প্রবীর সিকদার

টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার পংবাইজোড়ার আলহাজ রমজান আলী মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিনদ চন্দ্র সরকার, যার নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই অবৈধ ও বিতর্কিত। তিনি প্রধান শিক্ষক পদে ওই বিদ্যালয়ে কাজে যোগদান করেন ১৮ অক্টোবর ২০১৬।

অথচ বিদ্যালয়ের ঘষামাজা তথ্য জানান দেয়, ওই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য হলে ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর দৈনিক যায় যায় দিনে আবশ্যক বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। সেবার প্রধান শিক্ষক পদে ৫ জন শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হন আজিজুর রহমান নামের একজন শিক্ষক। সেই নিয়োগ পরীক্ষায় বিনদ চন্দ্র সরকার অংশও নেননি। আজ যিনি এই বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অর্থাৎ আবু বকর সিদ্দিক তথা এ বি সিদ্দিক, তখন তিনিই সভাপতি ছিলেন। তখন সভাপতি এ বি সিদ্দিক গায়ের জোরে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়া আজিজুর রহমানকে নিয়োগ দেননি। ওই সময়ের বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির ৪ সদস্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ডি জি বরাবর লিখিত ভাবেই অভিযোগ করেছিলেন, সভাপতির দাবীকৃত মোটা টাকা দিতে সম্মত না হওয়ায় নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হয়েও প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পাননি আজিজুর রহমান। সভাপতি কমিটির অন্য সদস্যদের তোয়াক্কা না করে সেই নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল দেখিয়ে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল দৈনিক যুগান্তরে আবার প্রধান শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর বিদ্যালয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়; একদিকে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা সভাপতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, আরেক দিকে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়া আজিজুর রহমান আদালতে মামলা দায়ের করেন। ফলে সভাপতি বিপাকে পড়ে যান। তখন চতুর সভাপতি এ বি সিদ্দিক রাজনৈতিক ছলাকলার আশ্রয় নিয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিবাদী সদস্যদের ও প্রধান শিক্ষক পদে প্রথম হওয়া আজিজুর রহমানকে অন্যায় চাপ প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় করেন এবং অভূতপূর্ব জালজালিয়াতির মাধ্যমে মোটা টাকার বানিজ্য করে প্রধান শিক্ষক পদে বিনদ চন্দ্র সরকারকে নিয়োগ দেন। বহুল বিতর্কিত নিয়োগপত্র পেয়েই বিনদ সরকার ১৮ অক্টোবর ২০১৬ কাজে যোগ দেন।

প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দিয়েই বিনদ চন্দ্র সরকারের নিজের নিয়োগ পেতে বিনিয়োগ তুলে আনতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি! ২০১২ সালের ২৪ জুন বিদ্যালয়ে সহকারি গ্রন্থাগারিক পদে যোগ দিয়েছিলেন মোহাম্মদ মজিবর রহমান। ওই সময়ে এই মজিবর রহমান সুদামপাড়া লুতফিয়া দাখিল মাদ্রাসার অফিস সহকারি ছিলেন। তিনি মাদ্রাসা থেকেও সরকারি বেতন তুলতেন, আবার আলহাজ রমজান আলী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি গ্রন্থাগারিক পদেও চাকুরি করতেন! বিষয়টি জানাজানি হলে এক পর্যায়ে তিনি সহকারি গ্রন্থাগারিক পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। বিদ্যালয় কতৃপক্ষ সহকারি গ্রন্থাগারিক পদে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও দৈনিক মজলুমের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। কিন্তু বিনদ বাবু বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েই মোটা টাকা, মতান্তরে ৭ লাখ টাকায় রফা করে রাতারাতি পদত্যাগী সহকারি গ্রন্থাগারিক মজিবুর রহমানকে অভাবনীয় দুষ্ট ও নষ্ট কৌশলে স্বপদে তথা সহকারি গ্রন্থাগারিক পদে ফিরিয়ে আনেন! বহাল রাখা হয় ২০১২ সালের ২৪ জুন তার কাজে যোগদান করার তারিখটি। খাতা পাল্টে পুরনো কয়েক বছরের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন মজিবর রহমান! ওই বছরগুলোতে মজিবর রহমান মাদ্রাসা থেকেও সরকারি বেতন তুলেছেন!

আলহাজ রমজান আলী মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের তহবিল নিয়েও নয়ছয়ের অভিযোগ কম নয়! পাশের একটি বিদ্যলয়ের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে এই বিদ্যালয়ে ছাত্রী ভর্তি বন্ধ রাখা হয়েছে বহুদিন! রহস্যজনক কারণে ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন আদায় করা না হলেও বিদ্যুৎ বিলের নামে ছাত্রদের কাছ থেকে প্রতিমাসে আদায় করা হয় মোটা টাকা। বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে ফোন কোম্পানির দুটি টাওয়ার। সেই টাওয়ার ভাড়ার বিশাল টাকা কিংবা ছাত্রদের কাছ থেকে আদায় করা বিদ্যুৎ বিলের মোটা টাকা কোন খাতে কিভাবে খরচ করা হয়, সেটা প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি ছাড়া জানে না আর কেউ! অথচ বছরের পর বছর বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারীদেরকে বিদ্যালয় অংশের বেতন থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। টু-শব্দটি করবার সাহস দেখান না আর কেউ! এ যেন আজব এক সভাপতি এ বি সিদ্দিক ও জবর এক প্রধান শিক্ষক বিনদ চন্দ্র সরকারের ভানুমতির খেলা চলছে বিদ্যালয়টিতে! এসব গুরুতর অন্যায়ের প্রমাণ রয়েছে স্কুলের কিংবা সরকারি নথিপত্রেই! কে আর সেটা ঘাটতে গিয়ে পকেটে বাণ্ডিল বাণ্ডিল টাকা ঢোকানোর পাকাপাকি রাস্তা বন্ধ করতে চান! এমন 'আহম্মক' কী আর আছে কেউ!

প্রিয় পাঠক, 'আহম্মক' খুঁজতে আমাদের আর বেশি দূরে যেতে হবে না! আলহাজ রমজান আলী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়েই আছেন এমন একজন 'আহম্মক'! নাম তার গৌরাঙ্গ চন্দ্র দত্ত। তিনি বিদ্যালয়ের সিনিয়র বিজ্ঞান শিক্ষক। এলাকায় ভালো শিক্ষক ও সৎ মানুষ হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। তিনি যেহেতু ভালবাসেন বিদ্যালয়কে, ভালবাসেন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের, সেই দায়বদ্ধতা থেকেই প্রধান শিক্ষক কিংবা সভাপতি, যেই অনিয়ম অন্যায় দুর্নীতি করেন, অসঙ্গতিকে নিয়ম নিয়ম হিসেবে মানতে বাধ্য করানোর অপচেষ্টা করেন, তখনই প্রতিবাদে সোচ্চার হন শিক্ষক গৌরাঙ্গ দত্ত। এই প্রতিবাদ তার সহজাত। অপকর্মের ঢেঁকি প্রধান শিক্ষক কিংবা দাপুটে সভাপতির উচ্ছিষ্ট ভোগের আহবান যিনি দুই পায়ে মাড়িয়ে বিদ্যালয়ের স্বার্থ রক্ষাকেই যে গৌরাঙ্গ ব্রত বলে মনে করেন, তাকে এই যুগে 'আহম্মক' ছাড়া আর কী বলবো আমরা!

বিদ্যলয়ের অনিয়ম দুর্নীতি অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলেন গৌরাঙ্গ। আর এতেই ক্ষিপ্ত বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক বিনদ চন্দ্র সরকার ও তার মাথার ছাতা সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক তথা এ বি সিদ্দিক। কয়েক বছর ধরেই গৌরাঙ্গকে নানা ভাবে হয়রানি করছেন তারা। কখনো গায়ের জোর দেখিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে না দিয়ে, কখনো বা আইন বহির্ভূতভাবে বেতনের টাকা কর্তন করে। নির্যাতনের শিকার শিক্ষক গৌরাঙ্গ তার উপর নেমে আসা অন্যায় নিপীড়নের প্রতিকার চেয়ে শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজিসহ ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের আবেদনও করেছেন। নাগরপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামান ঘটনার তদন্তে ওই বিদ্যালয়ে যাবেন আগামী ৯জুলাই। এই তদন্তের খবর পেয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ও সভাপতি। ওই তদন্ত ঠেকাতে তারা গত ২ জুলাই বিদ্যালয়ে জরুরি সভা ডেকে কোনও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অন্যায়ের প্রতিবাদকারী শিক্ষক গৌরাঙ্গ চন্দ্র দত্তকে সাসপেন্ড করেন। সৎ ও সাহসী শিক্ষক গৌরাঙ্গ চন্দ্র দত্ত প্রধান শিক্ষক বিনদ চন্দ্র সরকার ও সভাপতি এ বি সিদ্দিক চক্রের চাপ ও হুমকিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বিদ্যালয়, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য ক্ষতিকর সকল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ জারি থাকবে; কোনও অবস্থাতেই তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবেন না। তিনি দাপ্তরিক বিচারের জন্য লড়বেন, প্রয়োজনে নামবেন আইনি লড়াইয়েও।

যখন চলছে অমানুষের মহামারি, এমন একটি সময়ে দাঁড়িয়ে স্রোতের বিপরীতে যার লড়াই, তেমন একজন গৌরাঙ্গ দত্তকে স্যালুট জানানো এবং অনাগত আরও গৌরাঙ্গের জন্য আগাম স্যালুট জানানো ছাড়া আমার কী আর কোনও উপায় থাকে! কেননা এই অজানা অচেনা গৌরাঙ্গরাই তো একদিন আঁধার তাড়িয়ে আলোয় ভরিয়ে দিবেন দেশ, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ।