প্রবীর বিকাশসরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

আসল ঘটনা হচ্ছে, আহাম্মদ আলী কুমিল্লা থেকে আসা দর্শন বিভাগে ভর্তি হয়েছে প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রী মাধুরী বল নাম্নী এক ঘনশ্যামলা মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একেবারে ডুবুডুবু অবস্থা। কয়েকবারই প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বিফল মনোরথ হয়ে ভুইল্যার ডোজ বাড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে মাধুরীকে বিয়ে করেছিল মানিক ও মিটনের বন্ধু সুমন ওরফে সুমু। কিন্তু এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় মাধুরী অকালে। মিটন খুব দুঃখ পেয়েছিল। আর আফজালের দুঃখের নাম তো ছিল বিভা। সেও একদিন ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক লেকচারারকে হঠাৎ বিয়ে করে আমেরিকা পাড়ি দিল। আমরা জানতাম না। সেই খবর এক মাস পরে পেয়ে আফজাল স্তব্ধ হয়ে গেল। পরে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে কুমিল্লা গিয়ে ল’ পড়েছিল, বিয়েও করেছিল আফজাল কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে একটি কি দুটি শিশু সন্তান রেখে সেও অকালে পৃথিবী ছেড়েছে। নিশ্চয়ই বিভা সে খবর পেয়েছিল, কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কে জানে। জাপান থেকে ফিরে গেলে দুবার আফজালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মানিক এবং আফজাল দুজনের মৃত্যুসংবাদ আজও অবিশ্বাস্য মনে হয়।

মানুষের জীবন যে কত ক্ষণস্থায়ী--পদ্মপাতায় টলোমলো শিশির ফোঁটার মতো, এই আছে এই নেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আহাম্মদ আলী কৃষিব্যাংকে চাকরি নিয়ে দাড়ি রেখে একেবারে পাকা মুসুল্লি হয়ে গিয়েছে, এখনো সেরকমই। সময় মানুষকে কীভাবে যে বদলে দেয়! বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার কথা বলা শেষ করা যাবে না। ক্যাম্পাসের কিছু কিছু দৃশ্য আমার উপন্যাস ‘অতিথি’তে ছায়া ফেলেছে অবশ্য। দেখতে দেখতে গ্রীষ্মকাল এসে গেল। মাস খানেকের জন্য ছুটি। ছুটির পরেই আমি আলাওল হলে এসে উঠবো। দুসীট বিশিষ্ট তিনতলা পর্যন্ত প্রতিটি রুম। আমাদের রুমের অন্য সিটে থাকেন শফিক শিকদার নামে একজন সিনিয়র ছাত্র শান্ত নীরব মানুষ। চারতলা শুধু এমএ বা বিদায়ী ছাত্রদের জন্য সিঙ্গেল রুম। সেকি আনন্দ! আহাম্মদ আলীও খুশি। দল বেঁধে ট্রেনে চড়ে, ভুইল্যা টানতে টানতে একমাত্র মানিক ছাড়া সবাই কুমিল্লা ফিরলাম। এসে মাকে প্রণাম করলাম। মা জড়িয়ে ধরে সেকি আদর! মার স্বপ্ন সফল হয়েছে। বিকেলের দিকে ফিরেছিলাম। স্নান সেরে খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। বহুদিন পর লুলুমুন্ডিতে রেকর্ড চাপালাম। পিন্টু ভট্টাচার্যের একটি রেকর্ড, ইংরেজিতে ‘এ’ লিখিত পীঠে যে গানটি বাজলো সেটি ছিল, ‘চলো না দীঘার সৈকত ছেড়ে / ঝাউবনের ছায়ায় ছায়ায়/ শুরু হোক পথ চলা / শুরু হোক কথা বলা......’।

চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের স্বরগ্রাম দোকান থেকে কয়েকটি রেকর্ড কিনেছিলাম। অনেকদিন পর ‘গ’এর মুখটা মনে পড়লো। এত ব্যস্ত ছিলাম এই ক’টা মাস যে তার কথা একদম মনেই হয়নি। অবশ্য এর মধ্যে কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেছে তা জানতাম না, জেনে অবাক হলাম! অন্যদিকে আরেকটি ঘটনা যে ঘটবে তা ছিল মাত্র সময়ের প্রতীক্ষা মাত্র তাই বা কে জানতো! মাত্র কয়েক মাস ছিলাম না পাড়াটা কেমন নতুন নতুন লাগছিল। গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পাড়ায় তো খবর ছড়িয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। বাকি ছিল শুধু অভিনন্দন পাওয়ার ছোটবড় সকলের কাছ থেকে। আসলে তখনো পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিষয়টি গৌরবের ছিল। বাসে, টেনে দেখেছি দাঁড়িয়ে থাকলে মুরুব্বি গোছের লোকজন সীট ছেড়ে সম্মান জানাতো। পরে এই সম্মান দূরে থাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুনলে ফিরেও তাকাতো না মানুষজন। অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাসীর রাজনীতি কোথায় নিয়ে গেছে এদেশের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চবিদ্যাপীঠের শিক্ষানবীশ তথা ভবিষ্যতের কারিগরদেরকে ভেবে লজ্জিত হয়েছি। পড়ালেখা করার আগ্রহটা ক্রমেই জলো হতে শুরু করেছিল।

বাসায় ফেরার পর সন্ধ্যের দিকে ঘর থেকে বেরিয়েই শুক্লার সঙ্গে দেখা তাদের ফটকের কাছে। ছোট্ট করে বললো, ‘কনগ্রেচুলেশন্স! কেমন লাগছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন?’ একটা সিগারেট ধরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললাম, ‘থ্যাঙ্ক ইউ শুল্কা। কই তেমন আহামরি কিছু তো মনে হচ্ছে না, তবে নতুন একটি পৃথিবী এটা ঠিক।’ ‘মাত্র তো শুরু হলো ভালো লাগবে, না লেগে থাকতেই পারে না! স্মার্ট, সুন্দরী মেয়েরা বান্ধবী হবে, ভালো লাগবে তখন।’ ‘তা হবে হয়তো। বলো কেমন ছিলে?’ ম্লান হাসলো শুল্কা, ‘আমাদের আর কি, দিন আসে দিন যায়। চলে যাচ্ছে।’ তারপর অবাক করে দিয়ে বললো, ‘তোমার তো এখন সুখের সময়।’ ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘কবে আর দুঃখের সময় ছিল আমার। হঠাৎ এ কথা কেন বলো তো?’ নিচু সুরে বললো, ‘‘গ’ কয়েকবার তোমার খোঁজ নিয়েছে। কয়েক দিন এসেছিল। ইতিউতি তাকিয়েছে। কী জাদু করেছো কে জানে! যখন শুনলো চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো শুনে কী ভাবলো কে জানে আর আসেনি। খবর পেলে হয়তো আসতে পারে।’ আমি বেশ নড়ে চড়ে উঠলাম, চমৎকৃত হলাম শুক্লার কথা শুনে। মিথ্যে যে বলবে না সেটা আমি জানি। আমি কিছু বলার আগেই শুল্কা বললো, ‘যাই, মা ডাকছে। আছো কিছুদিন?’ ‘হ্যাঁ, এই একটি মাস। গ্রীষ্মের ছুটি তো।’ ‘নতুন বই কিছু এনেছো?’ ‘আছে কাল সকালে পাবে।’ ‘তাই? কার কার?’ ‘সুনীল, শ্যামল, রমাপদ, বুদ্ধদেব, সুবোধ, আশুতোষ, প্রফুল্ল, প্রেমেন্দ্র, মুস্তফা সিরাজ, দেবেশ। ‘ওমা! বলো কী! এ্যাত! এই আজকে দাও না দু-একটা প্লীজ!’ ‘আচ্ছা মার কাছে রেখে যাচ্ছি পরে এসে নিয়ে যেও।’ মনটা হটাৎ উড়ু উড়ু হয়ে উঠলো। ‘গ’ এসেছিল তাহলে! ওর বড়দা, মামাতো ভাই টের পেলে কী হবে কে জানে? মা’টাও খুব কড়ামেজাজী শুনেছি। একটু খারাপ লাগলো বটে।

