চৌধুরী আবদুল হান্নান


আধুনিক সমাজে পারিবারিক বন্ধন ক্রমশ শিথিল হয়ে যাচ্ছে, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে দ্রুত। পরিবারে অবহেলার শিকার হচ্ছেন প্রবীণেরা। বার্ধক্যে পা দিলে তার মধ্যে পরনির্ভরশীলতা দেখা দেয়। শারীরিকভাবে অসমর্থ, অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, অসহায়ত্ব নানা কারণে অন্যদের মানসিক যন্ত্রনা দেয়া, সবই বার্ধক্যের অবশ্যম্ভাবী পরিনতি। তারা এমনিতেই পরিবারের বাড়তি বোঝা! তারপর যদি ওই লোকটির কোনো অর্থ না থাকে বা আয় কমে যায় তাহলে এ বোঝা অনেক ক্ষেত্রে সন্তানরাও বহন করতে চায় না।

প্রবীণেরা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীগণ একটু বাড়তি মুনাফা পাওয়ার আশায় বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন। যারা অবসরোত্তর প্রাপ্ত অর্থ হাতে পেয়ে সঞ্চয় পত্র কেনেন, স্ত্রীর নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনেন তারা খুবই নিরিবিলি গোছের মানুষ। তারা অপরের ওপর ভরসা না করে ভদ্রভাবে জীবনের পড়ন্ত বেলাটা নির্ঝঞ্জাট কাটাতে চান।

কিন্তু সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার দফায় দফায় কমানো হচ্ছে, ফলে এর চাপটা পড়ছে মূলত প্রবীণদের ওপর, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওপর। আমাদের প্রশ্ন- অর্থের ঘাটতি মেটাতে ঋণ খেলাপি আর কর খেলাপিদের ছাড় দিয়ে অসহায় প্রবীণদের ওপর “ট্যাক্স” বসালে সরকারের কতটা আর্থিক সাশ্রয় হবে?
ডুবন্ত ব্যাংক ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার জনগণের কাছ থেকে আদায় করা ট্যাক্স থেকে ভর্তুকী দিয়ে চলেছে কিন্তু ঋণ খেলাপিদের টিকিটিও ধরতে পারছে না। সবলকে পাকরাও করতে ব্যর্থ হয়ে দুর্বলদের দিকে হাত বাড়ানো হচ্ছে।

২০১৫ এর মে মাসে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার আর এক দফা কমানো হয়। তখন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী সঞ্চয়পত্রের মুনাফা না কমিয়ে ঋণ খেলাপিদের বিষয়ে সরকারের তৎপরতা বাড়ানো ভালো বলে মন্তব্য করেছিলেন এবং অর্থমন্ত্রীকে এ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবারও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।
প্রায় চার বছর পর সরকারের আয় বাড়াতে আবারও প্রবীণদের পকেটে হাত পড়লো, এবারও সাবেক কৃষিমন্ত্রী জাতীয় সংসদে একই মনোভাব প্রকাশ করলেন। প্রবীণেরা পরিবারে, সমাজে কতটা অসহায় তা মতিয়া চৌধুরী অনুধাবন করেছেন। কিন্তু সবচেয়ে ক্লিন ইমেজের একজন প্রবীণ রাজনীতিকের পরামর্শ/মতামত গ্রহণ করা হয়নি, সংসদে আর কেউ প্রবীণদের পক্ষে এভাবে কথা বলেছেন কিনা শুনিনি।

এক্ষেত্রে ড. মইনুল ইসলাম (অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) এর কথামনে পড়ে যাবে, তিনি ঋণ খেলাপিদের বিষয়ে বলেন, “তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং আর্থিক প্রতাপ দিয়ে তারা শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, দেশের সংসদকেও দখল করে ফেলেছেন।”

বিজ্ঞ মানুষের পরামর্শ বাদ দিয়ে অনাভিজ্ঞ, স্বার্থ উদ্ধারে অন্ধ তোষামোদকারীদের মতামতকে গুরুত্ব দিলে সুদূর প্রসারী ফল ভালো হয় না। অনেক আগেই সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুন করে দেয়া হয়েছে, তাদের ঘরে স্বচ্ছলতা ফিরেছে। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের সুখের খবর নেই, আছে বেদনার খবর। তারা তো একদিন রাষ্ট্রের সেবা করেছেন, এখন তো তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার উপকরণটুকু প্রত্যাশা করতেই পারেন।

একদিকে দ্রব্য মূল্যেও উর্ধগতি, অন্যদিকে তাদের প্রাপ্তির নিম্নগতি এবং পরিবারের অবহেলা তাদেরকে এক নিদারুন বিষন্নতার দিকে নিয়ে যাবে। বাড়তি পাওয়া নাই-ই হলো, বিদ্যমান প্রাপ্তি কাটছাট নয়। সকল প্রকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার গত ৩০ জুন পর্যন্ত যা ছিল তা বহাল রাখলেই আপাতত প্রবীণেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।