রঘুনাথ খাঁ : আরতি দাসের (১৭) বাড়ি সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার বহেরা গ্রামের দাস পাড়ায়। বাবা অন্তোস দাস ও মা অঞ্জলী দাস। বাবা পেশায় ভ্যান চালক। চার শতক জমিতে তাদের বসবাস। আরতি দাসের বহেরা এটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে গত বছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। ডান পায়ের হাঁটুর নীচে হাঁড়ের ক্ষয় দেখা দেওয়ায় ফর্ম পুরণ করতে পারেনি সে। একপর্যায়ে ঢাকায় নিয়ে অপারেশন করার পর ক্রেচ দিয়েই তাকে চলাফেরা করতে হয়। পরে আরতির ক্যান্সার হয়েছে বলে ঢাকার ডাক্তাররা জানান।

বোনের ক্যান্সার হয়েছে জেনে ভাই সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে চতুর্থ বর্ষের দর্শণ বিভাগে অনার্সের ছাত্র হীরন ও একই কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র কিরণ ভেঙে পড়ে। বোনের চিকিৎসার জন্য কীরণ একটি ছোট কোম্পানীর সেলস ম্যান ও হীরন ভোমরা বন্দরে মিলন নামের এক ব্যক্তির ফার্মে কাজ নেয়। মহাজন ও এনজিও থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে ছয় মাস আগে বাবা ও দু’ ভাই মিলে আরতিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের ভেলোর সিএমসি হাসপাতালে পাঠায়। সেখানকার ডাক্তাররা পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে জানান, ক্যান্সার নয় আরতির বন টিবি ধরা পড়েছে। অপারেশন ছাড়াই দীর্ঘ মেয়েদী চিকিৎসায় সেরে যাবে। সেখান থেকে ফিরে তিন মাস বাড়িতে ঔষধ খায় আরতি।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বাবার সঙ্গে আবারো ভোলোরে যায় সে। এবার ডাঃ ভৃষ্ণা মাধুরি তাকে পরীক্ষা করেন। আগামি তিন মাস পরে আর একবার আসতে পারলে সে ভাল হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেন আরতিকে। একথা শোনার পর আরতি আবারো এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারবে বলে তার মনের মধ্যে আশার আলো জাগে। পড়াশুনা করে একটি কাজ নিয়ে বাবা ও ভাইদের ঋণের আংশিক পরিশোধ করবে। এমতাবস্থায় গত ৩ জুলাই বুধবার সন্ধায় বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসে সে।

বাড়ি ফিরে আরতি জানতে পারে ভাই কিরণ দাস মুসলিমদের বহু বিবাহ নিয়ে কটুক্তি করে নিজের ফেইস বুক আইডিতে স্টাটাস দিয়ে পরে নামিয়ে নেওয়ার ঘটনায় এক যুবলীগ নেতার থানায় অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ কিরণকে না পেয়ে হীরনকে জেলে পাঠিয়েছে। সেখান থেকেই পলাতক রয়েছে কিরণ। কিস্তির টাকা নিতে এনজিও কর্মীরা বাড়ি আসছে। টাকা না দিতে পারায় মাকে গালিগালাজ শুনতে হচ্ছে।

বৃহষ্পতিবার দুপুরে তাদের বাড়িতে গেলে বাবা , মা ও স্বজনদের উপস্থিতিতে ঘর থেকে ক্রেচে ভর দিয়ে উঠানে এসে আরতি এ প্রতিবেদককে আক্ষেপের সঙ্গে বলে, বড় ইচ্ছে ছিল পড়াশুনা করার। ধার পরিশোধের পাশাপাশি দু’ ভাই পড়াশুনা ও কাজ করে তাকে পড়াতে পারবে। আর বাবা ভ্যান চালিয়ে ঔষধ কেনার টাকা যোগাড় করবে। তা আর হলো কই?

