রহিম আব্দুর রহিম


দক্ষিণ এশিয়া তথা পৃথিবীর সভ্য জগতে নাগরিকত্বহীন এক মানবগোষ্ঠীর পরিচয় ছিলো ছিটমহলবাসী। যে মহল, কোন একটি রাষ্ট্রের খন্ড অংশ বা ভূ-খন্ড, অন্য কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে; যা ওই রাষ্ট্রের আইন সীমানা দ্বারা বেষ্টিত ছিলো। এমন ভূ-খন্ডই ছিটমহল বলে পরিচিত হয়ে আসছিলো। এই ভূ-খন্ডেই বসবাসরত প্রায়ই ৫১ হাজার জন মানুষ যারা সভ্য সমাজের ভৌগলিক অবস্থান থেকে দীর্ঘ ৬৮ বছর বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন করেছে। ভারত এবং বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ডে এমন বিচ্ছিন্ন জনপথ ছিলো ১৬২ টি।

এই ১৬২ টি ছিটমহলে আনুষ্ঠানিক সভ্যতার আলো পৌঁছে, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন। ওই দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে ছিটমহল বিনিময়ে ‘মুজিব-ইন্দিরা’ স্থলসীমান্ত চুক্তির অনুসর্থনের দলিল বিনিময় ঘটে। অনুসমর্থনের পেছনের ঘটনা যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি রয়েছে নির্মমতার করুন কাহিনী। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পরপরই ১৯৪৮ সালে নব্য স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার ছিটমহল সংক্রান্ত সমস্যার বিষয়টি প্রকাশ হয়। এই নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে, যাতে বিষয়টি সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক সমস্যায় পরিণত না হয়। তা হয়নি, তবে ৬৮ বছরের ব্যবধানে সমাধানও হয়নি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, দুই দেশের মধ্যে সু-সম্পর্কের কারণে ছিটমহল বিনিময়ের গভীর সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৭৪ সালে ১৫ মে, তৎকালীন স্বাধীনতার মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যে চুক্তি ‘মুজিব-ইন্দিরা’ চুক্তি নামে ইতিহাসে স্থান পায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু স-পরিবারে নিহত হন। তাঁর শাহাদাতে ৯ বছর পর শহীদ হন (১৯৮৪) ইন্দিরা গান্ধী। এর পর যা হবার তাই..! সীমান্ত চুক্তি চাপা পড়ে যায় স্বার্থের অতল গহব্বরে। অবরুদ্ধ, রাষ্ট্রবিহীন ছিটমহলবাসীরা সময়ে-অসময়ে নির্যাতন, নিপীড়ন হতে থাকে মানুষ নামক মুখোশধারীদের হাতে।

৬৮ বছরের ব্যবধারে ৩’শ মানব প্রাণ নির্মমভাবে নিহত হয় অপরাধীদের হাতে। লুটপাট হয় সহায় সম্পত্তি। আইন আদালত কখনই ধারে কাছে পৌঁছাতে পারেনি। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের এক দুপুরে তৎকালীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গারাতি ছিটমহলে তান্ডব চালায় বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার ৪ টি ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার জন মানুষ। ১৯৭১ এর কায়দায় ছিটবাসীদের বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়া হয়। লুটতরাজ করা হয় ফসল এবং গৃহপালিত পশুসহ ঘরের সহায়-সম্পত্তি। ঘটনার সূত্রপাত জমি-জমা সংক্রান্ত এক বিরোধকে কেন্দ্র করে রমজান আলী নামক এক ব্যক্তির খুনের মধ্য দিয়ে। এই ঘটনায় ওই সময় দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, চ্যানেল, রেডিও টেলিভিশনের সংবাদ কর্মীরা কোমর বেঁধে মাঠে নামেন মানবতা প্রতিষ্ঠায়।

