রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : হামলাকারীদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে কৃষি ব্যাংকের ডিজিএম ও এক সাংবাদিকের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করার অভিযোগ উঠেছে সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। শুধু মামলা রেকর্ড করেই ক্ষান্ত হননি ওই পুলিশ কর্মকর্তা বৃহষ্পতিবার সকালে ওই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করার পর ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের জন্য শারিরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সদস্য ও খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক তথ্যের জেলা প্রতিনিধি সৈয়দ রফিকুল ইসলাম শাওনের বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কুয়েতে চাকুরি করাকালিন কিছু জমি কেনেন সদর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের আনারুল ইসলাম। জামায়তের অর্থযোগানদাতা আনারুল ইসলাম টাকার জোরে ধরাকে সরা জ্ঞান করে থাকেন। কাটিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক তছলিমের সঙ্গে তার রয়েছে বিশেষ সখ্যতা।

গত ১১ জুলাই সকাল ৮টার দিকে সকলের ব্যবহৃত রাস্তার মাঝখান দিয়ে পানির ড্রেন বানানোর সময় বাধা দেন সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম শাওন। প্রতিবাদ করেন প্রতিবেশি কৃষি ব্যাংকের ডিজএম গোলাম মোস্তফা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আনারুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা শাওনকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে জখম করে চলে যায়। আহত শাওনকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবর পেয়ে সুচতুর আনারুল বাম চোখের ভ্রুর পাশে কৃত্রিমভাবে ক্ষত সৃষ্টি করে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।

হামলার ঘটনায় ১১ জুলাই বিকেলে শাওন বাদি হয়ে আনারুলসহ চার জনের বিরুদ্ধে সদর থানায় অলভিযোগ দায়ের করেন। তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আব্দুর রশিদ ঘটনাস্থলে এসে ঘটনার সত্যতা পেলেও টাকা না দেওয়ায় মামলা নেননি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান। একপর্যায়ে মামলা রেকর্ডের জন্য ১০ হাজার টাকা দাবি করেন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

এদিকে কাল্পনিক আঘাত দেখিয়ে ১২ জুলাই সাংবাদিক শাওন ও ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফার নাম উল্লেখ করে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন আনারুলের স্ত্রী সোনালী খাতুন। উপপরিদর্শক তছলিমের মাধ্যমে আনারুলের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা পেয়ে ওই দিনই মামলা রেকর্ড করেন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

রফিকুল ইসলাম শাওন জানান, বৃহষ্পতিবার সকাল ৭টার দিকে তিনি ঘরে শুইয়ে ছিলেন। এ সময় কাটিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপরিদর্শক তছলিমের নেতৃত্বে পাঁচজন পুলিশ তার বাড়িতে আসে। পুলিশের কথা শুনে ঘরের বাইরে আসা মাত্রই তছলিম তাকে টেনে হিঁচড়ে উঠানে নিয়ে আসেন। আটকের ব্যাপারে জানতে চাইলে তছলিম বলে আনারুলের করা কোর্টের মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা জানান, শাওনকে গ্রেপ্তারের পর তাকে ধরতে আসে পুলিশ। তিনি ঘর থেকে বাইরে আসা মাত্রই তছলিম তার জামার কলার ধরে টানতে টানতে উঠানে নিয়ে আসে। নিজের পরিচয় বলার পরও তছলিম তার কথা শোনেন নি। ওসি সাহেব ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের কথায় তোদের ধরতে এসেছি উল্লেখ করে তছলিম বলেন, যা বলার থানায় যেয়ে বলবি। একপর্যায়ে পুলিশের এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার কাছে মোবাইল করায় তার মাধ্যমে জানতে পেরে তাকে (গোলাম মোস্তফা) ছেড়ে দিয়ে শাওনকে নিয়ে চলে যায় পুলিশ।

তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, শাওন ও তার বাড়ি পাশপাশি হলেও এজাহারে শাওনের ঠিকানা আনন্দপাড়া ও তার ঠিকানা দক্ষিণ কাটিয়া লেখা হয়েছে। শাওন বৃহষ্পতিবার আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

সাতক্ষীরা নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের আহবায়ক অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, থানার বারান্দায় উঠতেই বাম হাতে টিনের বোর্ডে লেখা আছে জিডি ও মামলা করতে থানায় কোন টাকা লাগে না। অথচ টাকা ছাড়া ওসিসাহেব কোন মামলাই করেননা এমনটি প্রচার রয়েছে। সম্প্রতি ঘোনা গ্রামের আব্দার রহমানের জমি জবরদখলকে কেন্দ্র করে নির্যাতিতদের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েও হামলাকারি শফিকুলের দেওয়া মিথ্যা মামলা আগে রেকর্ড করেছেন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হামলায় ১০জন সাংবাদিক মারাত্মক জখম হলেও ঘটনার এক সপ্তাহ পর হামলাকারিদের দেওয়া মিথ্যা মামলা রেকর্ড করেছেন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, ১০ জন সাংবাদিককে পিটিয়ে জখম করার ঘটনায় প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক মমতাজ আহম্মেদ বাপ্পির দায়েরকৃত মামলায় কোন দেখা সাক্ষী নেই উল্লেখ করে আদালতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এ ঘটনায় সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে না ওঠায় থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পার পেয়ে যাচ্ছেন।

সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনায় এমন পরিস্থিতি হলে সাধারণ মানুষের বেলায় কি হবে তা আর বলার উপেক্ষা রাখে না। আর এসব দূর্ণীতির কারণেই ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জেলায় ১১ বারের মত শ্রেষ্ঠ ওসি হিসেবে পুরষ্কৃত হয়েছেন। বিপদ বুঝে ১১ জুলাই শাওনের দেওয়া মামলা ১৮ জুলাই বিকেলে রেকর্ড করেছেন।

জানতে চাইলে কাটিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক তছলিম আনারুলের কাছ থেকে কোন আর্থিক সুবিধা নিয়ে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে মিথ্যা মামলা রেকর্ডের কথা অস্বীকার করে বলেন, মামলা রেকর্ড করেছেন ওসি সাহেব, তিনি শুধু স্যারের নির্দেশ পালন করেছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, এ ধরণের ঘটনা তার জানা ছিল না। ওসির বিষয়ে তিনি কেন নাক গলাতে যাবেন?

সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্তক কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান আর্থিক সুবিধা নিয়ে যে কোন মামলা রেকর্ডের কথা অস্বীকার করে বলেন,আনারুলের চোখের কোনে চারটি সেলাই করা হয়। এজন্য তার মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। তবে ১১ জুলাই শাওনের দায়েরকৃত অভিযোগটি ১৮ জুলাই রেকর্ড করা হয়েছে। মামলা নং- ৪৬। আসামী আনারুলকে বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে শুক্রবার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।

(আরকে/এসপি/জুলাই ১৯, ২০১৯)