দলিত পরিবারের সদস্য আরতি আরো জানায়, এক ভাই কিরণ ফেইসবুকে স্টাটাস দিলো, পরে তা নামিয়ে নিল। স্থানীয়রা বিষয়টি ভাল ভাবে মেনে না নেওয়ায় স্বপরিবারে সকলের হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া হলো কয়েকবার। তার পরও ক্ষমা মেলেনি। থানায় অভিযোগ, পরে মামলা। মামলায় কিরণের পরিবর্তে হীরনের হাজতবাস। এটা কোন সুস্থ গণতান্ত্রিক দেশে হতে পারে না। চার দলীয় জোট সরকারের সময় যেভাবে ঠুনকো কারণে হিন্দু শিক্ষক থেকে ছাত্রদের ইসলাম ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের ঠুনকো অভিযোগ এনে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকার ও বর্তমান সরকারের আমলে ফেইসবুকে ভুয়া একাউন্ট খুলে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে যশোর, গোবিন্দপুরসহ বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়েছে, লুটে নেওয়া হয়েছে তাদের সর্বস্ব ।তার প্রতিকার মেলেনি। এসবের পিছনে থাকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীদের মদত।

এ সময় সকল দলের নেতারা এক হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্তরা পরে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। একপর্যায়ে জন্মভূমির উপর জন্মানো ঘৃণা নিয়ে ছাড়ে দেশ। এ অবস্থা শুধু তাদের নয়, প্রতি মুহুর্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে তার পরিবারসহ আটটি দলিত পরিবারের। জেল থেকে বেরিয়ে হীরণ বা জামিন নিয়ে কিরণ যদি বাড়ি ফিরে আসে তাহলে তাদের নিরাপত্তা দেবে কে? বসত বাড়ি ও বাবার ভ্যান বিক্রি করে মহাজন ও সমিতির টাকা পরিশোধ করে কি রাতের আঁধারে তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চলে যেতে হবে! তাদের দেখাদেখি অন্য সাতটি পরিবারের কি নামমাত্র মূল্যে বা বাড়িঘর ফেলে দেশ ছাড়তে হবে? আমাদের এ দূঃখের কথা কি প্রধানমন্ত্রির কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না? তিনি কি পারেন না ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিয়ে এদেশে বসবাস করার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে?

আরতি এসব কথা বলার সময় তার জ্যেঠামহাশয় সন্তোষ দাস, জ্যাঠাইমা আলো দাসী, মা অঞ্জলী দাসসহ কয়েকজনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তারা বলে ওঠেন, এদেশে মন্দির ভাঙলে, মুর্তি ভাঙলে, সোনার বা কষ্টি পাথরের প্রতিমা চুরি করলে বিচার হয় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা, কালি, দুর্গাসহ দেবদেবীর বিরুদ্ধে যখন একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষ রাস্তা ঘাটে কুকথা বলে তখন কোন ধর্ম অবমাননা হয় না। বরং প্রতিকার করলে মার খেতে হয়। হিন্দু মেয়ে ও বৌদের কৌশলে বাড়ি থেকে বের করে এনে ধর্মান্তরিত করে উল্লাস প্রকাশ করা হলে তখন কিছু হয় না। সাধু সাবধান।

একদিন হয়তো হিন্দুরা এ দেশে থাকবেন না। থাকবে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা। তারা সন্তান উৎপাদনে যেভাবে ভূমিকা রাখছে তাতে আগামি কয়েক বছরেই তারা এদেশের কোন বিভাগকে তাদের জন্য ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানাবে সরকারের কাছে। যাওয়ার জায়গা না থাকায় অধিকার আদায়ে তারা হিংস্র হয়ে প্রতিনিয়ত ঘটাবে সংঘাত। বাংলাদেশের কোন কোন প্রান্ত প্রতিদিন হবে রণক্ষেত্র। পরাভূমিতে বসে আমরা হয়তো শুনতে পেয়ে বলবো, কেমন আছো সোনার বাংলার ভাইয়েরা!


লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী, সাতক্ষীরা।