নওগাঁ প্রতিনিধি : সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। সেই গুজবে গণপিটুনিতে কেউ হারাচ্ছেন বাবা, কেউবা মা। কারো ভাই-বোন ও আত্মীয় স্বজন। গণপিটুনির ভয়ে মানুষ এখন অন্যত্র যেতে ভয় পাচ্ছে। হয়তো অপরিচিত হওয়ায় ছেলেধরা সন্দেহে না বুঝে পিটুনি দিতে পারে। এদিকে ছেলেধরা গুজবে উপস্থিতি কমেছে নওগাঁর প্রাথমিক স্তরের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরাও।

জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে শিশুদের মাথা লাগছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ায় শিশুদের সাবধানে রাখার জন্য পরামর্শমূলক বার্তাও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে পাঠানো হয়। ফলে গুজবটি দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সেই গুজব এখন ভয়াবহ আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী বাবা-মায়েরা বেশি আতঙ্কে আছেন। সেই সঙ্গে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে ভয় পাচ্ছে। অনেকের বাবা-মা সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে। অপরদিকে, জীবন-জীবিকার জন্যও মানুষ ছেলেধরা আতঙ্কে অন্যত্র যেতে ভয় পাচ্ছেন। অপরিচিত হওয়ায় ভুল বুঝে গণপিটুনি আতঙ্ক বিরাজ করছে সর্বত্র।

রবিবার সকালে ছেলে ধরা সন্দেহে নওগাঁর মান্দা উপজেলার বুড়িদহ এলাকায় ৬ জেলেকে গণপিটুনি দেয় এলাকাবাসী। সংবাদ পেয়ে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। তারা নওগাঁ সদর উপজেলার খাগড়া গ্রাম থেকে ওই এলাকায় মাছ শিকার করতে গিয়েছিলেন। একই দিনে, মানসিক ভারস্যামহীন আবুল কালাম (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে ছেলে ধরা সন্দেহে আত্রাই উপজেলার মহানগর গ্রামে গণপিটুনি দিয়ে থানায় সোপর্দ করা হয়।

গণপিটুনিতে আহত জেলে সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমরা মাছ শিকার করে জীবন চালাই। বুড়িদহ এলাকায় সঞ্জিতের পুকুরে ছোট মাছ ধরতে যাই। কিন্তু গোপনে তিনটি বড় মাছ বস্তার মধ্যে লুকিয়ে রাখি। পরে পুকুর মালিক বুঝতে পারলে এ নিয়ে তর্কাতর্কি হয়। মারপিট করবে এই ভয়ে আমরা দৌড় দিলে তারা ছেলেধরা বলে চিৎকার শুরু করে। তখন এলাকাবাসী ধরে আমাদের মারপিট শুরু করে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে আমাদের উদ্ধার করে। পুলিশ জানতে না পারলে গণপিটুনিতে আমরাও হয়ত মারা যেতাম।

নওগাঁর চাংলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, সেখানে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০৪ জন। কিন্তু গত এক সপ্তাহে ছেলে ধরা গুজবে উপস্থিতি ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এছাড়া সদর উপজেলার কীত্তিপুর-১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১০জন হলেও উপস্থিত ছিল ৮০ জন। সাপাহার উপজেলার আইহাই ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় মুংরইল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫০ জন। গত কয়েক দিনে ছেলে ধরা গুজবে এ বিদ্যালয়ে এখন উপস্থিতির সংখ্যা গড়ে ৫০ জন বলে জানা গেছে।

বদলগাছী উপজেলার চাংলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সাত্তার বলেন, টেলিভিশন ও পত্রিকায় খবর দেখছি বিভিন্ন জায়গায় ছেলেধরা গুজব। এতে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে ভয় পাচ্ছিল। আমরা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বুঝিয়েছি ছেলেধরা একটা গুজব ও আতঙ্ক। যা মিথ্যা ও অপপ্রচার। এরপর শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসছে।

সাপাহার উপজেলার মুংরইল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল ওয়াহাব বলেন, আমাদের গ্রামটি সীমান্তবর্তী। গত কয়েক দিন থেকে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে ছেলেধরা গুজব আতঙ্ক। এতে করে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে। ফলে কমেছে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি।

নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আমিনুল ইসলাম বলেন, ইতোমধ্যে শিক্ষা অফিসারদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গুজবে কান দেয়া ঠিক না। এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। যেহেতু উপবৃত্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি প্রয়োজন। গত কয়েক দিন থেকে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কিছুটা কম। সেক্ষেত্রে উপবৃত্তির কোন সমস্যা হবেনা বলে মনে করেন তিনি।

এ ব্যাপারে নওগাঁ জেলা পুলিশ সুপার মোঃ ইকবাল হোসেন পিপিএম বলেন, এটা একটা গুজব। এ ধরনের গুজবে কাউকে কান না দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মসজিদের মোয়াজ্জিনের মাধ্যমে এ ধরনের অপপ্রচারে রোধে মুসল্লিদের কান না দেয়ার জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

(বিএম/এসপি/জুলাই ২২, ২০১৯)