প্রবীর সিকদার 


১৫ আগস্ট শেষ রাতে আক্রান্ত হবার পর বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, ডিজিএফআই প্রধান কর্ণেল জামিলসহ বেশ কয়েকজনকে ফোন করে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী ঘটনা জানার সাথে সাথেই সেনা প্রধান শফিউল্লাহ ও বিমানবাহিনী প্রধান একে খন্দকারকে ফোন করে দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেনাপ্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধান ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে কর্ণেল জামিল ছাড়া আর কেউ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় এগিয়ে যাননি। সেই রাতে কর্ণেল জামিল জীবন দিয়ে দায়িত্ব পালনের মহৎ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

বিষয়টি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ঘটনা কোনো সেনা বিদ্রোহের ফসল নয়। গোলাবিহীন ট্যাংক সড়কে বের করে আতংক তৈরীর মাধ্যমে কিছু সংখ্যক সেনা পরিচয়ধারী দুর্বৃত্ত এ নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটায়। সেনাবাহিনী ও রক্ষীবাহিনী দ্রুত পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করা না গেলেও খুনিদের আটক করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেতো। কিন্তু সশস্ত্রবাহিনীগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের রহস্যজনক নির্লিপ্ততা খুনিদের সফল হতে সহায়তা করে। এক এক করে সেনাবহিনী প্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী প্রধান, বিডিআর প্রধান, রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান, পুলিশের আইজি রেডিওতে স্বকন্ঠ বিবৃতি প্রচারের মাধ্যমে মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর এক সাক্ষাৎকার সূত্রে জানা যায়, তাকে কেউ অস্ত্রের মুখে রেডিও স্টেশনে নেয়নি; তিনি স্বেচ্ছায় রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। রেডিও স্টেশন থেকে সেনা হেড কোয়ার্টারে ফিরে শফিউল্লাহ সেনা কর্মকর্তাদের বলেন, ‘যা হয়েছে-হয়েছে। বাট নাউ ইউ অল রিমেইন ইন ইউর রেসপেকটিভ ইউনিটস। নো ওয়ান স্যুড গো আউট অব ক্যান্টনমেন্ট স্টিল ফারদার অর্ডার।’

আতংক সৃষ্টির জন্য গোলা বিহীন যে ট্যাংকগুলো সড়কে নামানো হয়েছিলো, ১৫ আগস্ট দুপুরের পর ওই ট্যাংকগুলোতে গোলা সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।

সেনাবাহিনীর ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্ণেল শাফায়াত জামিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে পরদিন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর কাছে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ চেয়েছিলেন। শাফায়াত জামিল ক্ষুব্ধ কন্ঠেই বলেছিলেন, ‘অ্যাজ ইউ আর দ্য আর্মি চিফ, আই ওয়ান্ট অর্ডার ফ্ররম ইউ – আই উইল ওয়াশড আউট অফ অল মার্ডারার্স উইথইন হাফ অ্যান আওয়ার। মাই ব্রিগেড ইজ রেডি। ইফ ইউ আর আনেবল টু পাশ দ্য অর্ডার দ্যান ইউ লিভ দ্য চেয়ার এন্ড আক্সড ডালিম টু সিট ‍ইওর চেয়ার অ্যাজ আর্মি চিফ।’ সে সময় কোনো উত্তর দেননি সেনাপ্রধান। সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ‘ইট ইজ নট এ ম্যাটার অব সেন্টিমেন্ট’ বলে শাফায়াত জামিলকে শান্ত করেন। এখানে লক্ষনীয় যে, সেনাসদরে যদি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সমর্থক সংখ্যা বেশি হতো তাহলে শাফায়াত জামিলের পক্ষে এতোটা শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা সম্ভব হতো না।

পরে অবশ্য শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধানের পদ ছাড়তে হয়েছিল। ওই পদে আসীন হন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু খুনের বেনিফিসিয়ারি সরকার শফিউল্লাহকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়।

ট্যাংক তাক করে ওই রাতে রক্ষীবাহিনীকে খানিকটা বিভ্রান্ত করা গেলেও তাদের প্রস্তুতি ছিল পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের। কিন্তু তারা কোনও নির্দেশ পায়নি। রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ওই সময় আমেরিকায় প্রশিক্ষণে ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাকর্মকর্তা লে. কর্ণেল আবুল হাসান অনেকটাই পালিয়ে থেকে দায়িত্ব এড়িয়েছেন। রক্ষীবাহিনীর স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ। তিনি এতোটাই শোকবিহবল ছিলেন যে, রক্ষীবাহিনীকে তিনি কোনো নির্দেশ দেননি বা দিতে পারেননি। অবশ্য তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, তিনি নির্দেশ দিলেও রক্ষীবাহিনী তা পালন করেনি।

পিতা! তোমাকে রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ ওই সব শীর্ষকর্তা কেন তোমার খুনিদের চলার পথ মসৃন করেছিলেন তা আজও রহস্যে ঘেরা। আমিও সেই রহস্যের জালে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে ভেবেছি, মুজিবের চেয়ে আমার বেঁচে থাকাটাই বেশি জরুরি। কী অকৃতজ্ঞ, কী কৃতঘ্ন সন্তান আমি!

পিতা মুজিব, আমায় ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর।