চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ঐতিহ্যবাহী গুমান মর্দ্দন পেশকারহাট বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের  পরিচালনা পর্ষদের সদ্য সাবেক সভাপতি এসএম নুরুল আবছারের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। 

কয়েকমাস ধরে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে চলছে রীতিমত যুদ্ধ। এজন্য স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে পদ প্রত্যাশীরা সবাই দৌঁড়াদৌঁড়িতে ব্যস্ত। এই অস্থিরতার মধ্যে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।

এলাকাবাসীর পক্ষে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের আজীবন দাতা সদস্য মো. জামাল উদ্দীন ও সাবেক সদস্য মো. আলী খাঁন বিগত বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির নিয়ম বহির্ভূত কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে স্থানীয় হাটহাজারী মডেল থানা, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক ও ঢাকা শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

ভিন্ন ভিন্ন তারিখে ভিন্ন ভিন্ন দফতরে দাখিলকৃত অভিযোগে, নিয়ম ভেঙ্গে একাধিকবার এসএম নুরুল আবছার’কে পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদ লাভ, বাৎসরিক বাজেট অনুমোদন ব্যতীত বিদ্যালয়ের আয় ব্যয়ে গড়মিল হিসাব প্রদান, অবসর গ্রহণ করার পরও প্রধান শিক্ষককে স্বপদে বহাল রাখা, সুবর্ণ জয়ন্তীর নামে অর্থ উত্তোলন ও আত্মসাৎ, বিদ্যালয়ে জমানো তহবিল আত্মসাৎ, বিদ্যালয় মাঠ ভরাট ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণের নামে অর্থ লোপাটসহ প্রধান শিক্ষকের যোগসাজসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায়ের মতো গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে।

এছাড়াও গুমান মর্দ্দন পেশকারহাট বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ে নিয়মিত অভিভাবক সভা ও সমাবেশ না করা, যথাযথ মর্যাদায় ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদত বার্ষিকী পালন না করা, বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় শোক দিবসে অনুপস্থিত থাকার মতো অভিযোগ ও রয়েছে।

জানা যায়, গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর এডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে সমালোচিত এসএম নুরুল আবছারকে শিক্ষাবোর্ড দায়িত্ব দিলে শিক্ষিত সমাজ ও অভিভাবকদের মাঝে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।
এলাকাবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে পরে চট্টগ্রাম-৫ আসনের স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রীর (ডি.ও নং পবম/মন্ত্রী/ডি.ও/২০১৮/৭১৪ নং স্মারক) লিখিত সুপারিশে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিলে এস.এম নুরুল আবছার’কে সরিয়ে পদাধিকারবলে বলে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা’কে এডহক কমিটির সভাপতি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিন যাবৎ এমন পরিস্থিতি চলতে থাকায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। বর্তমানে সাবেক সভাপতি দেশের বাহিরে থাকলেও পুনরায় কলাকৌশলে এ পদে বসার জন্য লবিং করছে বলে জানা যায়।

এ প্রসঙ্গে গুমান মর্দ্দন ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম মানিক বলেন, সাবেক সভাপতি এসএম নুরুল আবছারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া গেলেও কি কারণে তদন্ত রির্পোট দেয়া হয়না সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্তের আবেদন করছি।’

ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে দাতা সদস্য মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘পুর্ব ম্যানেজিং কমিটির অনিয়ম দূর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে মেয়াদ শেষে তড়িগড়ি করে আবারো এডহক কমিটি গঠন করে বহু বিতর্কিত সাবেক সভাপতি এসএম নুরুল আবছারকে সভাপতি দিলে জনগণের দাবির মূখে তা বাতিল করে। আর এসব অপকর্ম ধামাচাপা দিতে কৌশলে যে কোন উপায়ে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে আবারো সভাপতি হতে মরিয়া তিনি। এ বিষয়ে স্কুল রক্ষায় আমি শিক্ষা মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুজা উদ্দিনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারী মাস থেকে এডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন হাটহাজারী ইউএনও মহোদয়। পুর্বের নানা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার একটি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন তাতে কোন অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়নি।’

প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে , ২০১৫ সালে বিধি অনুযায়ী গঠিত ম্যানেজিং কমিটি গঠনের লক্ষ্যে কোন বৈধ নির্বাচনই হয়নি। কাগজপত্রে কমিটিকে নির্বাচিত দেখানো হয়েছে। তাছাড়া তারা আইন ও বিধির তোয়াক্কা না করে কমিটি নির্বাচনের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং কোন প্রকার ভোটার তালিকা প্রনয়ণ ও প্রকাশ করেনি। এজন্য কমিটির যাবতীয় অনিয়ম বন্ধে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট মামলাও করা হয়েছে। মামলাটি করেছেন দাতা সদস্য মো. জামাল উদ্দিন।

মজার বিষয় হলো তৎকালীন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তার উননেছা শিউলীর আদেশে অভিযোগ তদন্তে নিয়োজিত মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিউল আজম এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (চট্টগ্রাম) এর চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম এর আদেশক্রমে কমিটি সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মো. আলী আকবরকে নির্দেশ দিলেও কোন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি দীর্ঘ এক বছরেও । এ বিষয়ে তারা মুখ খুলতেও নারাজ।

হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম রাশেদুল আলম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গুমান মর্দ্দন উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি ও ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ পেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উপজেলা প্রশাসনকে বিষয়টি একাধিকবার জানানো হয়েছে।’

বিধিমালায় উল্লেখ রয়েছে ‘স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক সদস্য হতে হলে তার কোন শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ে নিয়মিত অধ্যয়নরত হতে হবে।’ কিন্তু কমিটির সভাপতি হওয়ার সময় এসএম নুরুল আবছারের কোন শিক্ষার্থী এই স্কুলে ছিল না। এ বিষয়ে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি দেশের বাহিরে থাকায় তার কোন বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

স্থানীয়রা দাবি জানিয়েছেন, অভিযোগের সার্বিক বিষয় তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির নির্বাচন স্থগিত রাখা। পুনরায় তড়িগড়ি করে উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে একইভাবে বিতর্কিত ব্যক্তিরা সভাপতি পদে বসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে ব্যস্ত হবেন বলে ধারণা করছেন অনেকেই।

এছাড়াও পরিচালনা পরিষদের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ আলী খাঁন অভিযোগ করে বলেন, গুমান মর্দ্দন পেশকারহাট বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়ম পরিলক্ষিত এবং অনৈতিকভাবে একই পরিবারের ৪জনকে কৌশলে দাতা সদস্য করে এসএম নুরুল আবছার তৃতীয় বার সভাপতি হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।’

অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুহুল আমিন বলেন, গুমান মর্দ্দন পেশকারহাট বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও ভোটার তালিকা বিষয়ে নানা অভিযোগ পেয়েছি। আমরা স্কুলটিতে একটি গণশুনানি করব, তারপর ভোটার তালিকা হালনাগাদ করব, যদি কারো কাছে অনিয়মের প্রমান থাকে তা তিনি উপস্থাপন করতে পারবেন। কারো পক্ষে বা বিপক্ষে নয়, নিরপেক্ষ বিধিসম্মত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস কোন তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে হাটহাজারী ইউএনও বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে কোন তদন্ত কমিটি দেওয়া হয়নি যদিও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস তদন্ত করে থাকে তবে সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়, আমার নয়।’

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘স্থানীয়দের কাছ থেকে পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে তখনই বোর্ড চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছি বিধি সম্মত ব্যবস্থা নিতে।

(জেজে/এসপি/জুলাই ০৮, ২০১৯)