প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

দরজা খুলে দিয়ে ‘স’ চমকে গেল ভীষণভাবে! নিরাভরণ সুতির একটি শাড়ি পরা। দীর্ঘ কালো চুল, খোলা। প্রসাধনহীন মুখ, মেঘলা রঙের পুরু ঠোঁট হঠাৎ তার এই অনভ্যস্ত সৌন্দর্য দেখে আমার অসম্ভব ভালো লেগে গেল। মনে হলো যেন এখনই বৃষ্টি নামবে। আবার পিন্টুর একটা গান মনে পড়ে গেল, ‘এখন ঝড় উঠুক / শুধু মেঘ করুক / বৃষ্টি চাইবো না / আমি আর কাঁদবো না....।’

সমস্ত মুখে হাসি ছড়িয়ে বললো, ‘আসুন, আসুন।’ সাজানো গোছানো চমৎকার ড্রয়িংরুম, বললো, ‘বসুন।’ আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বসলাম। ঘরের এক কোণে রঙিন টিভি। স্বপনই বলেছিল বড়বোন বিদেশ থেকে এনেছে। এই শহরে তখন মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি টিভি আছে তাও সাদাকালো। চট্টগ্রাম নিউমার্কেটে একটি রঙিন টিভি একদিন দেখেছিলাম। তারপর এই দ্বিতীয়বার দেখলাম।

সে টিভিটা ছেড়ে দিয়ে ভিতরে গেল। ঘরটা রঙিন আলোয় ভরে গেল। তবে অত সুন্দর রং নয় গ্রোগ্রামগুলোর। কিছুক্ষণ পরেই ‘স’ তার মাকে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিল। বেশ বয়স হয়েছে তাঁর। সাদা শাড়ি পরা। ধবধবে ফর্সা। মাথার চুল সাদাকালো। দীর্ঘ শরীর। এককালে খুব সুন্দরী ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি তাঁর পা ধরে প্রণাম করলাম। তিনি আশীর্বাদ করলেন। বললেন, ‘তুমিই পটু? সেদিন তোমার আসার কথা ছিল আমাদের বাসায়, এলে না যে? তুমি নাকি চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পড়ো ‘স’ বললো। লেখালেখিও করো নাকি। ভালো খুব গুণ। ওকে ইতিহাসটা গাইড করো তো বাবা। তুমি কিন্তু আসবে সময় পেলেই। স্বপন না এলেও তুমি আসবে।’

বুঝতে পারলাম অনেক দূর পর্যন্ত ‘স’ আমাকে নিয়ে এগিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর হাসিঠাট্টা হৈচৈ করতে করতে আরও দুটি মেয়ে এলো ঘরে সঙ্গে একটি ছোট ছেলে। সবাই ‘স’র ভাইবোন। পরিচয় হলো, তারপর ওরা টিভি দেখতে লাগলো। ‘স’র মা খালাম্মা, ‘তোমরা গল্প করো’, বলে ভিতরে চলে গেলেন সঙ্গে ঐ তিন ছেলেমেয়েকেও নিয়ে গেলেন। স্বপন বলেছিল ‘স’র বাবা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। সবচেয়ে বড়বোন এখন ঢাকায়। তার পরের বোন কুমিল্লায়, স্বামী নাকি ইঞ্জিনিয়ার। এরপর ভাই কুমিল্লায় থাকেন। তার পরের বোনটি স্বামীসহ বিদেশে। এরপর ‘স’।

এতটা আপন করে নেবেন খালাম্মা ভাবিনি। খুবই আধুনিক, রুচিশীল এবং উদারমনস্ক পরিবার দেখে আমার আরও ভালো লাগলো ‘স’কে। স্বপন ভিতরে চলে গেল আড্ডা দিতে। উচ্চকন্ঠের কথাবার্তা, হৈচৈ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমাকে বললো, ‘চুপ করে আছেন কেন?’ ‘কি বলবো? আপনিই বলুন আমি শুনি।’ ‘আমার কথা শুনতে ভালো লাগবে? আমি কিন্তু সরাসরি কথা বলতে ভালোবাসি। রাখঢাক করি না।’

