রাজন্য রুহানি, জামালপুর : যমুনা পাড়ের বন্যা কবলিত মানুষজনের কাছে আসন্ন ঈদ ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’র মতো। ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে গিয়ে একদিকে যেমন খানাখন্দে ভরা বসতভিটে মাটি দিয়ে ভরাট করে বিধ্বস্ত ঘর মেরামতে ব্যস্ত লোকজন, অপরদিকে অবুঝ ছেলেমেয়েদের ঈদে নতুন জামা-জুতো কিনে দেবার আবদারে অসহায়ত্বের চাপা আর্তনাদে মুষড়ে পড়েছেন অধিকাংশ পিতামাতা। বন্যার করাল গ্রাসে সবকিছু হারানো পরিবারের মতো হারিয়ে গেছে যেন তাদের সমস্ত ঈদ-আনন্দ। 

যমুনার চরবেষ্টিত ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ ও মেলান্দহ উপজেলার বন্যা কবলিত পরিবারগুলোতে এবার ঈদের কোনো আমেজ নেই, ছোঁয়া লাগে নি নতুন পোশাকের। আগেভাগেই ঈদের কেনাকাটা করা অন্যান্য ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েদের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর পিতামাতার কাছে কেঁদেকেটে নতুন জামার বায়না ধরে বন্যার্ত ও গরিব পরিবারের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা।

‘পেঠে ভাত নাই, আংগরে আবার ঈদ! পুলাপান কান্দাকাঠি করতাছে, ঈদ আইয়া পড়লো নয়া কাফর কিনা দেও। পেঠে ভাতই দিবার পাইতাছিনা নয়া কাফর কিন্যা দিমু কিবেই! আল্লায় আংগরে কফালে ঈদের আনন্দ লেহেনাই।’ কথাগুলো বলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই কষ্টের কথা জানালেন ইসলামপুরের পার্থশী ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামের মৃত সাকোয়াত হোসেনের স্ত্রী ৬০ বছর বয়সী বানভাসী হিমানী বেগম।

যমুনা তীর সংরক্ষণ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাথর্শী ইউনিয়নের একাংশ ভেঙে প্রবল বেগে বন্যার পানির ধাক্কায় ঘরবাড়ি ও সহায় সম্পদ ভেসে যাওয়ার করুণ কাহিনী তুলে ধরে হিমানী বেগম আরো জানান, তীব্র স্রোতে এক পলকেই বেড়ের ধান, ঘরের জিনিসপত্র ভেসে যায়। বাঁশ ধরে ধরে কোনমতে পাড়ে উঠে প্রণে বেঁচে যান তিনি। পাশের শেখপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসায় আশ্রয় নিলেও পানি নেমে যাবার সাথে সাথেই চলে আসতে হয় তাদের। বিধ্বস্ত বাড়িঘরে পড়ে থাকা টিনের চালের নিচে তিনি রাত কাটাচ্ছেন। টাকার অভাবে বাড়িঘর মেরামত করতে পারছেন না। ঈদ তার কাছে যেন টপটপ করে ঝরে পড়া বেদনাতুর চোখের অশ্রু।
কথা হয় একই গ্রামের চামেলী বেগমের (৩০) সাথে।

তিনি জানান, স্বামী অসুস্থ, টাকার অভাবে বাড়িঘর ঠিক করতে পারছেন না। এক বেলা আধপেটা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে। ঈদে নতুন কাপড়ের বায়না ধরে কান্নাকাটি করছে সন্তানেরা। সন্তানের প্রতি মায়া ও অভাবের ফেরে পড়ে তার দিশেহারা অবস্থা।

হিমানী ও চামেলীর মতো বন্যাদুর্গত এলাকার অধিকাংশ পরিবার তাদের সন্তানদের ঈদে নতুন কাপড়ের বায়না মেটাতে চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। পুরাতন ও ছেঁড়া কাপড় দিয়েই পাড়ি দিতে হবে তাদের এবারের ঈদ। একটু সেমাই মুখে পড়বে কিনা তাও জানা নেই। ঈদের দিন কুরবানির গোশত পেলে নুন-মশলা দিয়ে তাও একটু পোলাপানদের খাওয়ানো যাবে বলে জানালেন এসব বন্যাদুর্গত গরিব মানুষজন।

ইসলামপুরের পাথর্শী ইউনিয়নের শেখ পাড়া, মন্ডলপাড়া, মুরাদাবাদ ও মরাডুবিসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে ঈদ আনন্দের সামান্যতম ছিটেফোঁটাও নেই। ঘরে ঘরে নতুন কাপড়ের বায়নায় অবুঝ শিশুদের কান্নার আওয়াজ আর পিতামাতাদের নিরব আহাজারি।

(আরকে/এসপি/আগস্ট ০৪, ২০১৯)