মানিক সরকার মানিক, রংপুর : সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে রংপুরের বাসভবন ‘পল্লী নিবাসে’র লিচু বাগানেই চির নিন্দ্রায় শায়িত হলেন জাপা চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ.এম এরশাদ। মঙ্গলবার বিকেলে সেনাবাহিনী, পুলিশ. র‌্যাব, জাতীয় পার্টি ও এর অঙ্গ সংগঠন  ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সমর্থক শুভার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ তার দাফন কাজে উপস্থিত থেকে দাফনে অংশ নেন। এ সময় সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রিয় নেতাকে হারিয়ে অনেকেরই চোখে মুখে কষ্টের জল ঝরতে দেখা যায়।

রংপুরে এরশাদের বাসভবন ‘পল্লী নিবাস’ সংলগ্ন তার বাবার নামে গড়ে তোলা ‘মকবুল হোসেন জেনারেল এ্যান্ড ডায়াবেটিক হাসপাতাল’র লিচু বাগানে তাকে সমাহিত করা হয়। এ সেময় সেখানে কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে ওই ক্যাম্পাস ভড়ে ওঠে। গত ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যু বরণের পর অনেক আগে থেকেই ঢাকাসহ রংপুরের নেতাকর্র্মীদের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় তার দাফন কার্য কোথায় সম্পন্ন হবে ঢাকা নাকি রংপুের।

দলের বিভিন্ন জেলার অধিকাংশ নেতা এবং সাধারণ মানুষ চাচ্ছিল রংপুরেই তার দাফন কার্য সম্পন্ন করতে। এমনকি মৃত্যুর পর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলার নেতাকর্মীরা গত সোমবার রংপুরে এক জরুরী সভা করে রংপুরেই তার দাফন সম্পন্ন করার দাবি জানান। সভা থেকে তারা এ-ও ঘোষণা দেন যে, ‘রক্ত দেব তবু এরশাদকে রংপুর থেকে থেকে নিয়ে দেব না’।

শুধু তাই নয়, এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদও মিডিয়ার কাছে রংপুরেই তার দাফনের জন্য দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু বাঁধ সাধেন তার স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং দলের কিছু নেতা। তারা চাইছিল ঢাকাতেই তার দাফন সম্পন্ন করা হোক। এনিয়ে গত দু’তিন দিন থেকেই চলতে থাকে নানা কানাঘুষা। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্তও ছিল এই কানাঘুষা। কোথায় হবে দাফন ?

পরিকল্পনা ছিল একটি হেলিকপ্টারযোগে এরশাদের লাশ নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে অবতরণ করবেন কয়েক নেতাকর্মী। ১১টা ৫০ মিনিটে লাশবাহী একটি সাদা হেলিকপ্টার নামে ক্যান্টনমেন্টে। এরপর সেখান থেকে এরশাদের পৈত্রিক নিবাস সেনপাড়ার ‘স্কাউভিউ’ এবং সেন্ট্রাল রোডস্থ দলীয় কার্যালয়ে নেয়ার কথা থাকলেও কোথাও নেয়া হয়নি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে সরাসরি লাশবাহী গাড়িটি নিয়ে আসা হয় বেলা সাড়ে ১২ টায় রংপুরের কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ ময়দানে। সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদসহ বিভিন্ন দল সর্বস্তরের মানুষ তাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এ আগে সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন তার ভাই এবং দলের ভাপরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি.এম কাদের।

তিনি তার ভাইয়ের স্মৃতিচারণ এবং কৃতকর্ম তুলে ধরেন, কেউ যদি তাকে কোন ব্যাপারে ভুল বুঝে থাকেন সেজন্য সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। আগে জাপা মহসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা তার জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরেন।এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এরপরই বাদ আসর শুরু হয় নামাজে জানাযার । জানাযার নামাজ পড়ান রংপুর কোট মসজিদের ইমাম মাওলানা ইদ্রিস আলী। এতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ অংশ নেন।

এরপরই দলীয় নেতাকমী ও সমর্থকদের মাঝে দাফন নিয়ে শুরু হয় উৎকন্ঠা। আগে থেকেই তারা ঘোষনা দেন কোন ভাব্ইে তার লাশ ঢাকায় নিয়ে যেতে দেবে না। রংপুরেই দাফন করতে হবে। আর এজন্য আগে থেকেই পল্লী নিবাসের পাশে তার বাবার নামে গড়ে তোলা হাসাপাতালের লিচু তলায় খোড়া কবর। জানাযা শেষে কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়ির বহর ক্যান্টনমেন্টের দিকে রওনা হলে নেতাকমী ও সাধারণ মানুষের মাঝে সন্দেহ আরেও বেড়ে যায় যে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাকে লাশ হেলিকপ্টারে তুলে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে।

অবশ্য তার আগেই মহা সচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা জানান, এরশাদের লাশ রংপুরেই দাফন করা হবে। এদিকে নেতাকর্মীদের গাড়ি ক্যান্টনমেন্টের সড়কে রওনা হলেও এরশাদের লাশবাহী গাড়িটি রওনা হয় উল্টোদিকে শহর মুখী। এ সময় লাশ গাড়িতে থাকলেও হাজার হাজার এরশাদ ভক্ত প্রায় ৬/৭ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে গোটা শহর প্রদক্ষিণ করে শাপলা, লালবাগ এবং কলেজ রোড হয়ে পল্লী নিবাসে গিয়ে পৌছে।

যেহেতু এরশাদ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন, সেহেতু সেনাবাহিনীর একটি চৌকশ দল বিকেল সাড়ে ৫টায় তাকে গার্ড অব অনার দেন এবং তার কফিনে ব্যাজ ও ক্যাপ লাগিয়ে দেন। এরপর এক মিনিট নীরবতা শেষে তার লাশ নামানো হয় কবরে। সেখানেই তাকে চির নিন্দ্রায় শায়িত করা হয়। আর এর মাধ্যমেই অবসান ঘটে একটি বর্নাঢ্য জীবনের। অবসান হয় সকল জল্পনা কল্পনার।

(এম/এসপি/জুলাই ১৬, ২০১৯)