বলেই মুখ টিপে হাসলো। ‘তাই তো দেখছি। বলুন ভালো লাগতেও তো পারে।’ ‘তাই। খুশি হলাম।’ এমন সময় একটি মহিলা ট্রেতে করে নুডলস, চানাচুর ও চা দিয়ে গেল টেবিলে। নুডলসের প্লেটটি আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘লজ্জা করবেন না। মনে করুন এটা আপনার নিজের বাড়ি। আমরা সবাই খুব খোলামেলা। আপনার কিছু ছড়া পড়লাম। প্রকৃতিভিত্তিক ছড়াগুলো চমৎকার লেগেছে। বড়দের জন্য গল্প লিখুন না ?’

এই প্রথম কোনো মেয়ে পাঠকের প্রশংসা শুনে আমার সত্যি মনটা দুলে উঠলো। উৎসাহবোধ করলাম। এবং বাসায় ফিরে সে রাতে বেশ কয়েকটি ছড়া লিখেছিলাম, পরে দেখিয়েওছিলাম। ধন্যবাদ দিলাম ‘স’কে। বললো, ‘আপনার প্রিয় কবি কে বলুন তো? আমার আবুল হাসান।’ ‘আমি কবিতা ভালোবাসি তবে কব্যিক গান খুব বেশি পছন্দ করি।’ আমি বললাম। ‘গান! সত্যি? লাফিয়ে উঠলো ‘স’, উফ্ গানের পাগল আমি! নিজে গাইতে পারি না তো তাই হয়তো......।’ আমি বললাম, ‘তবে আধুনিক বাংলা গানই শুনি বেশি। রবীন্দ্র, নজরুল, অতুল প্রসাদ তো অন্য রকমের গান। সেসব একটা সময় করে শুনি।’ ‘আধুনিক গানের মধ্যে কার গান সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে বলুন না প্লীজ!’ ‘যেমন ধরুন দ্বীজেন, সুবীর, তরুণ, জটিলেশ্বর, মানবেন্দ্র, সুজাতা, আরতী, শিপ্রা, সুমন কল্যাণপুর.......।’ আমার উত্তর। ‘স’ শুনেই দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে ফেললো। সমস্ত চুল উপচে এসে ঢেকে ফেললো তাকে।

কয়েক মিনিট পর স্বাভাবিক হয়ে বসলো। চোখ দুটো ছলছল করছে। বললো, ‘আর বলতে হবে না। মাই গড্! আই অ্যাম ভেরি মাচ শক্ড!’ আমি তো অবাক তার এই হঠাৎ আচরণে! বললাম, ‘সরি। আপনি হয়তো এঁদের গান পছন্দ করেন না। কিন্তু.....।’ মাথা নেড়ে নেড়ে বললো, ‘না না না। একদম না। কী করে বোঝাবো আপনাকে! এদের গান নিয়েই আমার প্রতিদিনের জীবন। অনেকেই এঁদের গান শুনেছে বলে জানা নেই। যারা শোনে খুব কমই শোনে। কী অসাধারণ ব্যতিক্রমধর্মী গান! কীভাবে যে লেখা হয়েছে, সুর করা হয়েছে, শিল্পীরা গেয়েছে ভাবতেই পারি না! সত্যি কথা বলতে কী আপনাকেই এই প্রথম দেখলাম যে এঁদের গানের একজন রেয়ার ফ্যান! উফ্ সুমন কল্যাণপুরের প্রত্যেকটি উদাসী গান, শ্রিপার আকুল কন্ঠস্বর, দ্বীজনের রোমান্টিসিজম, সুবীরের নস্টালজিয়া কী বলবো!