হাঁটতে হাঁটতে বিষ্ণুদের বাসার কাছে গিয়ে ওকে ডাকলাম। ওর ছোটবোন দীপ্তি বেরিয়ে এলো। ববিতার মতো যার চেহারা। দেখেই বললো, ‘ও পটুদা! কনগ্রেচুলেশন্স! কখন এলেন? আজকে?’ ‘হুঁ, এই তো বিকেলবেলা। বিষ্ণু কোথায়?’ ‘সেজদা তো শঙ্করদা, স্বপনদার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেছে দুপুরের পর। দীপিকাতে গেলে পাবেন। মনে হয় বেরোলো বলে। ছ’টা তো বেজে গেল, তাই না?’ ‘তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?’ বেণী দুলিয়ে হাসলো, ‘একরকম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খুব সুন্দর নাকি? ভালো লাগল?’ ‘বনজঙ্গল ক্যাম্পাস মন্দ নয়। নিরিবিলি, সবুজ ঘেরা।’ ‘আপনার জন্য তো ভালোই হবে।’ ‘এ কথা কেন বলছো?’ ‘বা--রে আপনি যে কবি! কবিরা তো নিরিবিলি নির্জনতাই বেশি পছন্দ করে।’ আমি শব্দ করে হাসলাম, ‘যা বলেছো। শিকার ধরার জন্য বুঝি!’ কী বুঝলো কে জানে। দীপ্তির সারামুখ লাল হয়ে গেল, যাহ্, ‘কী যে বলেন!’ বাদুরতলা পর্যন্ত যেতেই ওদের দেখা পেলাম। হেলেদুলে তিন জনই শার্ট খুলে কাঁধে নিয়ে হেঁটে আসছিল। আমিও রাস্তার পাশে সিনেমার নায়কের মতো প্যান্টের বাঁ পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেট টানছিলাম। বেশ দূর থেকে দেখেই চিৎকার দিয়ে ছুটে এলো একসঙ্গে তিন জন। বিষ্ণু বললো, ‘কখন এলি! কনগ্রেচুলেশন্স! শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পারলি। আমরাও খুব দুশ্চিন্তা করছিলাম। লতিফমামা এসে বললে পরে দুশ্চিন্তামুক্ত হলাম। কী ইতিহাসেই?’ ‘হ্যাঁ। ইতিহাস বিভাগেই।’ শঙ্কর তার বিশাল হাতের তালু আমার মুখে বুলিয়ে বললো, ‘বেশ শুকিয়ে গেছো। খাওয়াদাওয়া করোনি ভালো করে মনে হয়।’ ‘খেয়েছি, হলের ডালের পানি তো নয়, মানিকের বাসায় আছি, ভালোই খাচ্ছি। এবার গিয়ে হলে উঠবো। নতুন পরিবেশ, তাছাড়া ক্লাস অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল, ম্যানেজ করতে বেশ দখল পোহাতে হলো, তাই মনে হয় কিছুটা শুকিয়েছি, মাও তাই বললো। তারপর তোরা কেমন আছিস বল্।’ ‘এই তো চলছে। গতকাল থেকে অবশ্য কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। শঙ্কর তো বাবার ব্যবসায় ঢুকে গেল। কাকাবাবুর শরীরটা আসলেই ভালো নেইরে।’ ‘তাই নাকি?’ ‘হ্যাঁ। শরীর যেদিন ভালো থাকে দোকানে আসে, না হলে বাসায় থাকে। বয়স হচ্ছে না? বড়দির ছেলেই তো কত বড় হয়ে গেছে! চলো গরম লাগছে, পার্কে গিয়ে বসি। তুমি চলে যাওয়ার পর আমাদের যে কী খারাপ লাগছে কী বলবো, তাইনারে স্বপন?’ শঙ্কর বললো। ‘তা তো লাগবেই। কী আর করা? আমরাও ব্যস্ত হয়ে গেলে তখন অত খারাপ লাগবে না। চল্ যাই’, স্বপন উত্তর দিল। পার্কে এসে বসতেই স্বপন বললো, ‘মামু, আনছো কিছু? থাকলে দীন-দুঃখীদের দু-একটা ভিক্ষাটিক্ষা দাও।’ আমি পকেট থেকে একটি প্যাকেট বের করে দিলাম। ঝিলিক দিয়ে উঠলো স্বপনের দুচোখ। শঙ্করও হেসে উঠলো, ‘ও চিয়ার্স! পটু না এনে পারে!’ পরের দিন দুপুরের পরে স্বপনের বাসায় গেলাম। মাসিমার সঙ্গে দেখা করা দরকার। মাসিমা যে আদর আমাকে করেন তা মনে হয় স্বপনকেও করেন না।

