স্টাফ রিপোর্টার : বন্যা পরিস্থিতির জন্য এবার নৌপথে ঈদযাত্রা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। রবিবার (২১ জুলাই) রাজধানীর আব্দুল গণি রোডের বিদ্যুৎ ভবনে ঈদুল আজহা উপলক্ষে নৌপথে যাত্রীদের সুষ্ঠু ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিতে আয়োজিত সভায় এ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদের সভাপতিত্বে সভায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, নৌযান মালিক-শ্রমিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১২ আগস্ট দেশে মুসলমানদের দ্বিতীয় বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ উদযাপিত হতে পারে।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ বলেন, ‘আমরা সবাই চাই ঈদযাত্রাটা ভালো হোক। শুধু ঈদযাত্রা নয়, কোনো যাত্রায় আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াই, এটা কখনোই কাম্য নয়। এবারের বন্যার ধরনটা অন্যরকম। এবার গাইবান্ধা শহরের মধ্যে কোমরের ওপর পানি। এটা একটা ব্যতিক্রম বিষয়। নদীর স্রোতের জন্য ফেরি চলতে পারছে না। বিআইডব্লিউটিসি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পদক্ষেপ নেয়ায় আমরা অনেক বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি।’

তিনি বলেন, ‘জীবনবাজি রেখে ঈদযাত্রা করতে হবে- এ ব্যাপারে যাত্রীসাধারণকে বলব, জীবনবাজি রেখে ঈদযাত্রার মাধ্যমে নিজেকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না। আমাদের সক্ষমতা যতটুকু আছে আমরা ততটুকুই সার্ভিস দিতে পারব। নতুন নতুন প্রকল্প নিয়েছি, যখন এগুলো আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে, আমাদের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে।’

‘রাজবাড়ী থেকে বললো, এতগুলো ফেরি দিতে হবে, আমাদের সেই সক্ষমতা নাই, থাকলে তো আমরা দেব। আমাদের সক্ষমতা ও সার্বিক নদীর অবস্থা বিবেচনায় এবার ফেরির ক্ষেত্রে কিছুটা সংকট হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মলম পার্টির মাধ্যমে কোনো যাত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটার খেসারত অপরাধীদের দিতে হবে। কোনো অপরাধীকে আমরা কখনই ক্ষমা করব না।’

নৌপরিবহন সচিব মো. আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আমরা বিআইডব্লিউটিসির পক্ষ থেকে শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে সর্বোচ্চ সংখ্যক ফেরি দেয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু আমাদের ফেরিগুলো পুরনো, ৬০/৭০ বছরের পুরনো ফেরিও আছে। আল্লাহ মাফ করুক, একটা ফেরিও যদি দুর্ঘটনায় পড়ে নদীতে ডুবে যায়, তাহলে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও আমার চাকরিও থাকবে না। মানুষের কাছে জবাবদিহি করার মুখ আমাদের থাকবে না। দুর্ঘটনার কথা চিন্তা করে আমাদের জাহাজ ও ফেরি চালাতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এবার বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি মাধ্যাঞ্চলে জমা হবে। নদীতে স্রোত তীব্র থাকবে- এটা আমরা ধরে নিতে পারি। পানি আসতেছে, বর্ষা থাকার সম্ভাবনা আছে। কাজেই সেগুলো মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। ঈদের সময়ে ফেরি ওই পাড়ে (কাঁঠালবাড়ি) দিয়েছি, ওখানে গিয়ে এক মিনিটও দেরি করিনি আবার এ পাড়ে (শিমুলিয়া) নিয়ে এসেছি। কারণ ওই পাড়ে মানুষ নেই। এবার কিন্তু ওই পাশ থেকে গরু আসবে। আমাদের ওখানে দেরি করতে হবে।’

সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থেকে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সচিব বলেন, ‘কোরবানির ঈদে একটা দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদের মহাবিপদ চলে আসবে।’

বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলাম বলেন, ‘এবার ঈদে আমাদের ৫০ লাখ যাত্রী এবং প্রায় ৭০ লাখ কোরবানির পশু স্থানান্তর করতে হবে। এটা খুব স্বল্প সময়ে করতে হবে। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। মিয়ার চরসহ বিভিন্ন জায়গায় যে সমস্যা আছে সেগুলো আমরা দেখব।’

বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান প্রণয় কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘তীব্র স্রোতের কারণে শিমুলিয়া, কাঁঠালবাড়ি, পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটছে। আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সামনে ঈদ, এসব ফেরির ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিলে ঈদের আগে মেরামত করা সম্ভব হবে না। এতে ঈদে ফেরি সংকট দেখা দিতে পারে। সবাইকে ধৈর্য-সহকারে ফেরি ব্যবহারের আহ্বান জানাচ্ছি।’

নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে মোট ১১টি টার্মিনাল এবং ১১৩টি লঞ্চঘাটের মধ্য দিয়ে সর্বমোট ৮৩২টি যাত্রীবাহী নৌযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ২১০টি পরিচালনা করা হয় দূরপাল্লার গন্তব্যে।’

‘প্রতিদিন লঞ্চগুলোর মাধ্যমে গড়ে তিন লাখ যাত্রী পরিবাহিত হয়, ঈদের সময় এ যাত্রী প্রায় পাঁচ লাখে উন্নীত হয়।’

মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের সময় অতিরিক্ত লাইফ সেভিং ইকুয়েপমেন্ট রাখার দায়-দায়িত্ব লঞ্চমালিকদের নিতে হবে।’

লঞ্চমালিক সমিতির সহ-সভাপতি মো. সহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘নদীপথের চর এলাকায় অতিসত্বর বাতি দিতে হবে, স্রোত যখন নামে তখন লঞ্চও খুব দ্রুত নামে, তখন কোনো কারণে চরে লঞ্চ ঠেকে গেলে তা উল্টে যেতে পারে।’

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘এবার এমন সময়ে ঈদ, আমাদের সামনে যখন ভরবর্ষা। নদীতে তীব্র পানির স্রোত, এ সময়ে চাঁদপুরে একটা ঘূর্ণিস্রোতের অবস্থা তৈরি হয়েছে। পানির স্রোত এত বেশি যে, অনেক বড় নৌযানকেও উজানে ঠেলে আসা অত্যন্ত কষ্টকর।’

এ সময়ে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলের প্রধান রুট বিশেষ করে মিয়ার চর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে- জানিয়ে শাহ আলম বলেন, ‘সেখানে একটি কার্গো ডুবির ঘটনার পর ওই স্থান দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলছি আমরা। মিয়ার চর এড়িয়ে ছোট নৌযানগুলো কালীগঞ্জ ঘুরে বরিশাল যেতে পারবে না। ঈদ সামনে এসেছে, মিয়ার চর বন্ধের কথা বলা হচ্ছে, বন্ধ হলে আমি কোন জায়গা দিয়ে যাব?’

রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার বলেন, ‘গতকাল রাজবাড়ীতে চার কিলোমিটার যানজট ছিল। ফেরির খুব সংকট এবং প্রচুর সমস্যা। যেখানে ১০/১২টির মতো ফেরি চলে সেখানে দুটি মাত্র আছে, রো রো ফেরি। যার মাধ্যমে বেশি যানবাহন পারাপার করা যায়। আর যেগুলো আছে, ছোট ছোট ফেরি। কিছু ফেরি বসে আছে, তারা স্রোতের প্রতিকূলে যেতে পারে না। কখনও কখনও অপেক্ষমান যানবাহনের দৈর্ঘ্য ৬-৭ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে যায়। ফেরি না থাকলে আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। ফেরি বাড়াতেই হবে। ঈদের সময় চাপ খুব বেশি থাকবে।’

মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, ১৬টি ফেরির মধ্যে তিনটি ফেরি চলাচল করতে পেরেছে। স্রোতের কারণে নাব্যতা সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে আরেকটি চ্যানেল প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি দৃষ্টিতে আনা উচিত।’

মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বলেন, ‘প্রথমত আমাদের ফেরির সংখ্যা বাড়াতে হবে। গত ঈদুল ফিতরের সময় পাটুরিয়া ঘাটে ২১টি ফেরি চলাচল করেছে। পদ্মা-যমুনার পানির বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে গত ঈদের চেয়ে এবার ফেরি পার হতে দ্বিগুণ সময় লাগবে। ৪০টি ফেরির ব্যবস্থা করা হলে যাত্রী চলাচল নির্বিঘ্ন হবে।’

বরাবরের মতো ঈদের আগের তিনদিন এবং পরের তিনদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও কোরবানির পশুবাহী ট্রাক ছাড়া সাধারণ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ফেরিতে পারাপার বন্ধ থাকবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

(ওএস/এসপি/জুলাই ২১, ২০১৯)