সর্বক্ষণ আমাকে অস্থির করে রাখে।’ এবার আমি স্বস্তি পেলাম এবং ভেবে অবাকও হলাম: তাহলে আমরা কি একই পথের যাত্রী? ‘স’ সত্যি সত্যি চিকন সুরে গেয়ে উঠলো, সুমন কল্যাণপুরের গান, ‘পায়ের চিহ্ন নিয়ে/ পড়ে থাকা পথটা যার / তার আসার দিনের কথা / লেখা আছে বুঝি.......।’ সেদিন আরও কত যে আলাপ হলো দুজনের মধ্যে। এমন একটি সন্ধেবেলা চিরদিনের জন্য উজ্জ্বল ফুল হয়ে ফুটে রইলো। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। খালাম্মা শেষ পর্যন্ত খাইয়ে ছাড়লেন। ‘স’র বড়ভাই ফিরলে পরে তাঁর সঙ্গেও আলাপ হলো। দারুণ সুদর্শন, স্মার্ট একজন মানুষ, চমৎকার হাসিখুশি মজলিশী ব্যক্তিত্ব। ‘স’ বাসার ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিলে বললো, ‘আবার আসবেন কিন্তু।’ তারপর কানের কাছে নিচুস্বরে যা বললো তাতে স্মম্ভিত হয়ে গেলাম আমি! ‘স’ বললো, ‘কেন যে দেখা হলো? না হলেই ভালো ছিল।’

এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল ‘স’ আমাকে জাপান আসা পর্যন্ত তা ব্যাখ্যা করা দুঃসাধ্য। কেউ কেউ জানলো, অনেকেই জানলো না। কেউ কেউ বুঝলো, অনেকেই বুঝতে পারলো না আমাদের সম্পর্ককে। কত শত স্মৃতি তার সঙ্গে আমার কোনটা ছেড়ে কোনটাকে স্মরণ করি! তার প্রদত্ত কত উপহারে আমার ছোট্ট ঘরটি ভরে উঠেছিল। কত টাকা যে তার কাছ থেকে নিয়ে নেশার আগুনে ছাই করে দিয়েছি হিসেব নেই! কত মান অভিমান, হাসিঠাট্টা, কান্না-বেদনার সাক্ষী শুধু আমরা দুজনই। কত জায়গায় যে ঘুরেছি। দুদিন পর পরই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যেতো নানা কারণে। আগেই বলেছি এরশাদের আমলে শিক্ষা ব্যবস্থাটাই লাটে উঠেছিল। আমি শুধু তারই টানে চলে আসতাম কুমিল্লায়। আমাদেরও নানা স্থানে বাসা বদল করতে হয়েছে। মা দারুণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। মাঝেমাঝে ‘স’ আসতো আমাদের বাসায় আমি না থাকলেও। মা যথেষ্ট আদরযত্ন করেছে। মাও মেয়ে মানুষ সবই টের পেয়েছিল বা কোনো উৎস থেকে শুনেছিল।

সেভাবে বাবার কানেও। বাবা কিছু না বললেও বুঝতো আমার মানসিক অবস্থা। একবার তো পার্কেই বিকেলবেলা বাবার চোখে পড়ে গিয়েছিলাম আমরা দুজন। বাবা অবশ্য না দেখার ভান করেছিল। ‘স’ তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা তুলে মুখ আড়াল করেছিল। এত কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম আমরা যে হয়তো বিপদজনক সীমা অতিক্রম করতে আর বেশি বাকি ছিল না। আমার এখনো মনে পড়ে সেকেন্ড ইয়ারের কথা। সাবসিডিয়ারি পরীক্ষার পর আমার পুরুষাঙ্গের অপারেশন হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই পেটের অসুখের কারণেই আমার প্রস্রাবের পথেও জটিলতা দেখা দিয়েছিল। বেশ কষ্ট হতো। আর অতিরিক্ত ডোব করার কারণে শারীরিক অবস্থার খুব অবনতি হয়েছিল।