স্বামীহীন এতবড় সংসারটাকে মাসিমা কত কষ্ট করে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সেটা কাউকে বলা যায় না একমাত্র অনুভব ছাড়া। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই তাঁর, কোনো উচ্চবাক্য করতে আজ পর্যন্ত দেখিনি। মাসিমা আমাকে দেখে কী যে খুশি হলেন! আমি পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। বললেন, ‘তোমার মা মিষ্টি নিয়ে এসে সুখবর দিয়েছেন। বেঁচে থাকো বাবা, বেঁচে থাকো। ঈশ্বর তোমার মনোবাসনা পূরণ করুন।’ মাসিমা সাদা কাপড়ের আঁচল দিয়ে আনন্দাশ্রু মুছলেন। আমাদের কথা শুনে ভেতরের ঘর থেকে বৌদি, বেবী, বুড়ি বেরিয়ে এলো। কুশল বিনিময় করে বৈঠকখানায় বসলাম। স্বপনের থেকে বছর দুয়েকের বড় বেবীদি বললেন, ‘এখন চা খাবে নাকি আরও পরে দেবো।’ বললাম, ‘পরে। একটু ঘুম পেয়েছে। স্বপন বললো, ‘পাঁচটার দিকে ভিক্টোরিয়া কলেজে একটি কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান আছে, ঢাকা থেকে দুজন আবৃত্তিকার এসেছেন, যাবি?’ বললাম, ‘তাই নাকি? চল্। বিষ্ণুরা যাবে?’ ‘বিষ্ণু যাবে। শঙ্কর যাবে না সে তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দোকানে।’ ‘ঠিক আছে একটু ঘুমিয়ে নিই। তুলে দিস।’ ঘুমের ঘোরেই কিনা পাশের ঘরে বৌদি, বেবী ও বুড়ির কন্ঠসহ আরও একটি মেয়েলি কন্ঠ শুনতে পেলাম। বেশ মিষ্টি কন্ঠ। আবার গুনগুন করে হৈমন্তী শুকার একটি গান, ‘আমার বলার কিছু ছিল না / না গো / আমার বলার কিছু ছিল না/ চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে.......।’

