সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মঞ্চস্ত নাটকে মহানবী সম্পর্কে কটুক্তি সম্পর্কিত দৃষ্টিপাত পত্রিকার প্রতিবেদনকে ঘিরে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর ও চাকদহ গ্রামে সহিংসতার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়েছে।

মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক নকীব অয়জুল হক ঘটনার দুবছর চার মাস পর বৃহস্পতিবার আদালতে এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় দৃষ্টিপাত সম্পাদক জিএম নূর ইসলাম, বার্তা সম্পাদক বিএম কামরুল ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক আবু তালেব মোল্লা, দৃষ্টিপাতের দক্ষিণ শ্রীপুর প্রতিনিধি অস্ত্রধারী শিবির ক্যাডার মিজানুর রহমান ও কালীগঞ্জে উপজেলার নীলকণ্ঠপুর গ্রামের আব্দুল বারী গাজীর ছেলে মামুনুর রশীদ ওরফে মিণ্টুকে আসামী শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে আসামীদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজসে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার বিবরণে জানা যায়, স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে ২০১২ সালের ২৭ মার্চ কালীগঞ্জের ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল আল মুনসুর এর লেখা ‘হুজুরে কেবালা’ গল্পে শাহীনুর মীরের নাট্যরুপ দেওয়ার পর মঞ্চস্থ করার সময় মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে মর্মে ২৯ মার্চ দৈনিক দৃষ্টিপাত পত্রিকার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

৩০ মার্চ সকাল ১১টায় কালীগঞ্জ পোস্ট অফিস মোড়ে মৌলবাদীদের মিছিলে কালীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ ওয়াহেদুজ্জামান ছাড়াও দল থেকে বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাড. মোজাহার হোসেন কাণ্টু উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন। দুপুর একটার দিকে বিএনপি নেতা নুরুজ্জামান পাড় শিক্ষক মিতা রানী বালাকে মোটর সাইকেলে করে বাড়ি থেকে তুলে এনে পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে প্রধান শিক্ষক রেজোয়ান হারুনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই দিন বিকেলে দক্ষিণশ্রীপুর ইউপি সদস্য জাফর সাফুইকে দিয়ে নাটক পরিচালনাকারি মীর শাহীনুর রহমানসহ সাত জনের নামে থানায় মামলা করান তৎকালিন কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদ উদ্দিন। এ ঘটনায় ২ এপ্রিল নাটকে অংশ নেওয়ার অভিযোগে ছাত্র সাঈদুর রহমানকে শ্যামনগরের কৈখালি থেকে গ্রেফতার করা হয়।

এদিকে মহানবীকে কটুক্তি করার গুজবে কৃষ্ণনগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন ও বর্তমান চেয়ারম্যান আনছারউদ্দিনের নেতৃত্বে দু’টি মিছিল ৩১ মার্চ সকালে ফতেপুর মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভাঙচুর চালায়। মিছিল থেকে শাহীনুর মীর ও তার ভাইদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাটের পর আগুন জালিয়ে দেওয়া হয়। এরপর হাকিম সরদারের বাড়ি ভাঙচুর করে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগানো হয়। ভাঙচুর ও লুটপাটের পর জেল হাজতে থাকা মিতা বালার ঘরবাড়ি, ফতেপুর সাংস্কৃতিক সংঘ ও লক্ষীপদ মণ্ডলের বাড়ি ভাঙচুর করে লুটপাটের পর দ্বিতীয় দফায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। দ্বিতীয় দফা অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দেন জাপা নেতা জুলফিকার সাঁফুই, তার ভাই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বাদি জাফর সাঁফুই, বিষ্ণুপুরের জামায়াত ক্যাডার রবিউল ইসলাম।