কুমিল্লায় এসে মাকে বললে পরে মা-ই পরিচিত ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে অপারেশনের ব্যবস্থা করেছিল। তখন ‘স’ প্রতিদিন আমাকে দেখতে আসতো। কে কি বলছে ভ্রুক্ষেপও করেনি। এক সপ্তাহ থাকতে হয়েছিল হাসপাতালে তখন রচিত ‘সেই ঘরে সুন্দর’ নামে একটি ক্ষুদ্র কাব্যগ্রন্থ আছে আমার। সেখানে ১৪টি কবিতা আছে যেগুলো তাকে নিয়েই লিখেছিলাম। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কবি বাবুল ইসলাম, প্রকাশ করেছিল আজকাল প্রকাশনী থেকে স্বপন সেনগুপ্ত। তখন একটা চমৎকার সৃজনশীল সময় ছিল চরম হতাশার মধ্যেও মফস্বল শহরে যা আমাদেরকে দিন বদলের আশায় জাগিয়ে রেখেছিল। ‘স’দের বাসায় সেই প্রথম হিন্দি ছবি ‘সিলসিলা’ দেখার স্মৃতি আজও অশ্রুসজল করে আমাকে।

স্বপন, মানিক, ‘স’ আর আমি ছবিটি দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। তারপর আমি আরও চার বার ছবিটি দেখেছি। তার কারণেই সুচিত্রা সেনের অনেক ছবি দেখেছি, ‘সুচিত্রাজগৎ’ নামে যে একটি রোম্যান্টিক পৃথিবী তৈরি হয়েছে আমার মনে যা গভীর প্রভাব ফেলেছে আমার লেখায় সেটা এই ‘স’এরই অবদান। থার্ড ইয়ারের সময় একদিন স্বপন, বেবী এবং ‘স’ ক্যাম্পাসে এসে আমাকে হতচকিত করে দিয়েছিল। সে তখন কুমিল্লায় নেই। ওরা ঢাকায় চলে গেছে আবার। কুমিল্লায় ছিল সেজবোন। তার এখানে প্রায়ই বেড়াতে চলে আসতো যখন কোনো মারফত জানতে পারতো যে আমি কুমিল্লায় ফিরেছি। সেবার তেমনি কুমিল্লায় এসে স্বপন ও বেবীকে সে-ই প্ররোচিত করেছিল চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য।

হঠাৎ করে অনেক বন্ধুবান্ধবের কাছেই বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সে ছিল নির্বিকার। পরে বলেছে, ‘আপনাকে বিব্রত, বিপর্যস্ত করতেই আমার যত আনন্দ।’ কথায় বলে সব নদী সাগরে গিয়ে মেশে তা ঠিক নয়, কোনো কোনো নদী সাগরে পৌঁছার আগেই মুছে যায়, হারিয়ে যায় মানচিত্র থেকে, গতিপথও পরিবর্তন করে। তেমনি কোনো কোনো সম্পর্কও অকালে ঝরে যায়। ঝরে যায় ফোটার আগে অনেক কলি। আমার ও ‘স’র সম্পর্কটিও তেমনি ছিল। তথাপি ‘স’ আমাকে যে স্বপ্নঘন সোনালি-রূপোলি তারুণ্যের জগতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল তার স্বাদ আজও ভুলতে পারিনি। ওর কাছ থেকে যা নিয়েছি তার মূল্য পরিশোধ করতে পারবো না। যা পেয়েছি তাও হারাতে পারবো না। আমার আধুনিক মানস গঠনে তার এবং আমার জাপানি স্ত্রীর যে অবদান সে ঋণ অপরিশোধ্য থেকেই যাবে আমৃত্যু। আমি নানা মানুষের দানে সমৃদ্ধ হয়েছি এটাই আমার শান্তি। আমি তাঁদের কাছে আনত কৃতজ্ঞ।........চলবে

আলোকচিত্র : বামে, আমার অসুস্থতার সময়ে রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘সেই ঘরে সুন্দর’ কোনো কপি আর কোথাও নেই। ডানে, ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে এখানে আমগাছের তলে মাঝে মাঝে আমরা বসে গল্প করেছি। বাবা অফিস থেকে বাড়িফেরার পথে দেখে ফেলেছিল আমাদেরকে

লেখক : জাপান প্রবাসী