রণেশ মৈত্র


ক্ষমা করো বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে ক্ষমা করো। কোটি কোটি বাঙালির সক্রিয় সমর্থনে ও দেশ-বিদেশের দুর্লভ সহযোগিতায় যে স্বপ্নের বাংলাদেশটি তোমার বলিষ্ঠ আহ্বানে গড়ে তোলা হয়েছিল নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ও ২৩ বছরের ধারাবাহিক ও বিরামহীন গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, সেই বাংলাদেশ আজ তার প্রতিটি নাগরিকের কাছে এক দু:স্বপ্নের ও মহা আতংকের দেশে পরিণত করেছি আমরা। তোমার অনুপস্থিতির সুযোগে।

বঙ্গবন্ধু, ‘স্বর্গধাম’ বা ‘বেহেশ্ত্’ বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তুমি তো সেখান থেকেও দেখতে পাচ্ছ তোমার ১৬ কোটি বাঙালি আজ কত নিরাপত্তাহীন, কত অসহায়, কত বিচিত্র ধরণের সমস্যায় প্রতি মুহুর্তে পীড়িত? তুমি কি শুনতে পাচ্ছ তোমার প্রিয় বাঙালি জাতির বোবাকান্না? প্রতি মুহুর্তে দেখছো কি তাদের চোখের বহমান অস্ত্রু ধারা?
জান কি বঙ্গবন্ধু, তোমার প্রিয় বাঙালি আজ সংবাদপত্রের পাতা খুলতেও ভয় পায়? কারণ প্রতিটি প্রত্যুষে আমাদের মহাগর্বের সংবাদপত্রগুলি বয়ে আনছে নিত্য নতুন আতংকের খবর। শিরোনামে রোজই দেখছি রোগাক্রান্ত মানুষের আর্তনাদ।

তুমি তোমার জীবৎকালে বঙ্গবন্ধু কদাপি কি শুনেছ ‘ডেঙ্গু’ নামক ভয়াবহ এক ধরনের জ্বরের নাম? কল্পনা করতে পর কি মাত্র ২৪ ঘন্টায় (২ আগষ্ট, ২০১৯) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬৮৭ জন? ভাবতে পার কি বঙ্গবন্ধু পত্রিকার শিরোনামে লিখছে “ডেঙ্গু আক্রানন্তের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়ালো। না, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশী প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগাক্রান্ত অনেকের খবর তো পত্রিকার পাতায় আজও আসতে পারে না। ডেঙ্গুতে মৃতের সংখাও কয়েক শ’তে পৌঁছেছে বলে অনুমান করি।

অবস্থা যখন এমনই সঙ্গীন বঙ্গবন্ধু তখন, সংবাদপত্রের শিরোনামে দেখছি, “হাত গুটিয়ে বসে বিশেষায়িত ১৭ সরকারি হাসপাতাল”। কি দুঃসহ বলতো এমন সব শিরোনাম।

একই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ জন নারী খেলোয়াড় নেপালে খেলতে যেতে হয়তো তাঁরা পারবেন না। অনুশীলনেও অংশ নিতে পারছেন না আমাদের ঐ গর্বিত মেয়েরা।

কি ভয়াবহ এই ডেঙ্গু পরিস্থিতি! ডাক্তার মারা যাচ্ছেন-মারা যাচ্ছেন নার্স-এই রোগে আক্রান্ত হয়ে। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্ত্রীও ঢাকাতে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আশংকা করা হচ্ছে, যে লাখো মানুষ পবিত্র ঈদ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে নিকটজনদের সাথে মিলিত হতে আসবেন-তাঁরা আবার সাথে ডেঙ্গুর ভাইরাস বয়ে আনবেন না তো?

জাতরি জনক বঙ্গবন্ধু! তোমার প্রিয় ঢাকা আজ ডেঙ্গুর এডিস মশার নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত এবং সেখান থেকে তা ইতোমধ্যে ৬৪টি মধ্যে ৬৩ টি জেলাতেই দিব্যি ছড়িয়ে পড়েছে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের মহামান্য হাইকোর্টের প্রসংসনীয় কঠোর ভূমিকা, সময়েচিত হুঁশিয়ারী সত্বেও দুই দুটি মেয়রই চরমভোবে ব্যর্থ। মানুষের আশংকা ঐ মেয়োরেরা হয়তো বা বিদেশ থেকে ডেঙ্গ জ্বরের চিকিৎসার ভেজাল ঔষধ আমদানি করছেন আমদানী কারকদের সাথে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে গোপন আয়ের লক্ষ্যে।