ফতেপুরের সহিংসতার জের ধরে ২০১২ সালের ১ এপ্রিল চাকদহ গ্রামের কাপালিপাড়ায় মহানবীকে কটুক্তি সংক্রান্ত আনোয়ারা খাতুনের গুজবে ফতেপুরের লক্ষীপদ মণ্ডলের মেয়ে নমিতা সরদারের কথার সত্যতা যাচাই এর নামে গণপতি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ কবীর কাজল, বিএনপি নেতা গোলাম মাসুদ, যুবলীগ নেতা রিয়াজুল ইসলাম খোকা, কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক এমদাদ হোসেন, সহকারি উপপরিদর্শক বসির আহম্মেদসহ কয়েকজনের উস্কানিতে নমিতা সরদারসহ আটটি হিন্দু বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর করে তাদের সর্বস্ব প্রেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

সহিংসতার ঘটনায় ৫ এপ্রিল পুলিশের পক্ষ থেকে দু’টি, হাবিবুর রহমান ও কালীগঞ্জ থানা যুবলীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক খলিলুর রহমান বাদি হয়ে মোট চারটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৯৪ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা দু’ হাজার ২০০ লোককে আসামি শ্রেণীভুক্ত করা হয়। কর্তব্যে অবহেলার দায়ে কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক লস্কর জায়াদুল হককে বাগেরহাটে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। ৪ এপ্রিল বিকেলে কালীগঞ্জের ফুলতলা মোড়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত শান্তি মিছিলে সহিংসতা সৃষ্টিকারি কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান আনছার আলীকে বিশেষ অতিথি হিসেবে মনোনীত করা হয়।

৬ এপ্রিল নাগরিক অধিকার ও সমন্বয় কমিটির ব্যানারে সাধারন সম্পাদক হিসেবে দৃষ্টিপাত পত্রিকার সম্পাদক জিএম নূর ইসলামকে নিয়ে ফতেপুরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পিছু ১০ কেজি করে চাল দিতে গেলে সর্বস্ব হারানো লক্ষীপদ মণ্ডল তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। একই দিনে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তদন্তকারি সেলের সদস্য অ্যাড. আবু আহম্মেদ ফয়জুল কবীর ও অ্যাড. তপতী ভট্টাচার্যসহ বামপন্থী নেতারা ফতেপুর ও চাকদাহের সহিংসতা কবলিত বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানগুলি পরিদর্শন করে বিষ্ময় প্রকাশ করে শিক্ষক ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে গ্রেফতার করানোর পুলিশের বিরুদ্ধে নিন্দা জানান।

৮ এপ্রিল জেলা বাসদের সমন্বয়ক নিত্যানন্দ সরকার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে গ্রেফতারকৃত শিক্ষক ও ছাত্রের নিঃশর্ত মুক্তি, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, সরকারি অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফতেপুর সাংস্কৃতিক পরিষদ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পুণঃনির্মাণ, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদান ও ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করা হয়। একই দিনে তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়। ১০ এপ্রিল তৎকালিন জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের নির্দেশে দৃষ্টিপাত পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করা হয়। ১২ এপ্রিল অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার দৃষ্টিপাত পত্রিকার সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে গাজীপুরের একটি ব্যাচেলার ছাত্রবাস থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

২৫ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে হাইকোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভৎসনা করা হয়। ঘটনার তদন্তে হাইকোর্ট একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই বছরের ১২ জুন অতিরিক্ত যুগ্ম সচিব একেএম জহরুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি সাতক্ষীরা সার্কিট হাউজে তদন্ত শুরু করেন। তদন্তকালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক ও পেশাজীবি সংগঠণের নেতৃবৃন্দ সাক্ষ্য প্রদান করেন। যদিও আজো ওই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। সহিংসতার মামলা থেকে অব্যহতি দেওয়া ও মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার নামে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও পুলিশ বাণিজ্যের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা আদার করে বলে অভিযোগ ওঠে। সরকারি বেসরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পিছু কয়েক দফায় ৭৩ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।

