নিউজ ডেস্ক : প্রাচীন ভারতের নালন্দা থেকে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের লাইসিয়াম হলো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি। আজ একুশ শতকে এসে অনেক কিছুর সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে সেই উচ্চশিক্ষার প্রথাগত ধারণা। দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে এ নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।

একটা সময় উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেতেন সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশের সদস্যরা। সময়ের পরিক্রমায় এই উচ্চশিক্ষার দরজাটা একপর্যায়ে খুলে যায় মধ্যবিত্তের জন্যও। কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোয় সরকার উচ্চশিক্ষার প্রসারে সমর্থন দিয়ে গেছে। সুযোগ কাজেও লাগিয়েছেন বহু ছাত্র। শুধু এই গ্রীষ্মেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতক পাস করে বেরোবেন ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী।

গোটা ইউরোপে সংখ্যাটা ৫০ লাখের মতো। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর চেহারাও অনেকটা একই রকম। এই দেশগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষার্থী। গত দুই দশকে চীনে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন তিন কোটি মানুষ। এত নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, এত এত শিক্ষার্থী। কিন্তু বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই চলছে সাবেকি ঢঙে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধরন-ধারণটা অ্যারিস্টটলের লাইসিয়ামের সঙ্গে তুলনীয়। একটা নির্দিষ্ট সময় তরুণ শিক্ষার্থীরা একটি জায়গায় একত্র হন। শিক্ষকেরা বলে যান, ছাত্ররা নিবিষ্ট মনে শোনেন।

কিন্তু এ অবস্থা কি চলতেই থাকবে? নাহ। এরই মধ্যে তার আভাস দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। উচ্চশিক্ষার ব্যয় বৃদ্ধি, চাহিদার পরিবর্তন আর প্রযুক্তির অচিন্তনীয় অগ্রযাত্রার কারণে প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে পরিবর্তন।

উচ্চ শিক্ষাপদ্ধতিতে যে কারণেই পরিবর্তন আসুক, এর ফলাফল হলো নতুন ধারার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম বা নতুন ধারার শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন।

ক্যাম্পাসের বাইরে, অনলাইনে: প্রথাগত উচ্চশিক্ষাটা ‘বোমলস ডিসিস’ থিওরির মতো। শ্রমঘন খাত, খরচ দিনকে দিন বাড়ছে। কিন্তু উত্পাদন বা যেটাকে ফলাফল বলা যায়, সেটার পরিমাণে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। গাড়ি, কম্পিউটারসহ আরও বহু জিনিসের দাম কমছে নাটকীয়ভাবে। কিন্তু সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ফি বাড়াচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থায় যে মারাত্মক কোনো পরিবর্তন আসছে, তা কিন্তু নয়।
সমীক্ষা বলছে, গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার ব্যয় বেড়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। এই হার দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি।

২০১২ সাল পর্যন্ত গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফি বেড়েছে ২৮ শতাংশ এবং এটি ক্রমশ বাড়ছে। ২০১২ সাল পর্যন্ত এর আগের পাঁচ বছরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ফি বাড়িয়েছে ২৭ শতাংশ। তাদের গড় ফি স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় আট হাজার ৪০০ ডলার। আর যাঁরা বাইরে থেকে এসেছেন তাঁদের জন্য ১৯ হাজার ডলারের বেশি। বেসরকারি কলেজগুলোতে টিউশন ফি গড়ে ৩০ হাজার ডলারেরও বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের মোট ঋণের পরিমাণ এক লাখ ২০ হাজার কোটি (১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন) ডলার। খেলাপির তালিকায় আছেন ৭০ লাখ শিক্ষার্থী।

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, এশিয়াতেও বাড়ছে টিউশন ফি। গত পাঁচ বছরে এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খরচ বেড়েছে ৫ শতাংশের মতো। এ ব্যয় বৃদ্ধি মধ্যবিত্তদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো উচ্চশিক্ষার খরচ কম রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ইউরোপের হালও একই। ১৯৯৮ সালে ব্রিটেনে টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছিল এক হাজার ৬৫০ ডলার। ২০১২ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৯০০ ডলারে।

বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিটা বিরাট ব্যাপার। উচ্চশিক্ষায় একধাপ এগিয়ে যাওয়ার অর্থ জীবনে এমনকি পাঁচ লাখ ৯০ হাজার ডলার পর্যন্ত বেশি আয় করার সুযোগ তৈরি হওয়া।

সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, একটা সময় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আর কলেজ থেকে স্নাতক পাস ছাত্রের জীবন-মানে পার্থক্য ছিল না বললেই চলে, কিন্তু ২০১০ সালনাগাদ দেখা গেল পার্থক্যটা প্রায় ২৭ শতাংশ। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছেন এবং শেষ পর্যন্ত লেখাপড়াটা শেষ করছেন না তাঁরা আকণ্ঠ ঋণে ডুবে যাচ্ছেন। ঋণের জালে আটকা পড়া ছাত্রদের সংখ্যাটা নেহাত কম না, যুক্তরাষ্ট্রে ৪৭ শতাংশ, ব্রিটেনে ২৮ শতাংশ। এসব রাষ্ট্রও কিন্তু আজকাল আর উচ্চশিক্ষা থেকে ঝরেপড়া ছাত্রদের দায় নিতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৭ থেকে ২০১২ এই পাঁচ বছরের ব্যবধানে ছাত্রপ্রতি সরকারের যে ব্যয় তা প্রায় ২৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে এসেছে। আর মূল্যস্ফীতির কারণে উচ্চশিক্ষার ব্যয় বেড়েছে ২০ শতাংশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের দ্বিতীয় কারণ শ্রমবাজার। যন্ত্রনির্ভরতা শুধু যে শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে ফেলছে তা-ই নয়। একই রকম প্রভাব পড়তে শুরু করেছে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাজের ক্ষেত্রেও। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একটি সমীক্ষা বলছে, আগামী কয়েক দশকে যন্ত্রনির্ভরতার দরুন ৪৭ শতাংশ পেশা ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে।

(ওএস/এটিঅার/জুলাই ২৯, ২০১৪)