মেহেরপুর থেকে তোজাম্মেল আযম : মুজিবনগর প্রকল্প বার বার কাটা ছেঁড়ার অজুহাতে আর কতদিন লাগবে শেষ হতে এ প্রশ্ন এখন দেশী বিদেশী পর্যটকসহ স্থানীয় মানুষের। কারণ প্রকল্প শুরু হবার পর অনেক কাজ শেষ হয়েছে। অনেক কাজ শেষ হয়নি। যেগুলো শেষ হয়েছে সেগুলো ব্যবহার না করার কারণে পরিত্যক্ত থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ভাস্কর্যগুলো ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এখানেই বাংলাদেশের প্রথম সরকারের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ওই সরকার পরিচালিত নয় মাসের যুদ্ধে বিশ্বের বুকে আমরা পায় একটি লাল সবুজের পতাকা। যার সাক্ষি হয়ে সগৌরবে মুজিবনগরে দাঁড়িয়ে আছে ২৩টি কংক্রিট সফেদ দেয়াল পাকিস্তানি ২৩ বছরের শাসন-শোষণের দুঃসহ স্মৃতিবহ ঘটনার স্মৃতিসৌধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ৩১ আগষ্ট বৈদ্যনাথতলার আমবাগানটিকে সংরক্ষণসহ ঐতিহাসিক পবিত্রতম স্থানে রূপান্তরিত করার লিখিত নির্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গণপূর্ত অধিদপ্তর ঐতিহাসিক স্থানটিকে জাদুঘর,স্মৃতিসৌধ, এবং অতিথিভবন নির্মানের পরিককল্পনা গ্রহন করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থাযী রাষ্ট্রপতি সৈযদ নজরুণ ইসলাম ১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে এসে ওই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সবকিছু উলোট পালট করে দেয়। পরবর্তী জিযাউর রহমান সরকারের আমলে আর কিছুই হযনি। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে আবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালে ১ কোটি ৯৩ লাখ ১১ হাজার ১৩৩ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। ১৯৯৭ সালে আওযামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে স্মৃতিসৌধ এলাকায ৬৬ একর জমির ওপর ১১’টি মন্ত্রনালয়ের বিভিন্ন দফতর ও অধিদপ্তর মুজিবনগর কমপ্লেক্স স্থাপনের কাজ শুরু করে। মেহেরপুর শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দুরে ওই কমপ্লেক্স এলাকায পর্যটন মন্ত্রনালয ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যযে ১২ কক্ষের অত্যাধুনিক একটি মোটেল, ধর্ম মন্ত্রনালয ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যযে অত্যাধুনিক মসজিদ,স্থানীয সরকার মন্ত্রনালয ৪৫ লাখ টাকা ব্যযে একটি শপিংমল, ৪৫ কোটি টাকা ব্যযে পোষ্ট অফিস, ২০০ লাইনের ডিজিট্যাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, এতিমখানা, জাদুঘর, প্রশাসনিক ভবন, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র, দ্বিতীয স্তরবিশিষ্ট গোলাপ বাগান, ফাংশনাল ভবন, প্রাথমিক বিদ্যালয়, আনছার ও ভিডিপি অফিস-কাম রেষ্ট হাউজ ও ব্যারাক, পল্লীবিদ্যুৎ অফিস, অফিস ভবন, বাস টারমিনাল, হেলিপ্যাড, পিকনিক স্পট, কার পার্কিং, পাবলিক টয়লেট, প্রবেশ পথ ইত্যাদি। ধাপে ধাপে চলছে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। মুজিব নগর কমপ্লেক্স আরও দৃষ্টিনন্দন রূপ দিতে ১৯৯৯ সালে বন মন্ত্রনালযের এক বিশেষ পরিকল্পনায ৬ দফার ভিত্তিতে ৬’টি গোলাপ বাগান করা হয। বিভিন্ন প্লটে লাগানো হয শোভাবর্ধন হরেক দেশীয ফুল গাছ। বন মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে, ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যযে জাপানি ৬ প্রজাতির দুর্লভ হাইব্রীড জাতের গোলাপ গাছ আনা হয়েছিল। সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা, ডিজাইন এবং ইউরোপীয ক্যাটাগরিতে ২ হাজার ৩০০ গোলাপের গাছ দিয়ে বাগানটি তৈরি করা হয। বাগানের সৌন্দর্য সেদিন মুজিব নগর দেখতে আসা পর্যটকদের একমাত্র দৃষ্টি নন্দন স্পট ছিল। বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে অধিকাংশ বাগানের ফুলগাছ মরে গেছে।
বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্যদিয়ে মুজিবনগর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে পলাশীর আম্রকাননে একদিন অস্ত গিয়েছিল বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য। সময়ের প্রবাহে ইতিহাসের অনিবার্যতায় পলাশীর অদূরে সেদিনের বৈদ্যনাথতলায় আরেক আম্রকাননেই আবার উদিত হয়েছিল একাত্তরের ১৭ এপ্রিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য। মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার সেই আম্রকানন, বর্তমানের ঐতিহাসিক মুজিবনগর।
৪৫ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার টাকায ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানচিত্র’ প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন পায়। ১৯৯৮ সালে প্রকল্পর কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্র নির্মাণ, মানচিত্রকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাচিত্র, মানচিত্রে যুদ্ধকালে দেশের ৪’টি পথ দিয়ে শরণার্থী গমন, হার্ডিং ব্রীজ ধ্বংস, শালদহ নদীতে যুদ্ধ, শুভপুর ব্রীজের সন্মুখ যুদ্ধ, কামালপুর ও কুষ্টিয়ার মীরপুরের যুদ্ধ, চালনা ও চট্রগ্রামের বন্দর ধ্বংস, পাহাড়তলী ও রাজশাহীর হত্যাযজ্ঞ, জাতীয় শহীদ মিনার ধ্বংস, সচিবালয়ের আক্রমণ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ, রায়ের বাজারের বধ্যভূমি ও বুদ্ধিজীবী হত্যার চিত্র তুলে ধরা, জাদুঘর ,স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত গ্রন্থসমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, সেমিনার কক্ষ, মিলনাযতন,স্মৃতি কেন্দ্রের অফিস ভবন, গ্রন্থভাণ্ডার ও বিক্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ৪০’টি ভাস্কর্য নির্মাণ, আ. স. ম. আবদুর রবের পতাকা উত্তোলন, শাহজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠ, জাতীয নেতৃবৃন্দের তৈলচিত্র , মিলনায়তন ভবনের গায়ে টাইলসের মুরাল চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের ষড়ঋতুকে দৃশ্যমান করে তোলা, ফোযারা নির্মাণ, স্বাধীন বাংলার পতাকার প্রতিকৃতি, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, পাকিস্থান বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল খোদাই করে লিপিবদ্ধকরণ, মুজিবনগর সরকারের প্রতীক নির্মাণ ও টাইলসের ফলকে মুজিবনগর সরকারের প্রচারপত্র নির্মাণ ও সংযুক্তকরণ, মানচিত্রের দক্ষিনপাশ ঘেষে অ্যন্টি ফাংগাস টাইলস দিয়ে প্রতিকী বঙ্গোপসাগর। মানচিত্রের বাইরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের কালো রাত্রি, অগ্নিসংযোগ, পাকবাহিনীর নারী নির্যাতন, ১৭ এপ্রিলে মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, ১২’জন আনছার কতৃক অস্থাযী রাষ্ট্রপতি সৈযদ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান এবং সেক্টর কমান্ডারসহ অরোরা, নিয়াজী ও এ কে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের ভাস্কর্য নির্মাণ মুজিব নগরকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। অসমাপ্ত আছে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ মানচিত্রর কাজ। এ পর্যন্ত পোষ্ট অফিস, টেলিফোন অফিস, শিশুপল্লী ও মসজিদ আছে।
মেহেরপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান উল্লাহ জানান, ৫৬৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকার মুজিবনগর প্রকল্পের বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়া সব কাজই প্রায় শেষ হয়েছে। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ মানচিত্র প্রকল্পটি বিভিন্ন সময়ে কাটা ছেঁড়া করার কারণেই কাজ শেষ করতে সময় লাগছে। কাটা ছেঁড়া করা হলেও মূললক্ষ্য দৃষ্টিনন্দন করতেই কাটা ছেঁড়া করা হয়েছে। ফলে ১৯৯৮ সালে শুরু হওয়া প্রকল্প ২০০৬ সালে শেষ হবার কথা থাকলেও শেষ করা যায়নি। পরবর্তীতে সংশোধিত বাজেটের কাজ চলছে। ভৌত কাঠামো শেষ হয়েছে। তিনি জানান অসমাপ্ত কাজের মধ্যে আছে স্টেজে কাঠের কাজ, বারান্দা ও সিঁড়িতে এসএস রেলিং, জলছাদ, ১০০ কেবিএ জেনারেটর ক্রয়, এপ্রোস রোড ইত্যাদি। প্রশাসনিক ভবনেও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়নি। শেষ হয়নি আনসার ও ভিডিবি ব্যারাক।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, আর কালক্ষেপন নয় চলতি বছরেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এবং আগামী বছরের ১৭ এপ্রিল এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে।

(এএস/এপ্রিল ১৬, ২০১৪)