স্বাস্থ্য ন্ত্রণালয় ও ব্যর্থ যদিও ঐ মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর সকল ছুটি বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু এহেন অবস্থায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী দিব্যিসপরিবারে বিদেশে সফল করে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন জনগণের নিন্দাবাদ ও প্রতিবাদ মুখরতার কারণে। ঔষধ আমদানিতে লিপ্ত কালো বাজারি ও তাদের সহযোগিরা কি আইনের বা আদালতের বিচারের বাইরে থেকে যাবেন আর মানুষ মরতে থাকবে ঐ ভেজাল ওষুধের চিকিৎসায় অজস্র টাকা ব্যয় করতে করতে?

এহেন পরিস্থিতিতে গোটা দেশে “জরুরী অবস্থা” ঘোষণা কেন করা হবে না বঙ্গবন্ধু। চোখের সামনে তুমি নেই তাই কি ঐ মেয়রদ্বয় আজও ক্ষমতাসীন আছেন চরমভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পরও? স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্যর্থই হন নি শুধু বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে যে চরম দায়িত্বহীনতার অবহেলা দেখলেন তার জন্যে কেন তাঁকেই বা পদচ্যুত করা হবে না বঙ্গবন্ধু? কোথাওপ্রশ্নগুলির জবাব না পেয়ে তোমাকেই তা করতে বাধ্য হয়েছি প্রিয় নেতা।

শুধুই কি তাই? বিস্ময়কর গুজব ছাড়িয়ে ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে এক ধরনের লাঠিধারীরা বহুসংখ্যক মানুষকে বিনাদোষে পিটিয়ে মারছে-ঢাকা শহরটিই এই গুজব সৃষ্টিকারী ও তাদের কার্য্যকালাপের ফলে মহা আতংকে দিন কাটাচ্ছে অনেকে অসহায়ভাবে মৃত্যুও বরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে বিনাদোষে অতর্কিত মৃত্যুর নগর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ। ছড়িয়ে পড়তে পারে তা সহসাই সারাটি দেশে কারণ ঐ হত্যার পর নিহতদের পকেট থেকে প্রাপ্তির সম্ভাবনাও তো কম না। এমন দেশ কি কাম্য ছিল তোমার প্রিয় মুজিব ভাই? কিছুদিন আগেও তো গুম খুনের অগুনতি খবরে, যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে আজ তা কিছুটা প্রশমিত হওয়ার পরে আবার শুরু হলো প্রকাশ্য দিবালোকে গুজব ছড়িয়ে লাঠির আঘাতে হত্যা। এই হত্যাকারীদের যে কয়েকটি গ্যাং লিপ্ত রয়েছে ঐ কাজে বর্তমানে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির আগেই যে কোন মূল্যে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করা (অবশ্যই আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে) অপরিহার্য হলেও, বঙ্গবন্ধু, তেমন কোন সরকারী উদ্যোগ এখনও দৃশ্যমান নয়।

অপরপক্ষে জাতির জনক, যে নারী সমাজ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, অগণিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে ইতহাসে স্থান করে নিয়েছেন সেই নারী সমাজ আজ প্রায় গৃহবন্দী। কি বাসে কি, কি ট্রেনে, কি নৌকায়, কি পার্কে, এমন কি নিজ নিজ আড়ীতেও যখন তখন শিকার হচ্ছেন ধর্ষণ, গণ-ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যায়। কত নারীর, কত শিশুর, কত কিশোরীর, কত যুবতীর কত বৃদ্ধাকেও যে পরে ঘটতে অতর্কিতে এমন জঘন্য অপমানের শিকার হতে হচ্ছে তা জল্পনা করতেও শিউরে উঠতে হয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা এবং ব্যাপকতা এমনই যে আজ অনেকেই বলতে শরু করেছেন “বাংলাদেশ একটি ধর্ষকের দেশ। কি করে সইবে বঙ্গবন্ধু এহেন বেদনাদায়ক, অপমানকর অভিধায় যখন আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশকে অভিহিত ও চিত্রিত করা হয়? মানুষ আতংকিত সভ্যতা বিদূরিত, সংস্কৃতিও মূল্যবোধ আজ জাতীয় জীবন থেকে প্রায় অন্তর্হিত। বিচার যতটুকু হচ্ছে, ঘটনার তুলনায় তা অত্যন্ত কম এবং সময় সাপেক্ষ হওয়ায় তার কোন সুফল তেমনভাবে পাওযা যাচ্ছে না।