ইদানীং গানটা খুব হিট করেছে, যত্রতত্র বাজানো হচ্ছে। গত বছরের পুজোর গান। বেশ ভালোই লাগছিল। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলাম। বিকেল গাঢ় হলে স্বপন ডেকে তুললো। চোখ মেলে দেখলাম বেতের টেবিলে সাজানো চাচক্রে স্বপন, বেবী, বৌদি, মাসিমা আর একটি মেয়ে। কমলা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা। ছোট্ট মুখ, মাঝারি গড়নের শরীর, মাঝারি আকৃতির স্বচ্ছ চোখ কিন্তু খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কপালে লাল বড় একটি টিপ, পরিপাটি খোলা চুল। প্রথম দেখাতেই মনে হলো কোথায় যেন এর আগে দেখেছি। কিন্তু স্মরণ করতে পারলাম না। আমি বাথরুমে গিয়ে ঝরঝরে হয়ে ফিরে এসে চায়ে চুমুক দিলাম। মেয়েটি বেতের মোড়াতে বসে বারান্দার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে চা খাচ্ছিল। বৌদি আর বেবীদি কি নিয়ে কথা বলছিল। স্বপন পত্রিকার পাতায় মশগুল ছিল। আমি ফিরে এলে পত্রিকাটি একপাশে সরিয়ে রেখে বললো, ‘পটু আয় পরিচয় করিয়ে দিই। হয়তো এর আগে দেখে থাকবি বেবীর সঙ্গে। ওর নাম ‘স’, বেবীর সঙ্গেই মহিলা কলেজে পড়ে। ব্রহ্মমন্দিরের কাছাকাছি ওদের বাসা।’ আমি ও সে মাথা নোয়ালাম নিঃশব্দে। তবে কোনো শব্দ বিনিময় হলো না। মাসিমা বললেন, ‘তোরা না কোথায় যাবি বললি। গেলে যা। তাড়াতাড়ি ফিরিস।’ আমরা রেবিয়ে গেলাম। স্বপনকে বললাম, ‘মেয়েটিকে কোথায় যেন দেখেছি।’ ‘তাতো দেখবিই। বললাম না যে দেখে থাকবি। শহরময় ঘুরে বেড়ায় বেবী ও আর সব বান্ধবীরা। কেমন লাগলো?’ ‘মন্দ নয়।’ ‘জুটি ছিল শুনেছি। এখন সিঙ্গেল হয়ে গেছে।’ ‘কেন? কেন?’ ‘কেন আবার মনোজগতের ব্যাপার। আকাশের তারা যেমন মাঝে মাঝে স্থান বদল করে এরকম আর কি। ওর বাবা নেই, অনেকগুলো ভাইবোন। বোনগুলো একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর। বড়বোনটা খুব ভালো চাকরি করেন। মেজবোনের স্বামীও বেশ ধনী। খালাম্মা দয়ায়-মায়ায় সর্বদা হাসিখুশি অসাধারণ এক মানুষ।’ ‘এর আগে কোথায় ছিল?’ ‘তা বলতে পারবো না। শুনেছি ঢাকায় ছিল।’ ‘তোদের সঙ্গে পরিচয় হলো কী করে?’ ‘বেবীর সঙ্গে গত এক বছর ধরে পরিচয়। আমিও মাঝে মাঝে যেতাম। যাকগে, সে আলাপ। একটা ছাড় তো। দারুণ বাতাসটা, ধরবে ভালো।’ আমি একটা স্বপনের হাতে দিলাম। প্রথম টানেই পট পট শব্দে কয়েকটি বিচি ফাটল। শব্দে ও গন্ধে তরুণ রিক্সাওয়ালা আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। রাজকীয়ভাবে হেলান দিয়ে বসা স্বপনও পুরু গোঁফের নিচে একটি মুচকি হাসি মেলে ধরলো। তিন / চারদিন পরের ঘটনা। আবার তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্বপনের বাসায়। সেদিন ছিল শুধু বৌদি, স্বপন আর ‘স’।

আমি কড়া নাড়তে সে দরজা খুলে দিলে আমি চমকে গেলাম। ধবধবে সাদা শিফনের শাড়ি। কাপালে সাদা টিপ, খোলা চুল। ঠোঁটে হালকা লাল রঙের লিপিস্টিক। মিষ্টি হেসে বললো, ‘আসুন, আসুন। ভালো আছেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। ভালো। আপনি?’ ‘ভালো।’ ‘স্বপন কি বাসায় নেই?’ ‘আছে। এইমাত্র বাথরুমে ঢুকলো। আপনি ভিতরে এসে বসুন।’ বুঝতে পারলাম ‘স’ বেশ মিশুক মেয়ে। এমনভাবে কথা বলছিল যেন অনেক দিনের চেনা আমি তার। এই সকালবেলা একজন সুহাসিনীর মিষ্টি ব্যবহারে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কী দারুণ ভালো লাগলো। মাসিমা থাকলে সিগারেট টানা যায় না। স্বপনের বড়দা বিমলদার অ্যাশট্রেটা নিয়ে এসে একটি সিগারেট ধরালাম। বৌদি খুব খোলামেলা মানুষ কিছু মনে করেন না। সিগারেট শেষ করে পত্রিকা খুলে কি মনে করে পিন্টুর গানটি গেয়ে উঠলাম, ‘চলো না দীঘার সৈকত ছেড়ে / ঝাউ বনের ছায়ায় ছায়ায় / শুরু হোক কথা বলা / শুরু হোক পথচলা....।’

নাটকীয়ভাবে এই গানটি যে একদিন কাল হয়ে দাঁড়াবে সেই তারুণ্যে আমার কে ভেবেছিল সেদিন! গানটি শুনে পাশের ঘর থেকে ‘স’ এসে উঁকি দিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা পেয়ে থামিয়ে দিলাম। বলল, ‘ওমা থামলেন কেন? আপনার গলা তো ভারি সুন্দর! পিন্টু ভট্টাচার্যের সঙ্গে মিলে গেছে। আবার গান না!’ না। আমি আর গাইলাম না। গায়ে এসে পড়া কাউকে আমার ভালো লাগে না। জোরজারিও একদম দুচোখের বিষ। আমি একটু উষ্মার সঙ্গে বললাম, ‘আমি গায়ক নই। গাইতে পারি না। এখন কীভাবে যেন হয়ে গেল, আর হবে না।’ ‘কে বললো হবে না? আপনি গান জানেন মিথ্যে বলছেন কেন? ভালো লেগেছে বলেই তো অনুরোধ করছি।’ তারপর আর কিছু না বলেই পাশের ঘরে গিয়ে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে গটগট করে হাইহিলে শব্দ তুলে চলে গেল। বৌদি এসে বললেন, ‘কি ব্যাপার? ‘স’ এভাবে চলে গেল কেন পটু!’ ‘কি জানি বৌদি। আমি তো কিছু বলিনি।’ ‘তাই তো। মাত্র দুদিন আগে পরিচয় তাই না? ঝগড়া হওয়ারও কথা নয়। কী জানি বাবা! ওর মাথায় কখন যে কী ভূত চাপে বোঝা মুশকিল! মাঝে মাঝে বুঝতে সত্যি কষ্ট হয়। ভাবলাম একসঙ্গে দুপুরে সবাই খাবো, তা আর হলো না।’ স্বপন বৌদির পেছনে এসে বললো, ‘বাদ দাও বৌদি। ও এই রকমই। ওর কিছু মানসিক সমস্যা আছে আমি জানি। আমার দিকে তাকিয়ে স্বপন বললো, ‘ফরগেট ইট দোস্ত, টেক ইট ইজি।

নেক্সট টাইম শি উইল কাম ডাউন টু ইউ ফর বেগিং অ্যাপলোজি, ইউ সী দেন।’ ওরকম কতবার যে ঝগড়া হয়েছে ওর সঙ্গে হিসেব নেই! আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। খুব খারাপও লাগলো। এই রূঢ় আচরণটা না করলেও পারতাম একটি ভদ্রমেয়ের সঙ্গে। কী মনে করলো কে জানে! গানটা ভালো লেগেছে বলেই তো আবার শুনতে চেয়েছে। এমনভাবে তাকে ফিরিয়ে না দিলেই পারতাম। আমি চট করে উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখি নেই, ‘স’ চলে গেছে। স্ট্রেঞ্জ! শালার সকালেই এমন একটি ঘটনা ঘটবে ভাবতেই পারিনি। দুশ্ শালা মনটাই খারাপ হয়ে গেল।.....চলবে।

আলোকচিত্র : বামে, বন্ধু স্বপনদের বাসা। এখানে দোতলায় ওরা থাকতো, এখন নেই। আসাযাওয়ার পথে এখন যখন চোখ যায় বুকের ভেতরটাকে কেমন করে ওঠে। ডানে, পিন্টু ভট্টাচাের্যের সেই হৃদয়-হন্তারক গানটি।