ভারত এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মগজে নাড়া পড়ে। ভূক্ত ভোগীরা রাষ্ট্রীয় অধিকার পেতে আন্দোলনে নেমে আসে। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চগড় বিদ্রোহী শিশু কিশোর থিয়েটার নামক একটি শিশু সংগঠন ছিটমহলবাসীদের জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত নাটক,‘চুক্তির মুক্তি’ নাটকটি ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে পরিবেশন করে। মানবিক আবেদন মিশ্রিত এই নাটক এর ব্যয়ভার বহনে তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ডক্টর আতিউর রহমান সহযোগিতা করেন। চতুরমূখী আন্দোলন, কলম সৈনিকদের মানবিক আবেদন, বাংলাদেশ-ভারত সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ৬ জুনের অনুসমর্থনের দলিল বিনিময়ের ধারাবাহিকতায় সেই বছরে ১ আগস্ট রাত ১২.০১ মিনিটে ১৯৭৪ ‘মুজিব ইন্দিরা’ চুক্তির আওতায় একে অন্যের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলো পরস্পরের সাথে বিনিময় হয়। ফলে আজব জগৎ ছিটমহল সভ্যতার আলোতে আলোকিত হয়।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের তৎকালীন ছিটমহলগুলোর মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯ টি, পঞ্চগড়ে ৩৬ টি, কুড়িগ্রামে ১২ টি এবং নীলফামারীতে ৪ টি। এর মধ্যে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলের সংখ্যা ছিলো ৫১ টি । যেখানে মোট ভূমির পরিমাণ ৭১১০.২ একর। যার লোক সংখ্যা ১৭ হাজার। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহল ছিলো ১১১ টি, যেখানে ভূমির পরিমাণ ১৭১৫৮.১৩ একর, এখানকার লোক সংখ্যা ৩৪ হাজার। ছিটমহল বিনিময়কালে ১১১ টি ছিটমহল থেকে ৯২১ জন অধিবাসী ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন পক্ষান্তরে, ভারত থেকে কোন নাগরিক বাংলাদেশে আসেনি।

ছিটমহল বিনিময় হওয়ার পরপরই তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার কেন্দ্রীয় সরকার বিলুপ্ত ছিটমহলের সার্বিক উন্নয়নে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেন। অপর দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার, বিলুপ্ত ছিটমহলে সার্বিক উন্নয়নে থোক বরাদ্ধ দেন ২০০ কোটি টাকা। এবছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আরও ৮২৭ কোটি টাকা বরাদ্ধ করেছেন। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকার সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীদের সার্বিক উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্র্ম চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্র্ঘ ৬৮ বছর যে ভূ-ভাগের মানুষরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন আদালত থেকে বঞ্চিত ছিল, ভয়-আতঙ্ক যাদের একসময় নিত্য সাথী ছিল।

তারা এখন পাঁকা সড়কে হাটে, বিদ্যুৎ বাতির আলোতে আলোকিত অঞ্চল, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, স্বাস্থ্য কেন্দ্র হাতের নাগালে। চাকুরী হচ্ছে সরকারি, বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকিং সেবা ঘরে ঘরে। মাতৃকালীন, বয়স্ক, বিধবা ভাতা পাচ্ছে নিয়মিত। মসজিদ, মন্দির চকচকে। ব্যাপক উন্নয়ন সত্যিকার অর্থেই ঈর্ষান্বীয়! সম্প্রতি আইসিটিতে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইসিটি সম্পর্কীয় মৌলিক জ্ঞান বিস্তার, যুব সম্প্রদায়কে হাতে কলমে আইসিটি শিক্ষায় দক্ষ করে স্বাবলম্বী, বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটি শিক্ষায় উপযুক্ত অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিবেশ নিশ্চিত এবং সরকারি বিভিন্ন ই-সেবা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য এক বৃহৎ প্রকল্প চালু হয়েছে।

গত ১৩ জুলাই ‘সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে আইসিটি প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো স্থাপন শীর্ষক কর্মসূচির ফল প্রসুতা বৃদ্ধির জন্য সচেতনতা সৃষ্টি বিষয়ক’ শিরোনামে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক এর দরবার কক্ষে অনুষ্ঠিত, এক সেমিনারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং অতিরিক্ত সচিব এ বি এম আরশাদ হোসেন জানান, ‘সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলের পঞ্চগড়ের ২২ টি ব্যাচে ৪৪০ জন, নীলফামারীর ১ টি ব্যাচে ২০ জন, কুড়িগ্রামে ১১ টি ব্যাচে ২২০ জন, লালমনিরহাটে ১১ টি ব্যাচে ২২০ জন করে মোট ৪৫ টি ব্যাচে ৯০০ জনকে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে।

অপরদিকে আইসিটি প্রশিক্ষিত যুব সম্প্রদায়কে অধিকতর যোগ্য করে তুলতে পঞ্চগড়ে ৭ টি ব্যাচে ১৪০ জন, কুড়িগ্রামে ৪ টি ব্যাচে ৮০ জন, লালমনিরহাটে ৪ টি ব্যাচে ৮০ জন করে মোট ১৫ টি ব্যাচে ৩০০ জন করে প্রশিক্ষন দেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো উন্নয়নের ফিরিস্তি অত্যন্ত সন্তোষজনক। ছিটমহল বিনিময়ে ৪ বছর অতিবাহিত। ছিটমহল বিনিময়, মানবতা প্রতিষ্ঠা, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ বাংলাদেশ ও ভারতে নেতৃত্ব প্রদানকারী নেতাকর্মী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের মুজিববর্ষে ‘মুজিব-ইন্দিরা’ পদকে ভূষিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে, ইতিহাসের পাতা পরিমার্জিত হবে হলে অনেকেই মনে করছেন।

লেখক : সাংবাদিক, কলামনিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সংগঠক।