রণেশ মৈত্র


২০১৯ সালের পবিত্র ঈদ-উল-আযহা অত্যাসন্ন। এই উপলক্ষ্যে লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে নিজ নিজ চাকুরীস্থল, ব্যবসাকেন্দ্র, শিক্ষাঙ্গন প্রভৃতি ছেড়ে দিন কয়েকের জন্য ট্রেনে, বাসে, ষ্টিমারে ছুটবেন নানা জেলা-উপজেলা শহরে, গ্রামে-গঞ্জে সারাটি দেশ জুড়ে। যাত্রা কার্য্যত: সুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই কারণ ঈদের আর মাত্র কয়েকটি দিন বাকী।

ঈদ আমদের জাতীয় উৎসব ধর্মীও উৎসব যদিও। তাই এই উৎসব জাতির মনকে নাড়া দেয়, তাকে আন্দোলিত করে। কোরবানীর পশু কিনবার উৎসাহ, আপনজনদের সাথে মিলিত হবার আনন্দ, ঈদের মাঠে বা মসজিদে মসজিদে ঈদের জমায়য়েত হাজার হাজার পরিচিত অপরিচিত মানুষের সাথে আলিঙ্গন, কুশল বিনিময়, দরিদ্রজনদের ও স্বজনদের মধ্যে মাংস বিতরণী বিনিময়। অনেকে মিলে বসে নানা বিচিত্র আয়োজনের আহার গ্রহণ সবটাই এক বিচিত্র ধররে আনন্দের পরিবেশ রচনা করে।

কিন্তু দেশে যেভাবে ডেঙ্গুর মহামারীর বিস্তার লাভ ঘটেছে তাতে ঈদ যাত্রা থেকে শুরু করে অপরাপর সব কিছুই শংকাময় হয়ে পড়েছে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে। ডেঙ্গুর যন্ত্রণায় তার ভয়াবহতা, চিকিৎসার দুর্লভতা, আপনজনদের অকাল মৃত্যু ঈদের তাবৎ আন্দকে ম্লান ও বিবর্ণ করে তুলেছে যেন।

এই মুহুর্তে আমার হাতের কাছে থাকা সংবাদপত্রগুলির মধ্যে একটি প্রাচীন দৈনিকের ৫ আগষ্ট তারিখের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত তিন কলামব্যাপী শিরোনামের বলা হয়েছে, “মশা মারার ওষুধ আমদানি কার্য্যকর কোন পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয়।” ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে ঐ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাতে অপর একটি খবরের শিরোনামে দেখছি “গবেষণা রিপোর্ট কার্যকর হয় নাঃ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ১৩ উপায়” একই পৃষ্ঠায় প্রকাশিত অপর একটি খবরের শিরোনাম, “সারাদেশে ডেঙ্গুতে ২৪ ঘন্টায় অতিরিক্ত আই.জি.পি’র স্ত্রীসহ ৭ জনের মৃত্যু।” একই দিনে প্রকাশিত একই পত্রিকার অপর একটি রিপোর্টের শিরোনাম, “এডিস মশা বাড়ার আতংকে রাজধানীবাসীঃ গরুর হাটে ওষুধ ছিটানো হবে।”

পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় ডেঙ্গু নিয়ে নানাদলের নেতৃবৃন্দের পৃথক পৃথক ভাবে আরও কয়েকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ঈদের প্রাক্কাল ডেঙ্গুর দ্রুত দেশজোড়া বিস্তারে এবং রাজধানী তার একাধিক বা অসংখ্য প্রজনন কেন্দ্রে অনবরত এডিস মশা অপ্রতিরোধ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকায় সাংবাদিকেরা কতই না গুরুত্ব সহকারে একই বিষয়ে একদিনে এতগুলি খবর পরিবেশন করেছেন নেহায়েত বিবেকের টানে এবং কর্তৃপক্ষে দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে।

অপরদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুর যে সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করেছেন তাও ঐ পত্রিকা লাল কালিতে প্রথম পৃষ্ঠাতেই প্রকাশ করে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণে উদ্যোগী হয়েছে।

তথ্যগুলি হলো:

* ১ জানুয়ারী ২০১৯ থেকে অদ্য ০৪/০৮/২০১৯ পর্য্যন্ত সর্বমোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৪,৮০৪ জন।

* ১ জানুয়ারী ২০১৯ থেকে অদ্য ০৪/০৮/২০১৯ পর্য্যন্ত সর্বমোট ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ১৭,৩৮৮ জন।

* বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারী ও বে-সরকারী হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭,৩৯৮ জন।

* ঢাকার ৩৭ টি সরকারী বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৪,৯৬৯ জন।

* অন্যান্য বিভাগে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২,৪২৯ জন।

* ২৪ ঘন্টায় ০৪/০৮/২০১৯ নতুন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১,৮৭০ জন।

