নারীদের দমিয় রাখতে ধর্মীয় মৌলবাদগোষ্ঠী নানা রকম ফতোয়া দিয়ে নারী বিরোধী পরিবেশ সমাজ, রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে।

আমি মনেকরি, এই ধরনের মৌলবাদী ব্যক্তি, গ্রুপ বা সংগঠনের বিরুদ্ধে সরকার ও সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্রকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে। পেশি শক্তি আর রাষ্ট্রযন্ত্রের আইনী অপপ্রয়োগ রোধ করতে হবে।

প্রতিটা উগ্রপন্থীর বিষবাষ্প ছড়ানোর আগেই সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে এগিয়ে আসতে হবে। অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধের পাশাপাশি নির্মূলে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা মানবিক সমাজ রাষ্ট্র গঠনের সহায়তা করবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)।