সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) : নেত্রকোনার কেন্দুয়া পৌর এলাকার বাদে আঠারোবাড়ি মহল্লার মা হাওয়া (আঃ) কওমী মহিলা মাদ্রাসার সেই মোহ্তামিত (প্রধান শিক্ষক) মাওঃ আবুল খায়ের বেলালীর বিরুদ্ধে একই মাদ্রাসার দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে ধর্ষিতা এক ছাত্রীর বাবা ও অপর ছাত্রীর চাচা বাদী হয়ে কেন্দুয়া থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। শনিবার সকালে দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বেলালীকে নেত্রকোনা আদালতে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে দুই ছাত্রীকে ধর্ষন সংক্রান্ত ডাক্তরী পরীক্ষার জন্য নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়।

কেন্দুয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান শনিবার জানান, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে প্রধান শিক্ষক আবুল খায়ের বেলালীর মুখ থেকে বেড়িয়ে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর গোপন তথ্য। গত এক বছরে ওই মাদ্রসার মোহ্তামিম (প্রধান শিক্ষক) আবুল খায়ের বেলালী আরো ৬ ছাত্রীকে যৌনহয়রানী ও ধর্ষনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। আবুল খায়ের বেলালী পুলিশকে জানায় ওই মাদ্রসার ছাত্রী সংখ্যা ৩৫ জন এর মধ্যে আবাসিক ১৫ জন।

মহিলা মাদ্রাসার একটি কক্ষেই আবুল খায়ের বেলালীর শয়ন কক্ষ তৈরি করেছিলেন। যখনই মনে চাইত তখনই তার শয়ন কক্ষে গিয়ে কলিংবেল চাপতেন। তখন ছাত্রীরা সেখানে গেলে একজন ছাত্রীকে রেখে তাকে দিয়ে তার হাত-পা টিপাতেন। এক পর্যায়ে ঝাপটে ধরে তার মনোবাসনা পূর্ন করতেন। আবার সঙ্গে সঙ্গেই ওই ছাত্রীর মাথায় পবিত্র কোরআন শরিফ তুলে দিয়ে কসম কাটাতেন, যাতে ওই ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রীর পক্ষ থেকে কারো কাছে প্রকাশ না করা হয়। প্রকাশ করলে আল্লাহ তায়ালার দরবারে ওই ছাত্রীকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। এ ভয়ের কারনে এতদিন কোন ছাত্রীই প্রধান শিক্ষক মোহ্তামিম আবুল খায়ের বেলালীর অপকর্মের কথা কারো কাছে প্রকাশ করেনি।

গত ৫ জুলাই শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে আবুল খায়ের বেলালী তার শয়ন কক্ষে গিয়ে কলিংবেল চেপে এক ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে ধর্ষন করে। ওই ছাত্রীর চিৎকারে ছাত্রীটির বড়বোন ও অন্যান্য ছাত্রীরা সেখানে ছুটে গিয়ে বেলালীর কবল থেকে তাকে উদ্ধার করে। পরে তারা ঘটনাটি তাদের অভিভাবকদের কাছে জানায়। অভিভাবক ও স্থানীয়রা ঘটনাটি জেনে ক্ষিপ্ত হয়ে মোহ্তামিম আবুল খায়ের বেলালীকে গণপিঠুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। গণধোলাইয়ের পর আবুল খায়ের বেলালী মঙ্গলবার একই কায়দায় ওই মাদ্রাসার আরেক ছাত্রীকে ধর্ষণ করার কথা স্বিকার করে। ধর্ষনের পর তার হাতেও কুরআন শরিফ তুলে দিয়ে ধর্ষনের ঘটনা প্রকাশ না করার জন্য কসম কাটায়।

যদি অন্য কারো কাছে ওই ঘটনা প্রকাশ করে তাহলে ওই ছাত্রীটিকে দোযখের আগুনে পুড়তে হবে বলে ভয় দেখায়। নেত্রকোনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া আবুল খায়ের বেললীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং মাদ্রসা পরিদর্শন করে কলিংবেলটি উদ্ধার করেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের জিজ্ঞাসাবাদে বেলালী অকপটে তার অপকর্মের কথা স্বীকার করেছে।

এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, গত এক বছরে এই দুইজন ছাত্রী ছাড়াও আরো ৬ জন ছাত্রীকে কলিংবেল চেপে তার শয়ন কক্ষে নিয়ে যৌন হয়রানী ও ধর্ষন করে। ধর্ষনের পর পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ হাতে তুলে দিয়ে ছাত্রীদেরকে দিয়ে কসম কাটায়। যাতে ওই ধর্ষনের ঘটনা আর কারো কাছে প্রকাশ না করে। প্রকাশ করলে আল্লাহ তায়ালার দরবারে ছাত্রীদেরকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে বলে ভয় দেখায়।

আঠারোবাড়ি গ্রামের ছাত্রী অভিভাবকদের পক্ষে কেন্দুয়া বাজারের ব্যবসায়ী ফরিদ আলম তালুকদার বলেন, যে আদর্শ ও বিশ্বাস নিয়ে মা হাওয়া (আঃ) কওমি মহিলা মাদ্রসা প্রতিষ্ঠা করে শিশু মেয়েদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য মাদ্রসায় দেয়া হয়েছিল, শুক্রবার সকালের ছাত্রী ধর্ষনের ঘটনা প্রকাশের পর সব মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়। প্রত্যেকেই তাদের শিশু ছাত্রীদেরকে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, আমরা সমস্ত গ্রামবাসী আবুল খায়ের বেলালীর ফাঁসির দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছি।

খোকন ডিলার নামে ওই গ্রামের অপর ছাত্রী অভিভাবক বলেন, শিক্ষক বেললীর বিরুদ্ধে ছাত্রী অভিভাবদের অনেক অভিযোগ ছিল। তিনি নিজের মতো আইন করে ওই মাদ্রাসা চালাতেন। মাদ্রাসার ভেতর কোন ছাত্রী অভিভাবককে ঢুকতে দেয়া হতোনা। তাদেরকে বুঝানো হতো এখানে আসলে কথা বললে ছাত্রীদের লেখা পড়ার ক্ষতি হবে।

তিনি বলেন, তার মতিগতি বুঝে ঘটনার একদিন আগেই আমি আমার এক ছাত্রীকে ওই মাদ্রাসা থেকে নিয়ে যাই। আমরা গ্রামের সকলেই এই ঘটনার নিন্দা জানাই এবং বেলালীর ফাঁসি দাবী করি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কেন্দুয়া থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, আদালতে বেলালীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন না হলে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

(এসবি/এসপি/জুলাই ০৬, ২০১৯)