* এ পর্য্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ২৮ জন।

* মোট আক্রান্তের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে।

এর পরেও মানুষের আতংকিত না হওয়ার কোন কারণ আছে কি? বস্তুত: মোট আক্রান্তের সংখ্যা যদিও দেশের হাসপাতালগুলির যে ছবি নানা সংবাদপত্রে ফটো সাংবাদিকেরা তুলে ধরছেন তা তো মিথ্যা নয়। আক্রান্তের সংখ্যা তো সরকারী দপ্তর থেকেই জানানো হচ্চে। তা হলে ‘আতংক’ অন্তত: পক্ষে ডেঙ্গুর ব্যাপারে, কোন কেউ যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়াচ্ছে না তা স্পষ্ট।

এই নিয়ে যে ঈদ যাত্রা কতটা উদ্বেগজনক হতে পারে তা তো সহজেই উপলব্ধি করা যায়। ছেলের জন্যে, মেয়েদের আতংক, মায়ের জন্য ছেলে-মেয়েদের আতংক, স্বামীর জন্য স্ত্রীর আতংক, স্ত্রীর জন্য স্বামীর আতংক, স্বজনদের জন্য স্বজনদের আতংক নিয়েই এবারের ঈদ যাত্রা।

শুধুমাত্র ডেঙ্গুই কি? এর উপরে চলছে দেশের নানা আতঙ্কে বন্যা নদী ভাঙনের সাংসরিক উপদ্রব। নদী তীরের মানুষ নিমেষেই ঘর বাড়ী, পশু, ফসলাদি এবং শিশুদেরকে হারাচ্ছে যেন এগুলি সব দৈবলিপি লক্ষ লক্ষ মানুষ এই যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন। সরকারী প্রচারণায়ত্রাণকার্য্য ও বাস্তবে ত্রাণকার্যের মধ্যে বরাবর যথেষ্ট ফারাক বিরাজ করে এবারও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যাচ্ছে না।

সরকারি প্রচারণায় পরিস্থিতি উদ্বেগজনক নয় বলা হলেও মানুষ তাঁদের নিজস্ব অভিজ্ঞতায় সরকারী অভিমতের সাথে বন্যার ক্ষয় ক্ষতি ও বন্যাত্রাণের প্রতুলতা-অপ্রতুলতার প্রশ্নে একমত হতে পারছেন না। এই বন্যায় তোড় এবারে বিলম্বিত বলা যায় তবে ঈদের বিবেচনায় তা অত্যনত কাছাকাছি হওয়ায় মানুষের মনে ঈদের আনন্দ তেমন একটা দেখা যাছেনা।

ঈদ যাত্রা স্বাভাবিক হবে বলে সড়ক ও সেতু মন্ত্রী প্রতি বছরই বলে থাকেন এবারও বলছেন। সে যাত্রা তো শুরু হয়ে গেছে দিন কয়েক আগেই। যদি বাস-ট্রেন-লঞ্চের টিকিটের কথা বলি তা বরাবরের মতোই যাত্রীদের কাছে দুষ্প্রাপ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। আবার এবারই প্রথম যে পরিবহন মালিকেরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে ঈদ উপলক্ষ্যে সরকারীভাবে ভাড়া বাড়ানোর (মৌসুমী বৃদ্ধি) আবদার জানিয়েছেন যদিও সরকার তাতে সায় দেন নি। কিন্তু বাড়তি ভাড়া আদায় তো বন্ধ নেই-চলছে তা নানা কৌশলে। তবে পরিবহন মালিকেরা এ ব্যাপারে এবারের ঈদে অনেকটা সমঝে চলার নীতি নিয়েছেন বলে মনে হয়।
অদ্ভুতই বটে। মালিকাদের আয় দুই দুটি ঈদে প্রতি বছরই বাড়ে। রাস্তায় নামানো হয় বিপুল সংখ্যক লক্কড়-ঝক্কর মার্কা গাড়ি। চালকরা অনেকেই প্রশিক্ষণ নন। তাদের বেতন ভাতাও কল্পনাতীতভাবে কম। তবুও যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া কেন বইতে হবে তা ভাবতেও অবাক লাগে।

অপর পক্ষে ঈদকে কেন্দ্র করে হাটে-বাজারে, লঞ্চ-বাস টার্মিনাল সমূহে, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্য্যগুলির সামনে রাস্তায় ছালা পেতে “ভিক্ষা চাই” বলে ভিক্ষুকদের আর্ত চীৎকার যেন অন্যান্য বছরের চাইতে বেশী। ভিক্ষুকদের এমনতরো আর্তনাদ সরকারের উন্নয়ন জোয়ারের দাবীকে যেন ব্যঙ্গই করে চলেছে। এর অর্থ এই নয় দেশে কোন উন্নয়ন ঘটছে না-তা নয়-রবং দৃশ্যত:ই তা ঘটছে। কিন্তু কুণ্ঠাহীনভাবে স্বীকার করতে হবে সরকারকে যে ঐ উন্নয়নের ছোঁয়া শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষকে স্বার্থ করতে পারছে না।