তোমাকে প্রশ্ন করি, আমাদের হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট তথা বিচারালয়গুলিই যেন অসহায় মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে উঠুক এমনটা কিকদাপি ভাবতে পেরেছিলে? আদালাত কেই যদি সব কিছু করতে হয় তবে সরকারের কিপ্রয়োজন। লাখো কোটি টাকা প্রতিদিন জাতির পকেট থেকে নিয়ে মন্ত্রী, এম.পি, কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন প্রদান এবং দফায় দফায় তা বৃদ্ধিকরণ কিবর্তমান প্রেক্ষিতে আদৌ যৌক্তিক?

উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের কেউ কেউ (যাঁরা নিজেদেরকে ভি.আই.পি বা ভিভিআইপি বলে অভিহিত করতে ভালবাসেন) তাঁদের চলার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ফেরী আটকে রাখেন এবং পরিণতিতে যখন একটি তরুণ রোগী চিকিৎসার জন্য ঢাকা যাওয়ার পথে নদীর অপর পারে ফেরী অভাবে নদী পার হতে না পেরে পথেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করতে বাধ্য হন, তখন ঐ ভূক্তভোগীদের কাছে ঐ তথাকথিত ভি.আই.পি কি খুনের আসামী ব্যতিরেকে অন্য কোন অভিধায় অভিহিত হতে পারেন? কালবিলম্ব না করে ঐ ভি.আই.পি কবর্মকর্তাকে কি প্রেফতার করে বিচারামলে আনা সঙ্গত নয়? কিন্তু কৈ, তেমন কোন লক্ষ্মণ তো আদৌ জাতির নজরে পড়ছে না ঘটনার পর প্রায় দু’দুটি সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও। এ কেমন বাংলাদেশ গড়লাম আমরা? এর পরেওকি অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে-আইন-আদালতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে?

শোন বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিকেরাই ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ও নিয়ামক শক্তি ধনীরা বা ধনীর দুলালেরা নন। কিন্তু কি দেখছি? মানুষের তথা কৃষক শ্রমিকের ঘাম ঝরা টাকায় গড়ে ওঠা ব্যাংকগুলি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হচ্ছে ধনীকদেরকেই আর তাঁরা তা বিদেশে পার করে দিচ্ছেন একথা জানা সত্বেও। আর হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় ক্ষোভে দুঃখে মূল্যবান পাট পুড়িয়ে ফেলে হতাশায় ভোগেন তাঁরা। ধান, কালাইসহ অন্যান্য পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে ব্যাংকের ঋণ সময়মত পরিশোধ করতে না পারায় তাঁদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিব্যি জেল খাটতে হয় তখন ঐ আইন, ঐ ব্যাংক, তার পরিচালকদের প্রতি দেশবাসীর আস্থা কিভাবে আসবে বঙ্গবন্ধু! ব্যাংকগুলি ধনীরা ঋণ নিয়ে ফতুর করে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতি ধ্বংস করে দিব্যি তারা পার পেয়ে যায় আমরা চোখ বুজে তার নীরব দর্শক সেজে দিব্যি চলেছি বঙ্গবন্ধু। ওদের বিরুদ্ধে কথাবলাও তো অনেকাংশ বিপজ্জক।

বঙ্গবন্ধু, কদাপি কি তুমি ভাবতে পেরেছ বাংলাদেশে এতটাই মাথাভারী প্রশাসন গড়ে উঠবে এবং তার পরেও ভেজাল ওষুধ, ভেজাল দুধ, ভেজাল ফলমূল প্রভৃতে দেশ সয়লাব হয়ে যাবে? হস্তক্ষেপ করতে হয় কথায় কথায়, মহামান্য হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টকে অসহায় মানুষের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণে! তবুও কি হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশাবলী বাস্তবায়িত হয়? বিচারের বানী নিরবে নিভৃতে কেঁদেই চলেছে বঙ্গবন্ধু।

শোকাবহ আগষ্ট মাসের শরুতে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে লেখাটি লিখতে বাধ্য হলাম মুজিবভাই পরিস্থিতির ভয়াবহতার কারণে। জনগণকেই তুমি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে তাই জনগণের দুঃসহ জীবন কাহিনীর খ-চিত্র তুলে ধরলাম মাত্র।
দিনকয়েকের মধ্যেই তোমাকে নিয়ে আবার লিখবো প্রত্যয় আমার।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।