যদিও ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর জামায়াত শিবিরের সহিংসতায় নিহত মানবাধিকার কর্মী মোসলেম আলীর সঙ্গে থাকা একটি লাঠির বাড়ি খাওয়া আলী হোসেন ও দিদারসহ অনেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে দু’ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।

এছাড়া মঞ্চস্ত নাটকে মহানবীকে কটুক্তি করার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় (জিআর-৭৯/১২) তদন্তকারি কর্মকর্তা (তদন্ত) মো. আক্তারুজ্জামান গত বছরের ৩০ জুলাই আদালতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। যদিও ওই মামলার বাদি সহিংসতার ঘটনায় এজাহার ও অভিযোগপত্রে অর্ন্তভুক্ত জাফর সাফুই আদালতে নারাজির আবেদন করায় গত এক বছর ধরে শুনানীর অপেক্ষায় কাঠগড়ায় ছুঁটে যাচ্ছেন শিক্ষক রেজোয়ান হারুন, মিতা রাণী বালা ও ছাত্র সাঈদুর রহমান। ফতেপুরের সহিংসতার ঘটনায় উপ পরিদর্শক ইয়াছিন আলম চৌধুরী, হাবিবুর রহমান ও চাকদাহে উপ পরিদর্শক লস্কর জায়াদুল হকের দায়েরকৃত (জিআর-৮৫/১২, জিআর-৮৬/১২ ও জিআর ৮৭/১২) মামলায় গত বছরের শেষের দিকে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

অভিযোগপত্রে নানা অনিয়মের অভিযোগে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের তৎকালিন পিপি ও বর্তমানে সাংসদ অ্যাড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ আদালতে না রাজির আবেদন দাখিল করেন। যা আগামিতে বাদির উপস্থিতিতে শুনানীর দিন ধার্য আছে। এ সহিংসতার পত্রিকা কর্তৃপক্ষসহ মূল হোতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় বৃহস্পতিবার আদালতে ( ধারা-১৫৩/২৯৫-ক/১২০-৮/৩৪ পিসি) অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার প্রধানদের অভিযোগ, খলিলুর রহমানের দায়েরকৃত মামলার পর মৌতলার জনৈক সমাজসেবক দৃষ্টিপাত পত্রিকার সম্পাদক জিএম নূর ইসলামের নামে থানায় একটি সাধারন ডায়েরী করেন। সে অনুযায়ি ওই অভিযাগটি মূল মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে জিএম নূর ইসলামকে আসামী শ্রেণীভুক্ত করা হয়। গত ২৮ মাসে এ মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা হিসেবে উপপরিদর্শক লস্কর জায়াদুল হক, উপপরিদর্শক জসীমউদ্দিন, উপপরিদর্শক ইয়াছিন আলম চৌধুরী, উপপরিদর্শক আক্তারুজ্জামন, উপপরিদর্শক বিপ্লব কুমার সাহা ও উপপরিদর্শক নকীব অয়জুল হক দায়িত্ব পালন করেছেন।

তদন্তের প্রথম থেকেই কেস ডায়েরীতে উল্লেখিত দৃষ্টিপাত পত্রিকার সম্পাদক জিএম নূর ইসলাম, বার্তা সম্পাদক বিএম কামরুল ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক আবু তালেব মোল্লাকে ঘটনার জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ তারা প্রকাশ্যে সভা, সমাবেশ ও নিজ কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করে বুক ফুলিয়ে বেড়ালেও পুলিশ আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করেনি। এ ছাড়া ফতেপুরের সহিংসতার ঘটনায় অভিযোগপত্রে উল্লেখিত আসামী নূরুজ্জামান পাড়সহ ২৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

মামলার বাদি খলিলুর রহমান জানান, দেরিতে হলে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এ মামলায় পলাতক সকল আসামীদের গ্রেফতার করে জরুরী ভিত্তিতে বিচারান্তে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।

(আরকে/জেএ/জুলাই ৩১, ২০১৪)