৯৫ ভাগ মানষ চেয়ে চেয়ে দেখছে চারিদিকে নিত্যনতুন বহুতল বিশিষ্ট দালান কোঠা নির্মিত হচ্ছে চোখ ধাঁধানো আলো ঝলমল অসংখ্য বিপণী গড়ে উঠছে অপরদিকে দিব্যি বহাল তবিয়তে বজায় রয়েছে অসংখ্য ঝুপড়ি যাতে আস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশেই প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য শিশু তেমনি আবার বিনা চিকিৎসায় তাদের মৃত্যুও ঘটে চলেছে। আরও বিভৎস ব্যাপার হলো-ধনীর তনয়েরা দিব্যি পুলিশের সহায়তা নিয়ে রাতের আঁধারে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে বস্তি এলাকাগুলিকে। হাজার হাজার নারী-পুরুষ শুধুমাত্র দারিদ্র্যের কারণে নিমেষেই গৃহহীনতা, সহায় সম্বলহীন জনগেধষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছেন সীমাহীন অসহায়তার মধ্যে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন খোলা আকাশেল নীচে। তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে বেশ কিছুদিন সরকারী পুনর্বাসনের ব্যাপারে যে কিছুদিন করাকারী কর্তাব্যক্তিদের কথা বলতে শুনা গেলেও তা থিতিয়ে যেতে তেমন একটা সময় লাগে না।

যা হোক ঐ ৯৫ ভাগ মানুষের জন্য ঈদ আদৌ কি কোন আনন্দ বারতা বয়ে আনতে সক্ষম হয়? তাদের মধ্যে কতজনের ভাগ্যে এই উৎসবে নতুন কাপড় কেনা সম্ভব হয়, কতজন কোরবানী পশু কিনতে পারেন তা নিয়ে কিন্তু সরকারি বেসরকারি কোন গবেষণা নেই। তবে সাদা চোখে যা ধরা পড়ে তাতে বলা যায়, শহরে অন্তত: ৭০ ভাগ, গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষই পশু কোরবানী দিতে সক্ষম নন।

এবার এই পরিস্থিতির মধ্যে সর্বাধিক কৌতুক অনুভব করেছেন দেশের সকল স্তরের মানুষ যখন তাঁরা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় দেখেন প্রধান নির্বাচনী কমিশনার সহ ৪ শত উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা পবিত্র হজ্ব ব্রত পালনের জন্য সরকারিভাবে সৌদি আরব গেছেন। এই কর্মকর্তারা উচ্চ বেতন এবং নানাবিধ উচ্চ সুবিধাভোগী। তবুও সরকারি খরচে তাঁদেরকে হজ্ব আদায়ের পাঠানোই বা হলো কেন তাঁরাই বা গেলেন কিভাবে? একদিকে বক্তৃতা-ভাতা অপরদিকে সরকারি টাকায় হজ্ব এগুলি সবই অভিনব।

সম্ভবত: অভিনব পদ্ধতিতে “সুষ্ঠু” নির্বাচন পরিচালনার জন্য অভিনব পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হলো তাঁদেরকে তাঁদের নিরপেক্ষতা করে প্রশ্নবিদ্ধই হলো না শুধু ঈদের প্রাক্কালে এই তামাশ দরিদ্র প্রাণ মানুষকে বেদনার্ত করেছে মাত্র।

ঈদের বাজার শুরু হয়েছে। বাজারে আগুন। মাছ, মাংস, গরু, খাসি, মুরগী, ডিম, মসলা, ফলমূল এমনকি চাল, ডাল, শাক-সবজি, তরী-তরকারী প্রভৃতির বাজারে আগুন যার কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না।

একই মাসে বাজার বৈষম্যও চোখে পড়ার মত। চোখ ঝলসানো বিপনীগুলিতে দিব্যি লাল-নীল আলোর বিজ্ঞাপন ইলেক্ট্রনিক পণ্য সমূহের দ্রব্যের মূল্যে নানা আকর্ষনীয় পুরস্কার ও কমিশন ঘোষণা করে। যেন ঐ বিজ্ঞাপনগুলিও ৯৫ভাগ মানুষকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছে কারণ ঐ মূল্যহ্রাসের সুযোগ তো পাবেন ধনীর দুলালেরাই।

দেশটাতো তাদেরই কেনা। আর ত্রিশ লক্ষ শহীদ পরিবার এই ধনিকদের ধনী থেকে অধিকতর ধনী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্যেই একাত্তরে প্রাণের বিনিময়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছিল যেন।

তবুও প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদেরকে জানাই পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা একটি বৈষশ্যহীন, দুর্নীতি বেকারত্ব ও অশিক্ষামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।