রণেশ মৈত্র


বিগত ২২ আগস্টের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় উগ্যোগের গত বছরের প্রথম উদ্যোগের মতই ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হয়েছে। আগস্ট দিবাগত রাত্তিরে রোহিঙ্গাদের কোন কোন আশ্রয় শিবিরে উদ্যোগটি ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হওয়ায় উল্লাস প্রকাশ করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে কোন কোন গণমাধ্যমে।

২৫ আগস্ট তারা আরাকানে রোহিঙ্গা নির্য্যাতন ও গণহত্যা দিবস পালন উপলক্ষ্যে একটি শিবিরে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার একটি বিশাল সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গ আলোচনার সুযোগে বক্তারা পাঁচ দফা দাবী উত্থাপন করলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁদের প্রত্যাবাসনের। সমাবেশে রাজনৈতিক ভাষা ও প্রকাশ পেয়েছে এবং তার আমেজও লক্ষ্য করা গেছে।

সাধারণভাবে বক্তারা বাংলাদেশের প্রতি তাঁরা কৃতজ্ঞতা করেছেন বিপদের মুহুর্তে তাঁদেরকে বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয় দেওয়ার জন্য কিন্তু ক্ষুদ্র আয়তন বিশিষ্ট, অত্যধিক ঘনবসতি সম্পন্ন বাংলাদেশের মানুষের সমস্যা দীর্ঘায়িত না করে তা কমিয়ে এনে এ দেশের মানুষকে সংকটমুক্ত করার কোন রকম আগ্রহও নেতাদের বক্তব্যে প্রকাশ পায় নি। ভাবখানা এমন যেন মিয়ানমার সরকার যদি দাবীগুলি মানতে ১০০ বছর বিলম্ব করে তবে ঐ একশত বছরই তারা এদেশে থেকে যাবে। তাতে এ দেশের মানুষের যত অসুবিধা, যত কষ্ট হয় হোক তাতে তাদের কোন ধর্মপীড়া নেই।

আমরা নিশ্চয়ই জানি, কক্সবাজারের আদি বাসিন্দাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ। এই পাঁচ লক্ষ মানুষের উপর চেপে বসেছেন প্রায় ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা-অর্থাৎ বিদেশী। ফলে ঐ এলাকাগুলিতে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্য্যয় ঘটছে নানাভাবে। গাছ-গাছালি কেটে জ্বালানি হিসেবে ও আশ্রয় শিবির নির্মাণ কাজে ব্যবহার, পাহাড় কেটে জায়গা বের করে সেখানে অসংখ্য আশ্রয় শিবির নির্মাণ, তের লক্ষ আগন্তুকের মলমূত্র ত্যাগের কোন বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা না থাকায় এলাকাবাসীর উপর স্বাস্থ্য বিপর্য্যয়ের আশংকা, নিত্য ব্যবহার্য্য দ্রব্যাদির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, মওজুদদারী-মুনাফা খোরদের অবৈধ আয়ের পথ প্রশস্ত হওয়া, অত্যাধিক যান বাহনের চাপ সরু রাস্তাগুলির উপর বেড়ে যাওয়া, সন্ত্রাসী উপদ্রবের ক্রমাগত বৃদ্ধি এগুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে কমন বাজারের আদি বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী। খবর এমনও আছে যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার কথা বলার অজুহাতে স্থানীয় কাউকে কাউকে খুন পর্য্যন্ত করেছে রোহিঙ্গা উগ্রপস্থীরা। কেউ কেউ আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরাও পরছেন ফৌজদারী মামলার আসামী হওয়ায়।

মিয়ানমারের সাথে নিকটতম সীমান্তবর্তী দেশ বাংলাদেশ। আর তার সুযোগেই বিপদের মুহুর্তে দলে দলে এবং দফায় দফায় তাঁরা পোঁটলা পুঁটাল বেঁধে শিশুদের হাত ধরে বাংলাদেশে চলে আসছেন-প্রত্যাবাসনে সংকট ও জটিলতা ততোধিক বাড়ছে দিনকে দিন।

অপরদিকে এক শ্রেণীর অসাধু সরকারী কর্মকর্তা ও দালালের হাত ধরে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে (অর্থাৎ বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয় দিয়ে) দিব্যি অনেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। সীমাহীন দারিদ্রে ভুগতে থাকা রোহিঙ্গারা, যাঁদেরকে বছরের পর বছর ধরে বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে, দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে আশ্রয় ও চিকিৎসা তাঁরা কিভাবে “ভোরের কাগজ” এর ২৯ আগস্ট তারিখে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার ঘুষ দিয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে কি করে, অত টাকা তাঁরা পাচ্ছেন কোত্থেকে এ প্রশ্নগুলি গভীরভাবে ভাবার বিষয়।
“তিন দালালের হাত ধরে বিদেশ যাচ্ছে রোহিঙ্গারা” এই মর্মে তিন কলাম ব্যাপী ঐদিনের ভোরের কাগজে বলা হয়ঃ

কক্সবাজার সদরের খুরুমকুর এলাকার রুহুল্লা ডেইল নামক গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা সুলতান। ইয়াসিন নামে একটি মেয়ে রয়েছে তার। চলতি বছরের সুরুতে হঠাৎ করে তার কাছে এক রোহিঙ্গা মৌলবী এসে বলেন, এক রোহিঙ্গা নারীর নাম ইয়াসমিন। সে পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে যেতে চায়। তোমার মেয়ের নামও তো ইয়াসমিন। এখানে শুধু ছবি পরিবর্তন করে দিলেই পাসপোর্ট করতে পারবে সে। এর বিনিময়ে তুমি অনেক টাকা পাবে। টাকার কথা শুনেই লোভে পড়ে যান সুলতান। এই রোহিঙ্গা নারীর ছবি দিয়ে শুরু করেন পাসপোর্ট তৈরীর কার্য্যক্রম।

সব শেষে পুলিশ ভেরিফিকেশনে তাকে ডাকা হলে সঙ্গে নেন নি ইয়াসমিনকে। পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে, সে হাসপাতলে আছে বলে জানা সুলতান। সন্দেহ বাড়ে পুলিশের। পরে তাকে গ্রেফতার করা হলে বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য। কিন্তু গ্রেফতার হয় নি রোহিঙ্গা নারী ইয়াসমিন। অন্য দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এক সময় শুধু কক্সবাজার থেকেই দেদার পাসপোর্ট বানালেও এখন সারা দেশ থেকেই তৈরী হচ্ছে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট। শুধু পর্য্যাপ্ত টাকা থাকলেই হাতের মোয়ার মত সহজ হয়ে গেছে পাসপোর্ট তৈরীর কাজ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত: তিন দালাল চক্রের হাত ধরে বর্তমানে পাসপোর্ট তৈরী করছে রোহিঙ্গারা। তাঁরা হলো, কক্সবাজার জেলায় পাহাড়তলি থানার ইসলামপুর গ্রামের মৌলবী নূর হোসেন, ৭ নং ওয়ার্ডের সাত্তারঘানা গ্রামের আবদুস ছবির ছেলে হাফেজ আহম্দে ও রামু থানার ৬ নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ মিটাছড়ির নিজেরপাড়া গ্রামের নূরুল ইসলামের ছেলে সাইফুল ইসলাম। এদের মধ্যে প্রথম দুইজন রোহিঙ্গা। অনেক বছর আগে থেকেই বসত বাড়ী গড়ে তুলে পাসপোর্ট তৈরীর কাজ করছে তারা।
এখানে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তোলা যায়। এই হাজার হাজার অবৈধ পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের প্রত্যেকের পাসপোর্ট করতে ৫০,০০০ থেকে এক লক্ষ টাকা লাগে। পাসপোর্ট পাওয়ার পর বিদেশে তেতে তো আরও বেশী টাকা লাগে। এই বিপুুল পরিমাণ টাকার উৎস ঐ অসহায় রোহিঙ্গারা কোথায় পেলেন। তদন্ত হোক ব্যাপক ও নিরপেক্ষভাবে। যে সরকারী কর্মকর্তারা ঐভাবে এতগুলি পাসপোর্ট করে দিচ্ছেন তাঁদের সম্পদের পরিমাণ যাচাই করা ও বে-আইনী কাজ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে অবিলম্বে গ্রেফতার ও কঠোর সাজা প্রদান ও অত্যন্ত জরুরী। তিন বা আরও বেশী দালাল থাকলে তাদেরকেও পাকড়াও করে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করাও প্রয়োজন।

বহুল প্রচারিত অপর দৈনিক “বাংলাদেশ প্রতিদিন” বিগত ৩০ আগস্টে প্রকাশিত প্রথম পৃষ্ঠার তিন কলামব্যাপী লাল কালি শিরোনামে প্রধান খবর “মুহিবুল্লাহ্ যেভাবে রোহিঙ্গাদের নেতা” শিরোনামে লিখেছে:-

“রোহিঙ্গা ইস্যুতে বর্তমানে আলোচিত একটি নাম মুহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গাদের যত সংগঠন ও নেতা রয়েছেন তাদের সবাইকে ছাপিয়ে গেছে মুহিবুল্লাহ্ ও তার সংগঠন “আরাকান রোহিঙ্গা এসোসিয়েশন ফর সি এন্ড হিউম্যান রাইটস”। ইউ এন এইচ সি আর এর কক্সবাজার অঞ্চলে নিয়োজিত কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকা মুহিবুল্লাহ এখন উখিয়া-টেকনাফের ৩২ টি রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে আছেন। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে সাক্ষাত করে আসার পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কর্মসূচী প্রায় এককভাবেই ঠেকিয়ে দিয়েছেন। পরে লাখো রোহিঙ্গার সামাবেশ ঘটিয়ে আলোচনার তুঙ্গে এনেছেন নিজেকে। বিদেশী এনজিও গুলোকেও তার হাতের মুঠিতে নিয়ে নিয়েছেন।

আগস্ট মিয়ানমার থেকে যখন ঘোষিত হয় ২২ আগস্ট ৩,৪২০ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা হবে তখন থেকেই থেকেই ঐ বিদেশী এন.জি.ও গুলি নড়ে চরে বসতে শুরু করে এবং মুহিবুল্লাহর শরণাপন্ন হয়। এর পর থেকে শুরু হয় মুহিবুল্লাহ দিবারাত্রির ব্যস্ততা। দিনের বেলায় এন জিও প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক আর রাতের বেলায় প্রতিটি শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের পাঁচ দফা পূর্বশর্ত প্রাচার।

যখন ৩,৪৫০ জনের প্রত্যাবাসন তালিকা পাওয়া গেল তখন ঐ তালিকা ধরে মুহিবুল্লাহ ও তার গড়ে তোলা হাজার দুয়েক কর্মী মিলে শিবিরে শিবিরে গিয়ে তালিকাভূক্ত প্রত্যেককে ঐ পাঁচ দফা মুখস্ত করান ও কি বলতে হবে তাদের প্রত্যাবাসনে মতামত চাইলে তাও শিখিয়ে দেন। দেখা গেল ২২ আগস্ট ৩,৪৫০ জনের সবাই একই দাবী তুলে তা পূরণ না হওয়া পর্য্যন্ত প্রত্যাবাসনে কেউই রাজী নন। ব্যর্থ হলো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কারণ বলাই হয়েছিলো যাঁরা স্বেচ্ছায় যাবেন তাদেরকেই শুধু পাঠানো হবে-জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকেই পাঠানো হবে না।

কিন্তু মুহিবুল্লাহ্ কি এতই জনপ্রিয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে? হলে তার ভিত্তি কি?

জানা গেল, এক সময় সশস্ত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় এখন পর্য্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর যত ক্যাডার আশ্রয় নিয়েছে তারা প্রত্যেকেই মুহিবুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। তাদের নিয়েই ক্যাম্পে গোপনে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়। বিকাল ৪ টার পরে দরজা জানালা বন্ধ করে ক্যাম্পের ঘরের মধ্যেই থাকেন। কিন্তু ক্যাম্পে হৈ হট্টগোল থাকে প্রতি রাতেই।

স্থানীয় আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবী, ক্যাম্পসগুলোতে মুহিবুল্লাহ্ বিরোধী অন্য একটি সশস্ত্রও গ্রুপও সক্রিয় রয়েছে কিন্তু তারা সংখ্যায় কম। আর্থিকভাবেও দুর্বল, অস্ত্র শস্ত্রও তেমন নেই। এ কারণে মুহিবুল্লাহ গ্রুপের সমর্থিত ক্যাডাররা তাদেরকে মুনাফিক বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেছে এবং এ পর্য্যন্ত কম পক্ষে ২২ জন রোহিঙ্গাকে হত্যাও করেছে। কথার অবাধ্য হওয়ায় ক্ষুদ্র গ্রুপটির আরও ১০ জনকেও হত্যা করে ক্যাম্পগুলিতে ভয়াবহ ত্রাসের সৃষ্টি করেছে মুহিবুল্লাহ ও তার বাহিনী।

পুলিশের পক্ষ থেকে এযাবত যে লক্ষ কোটি ইয়াবার ট্যাবলেট রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, যে বিপুল পরিমাণ গোপন অস্ত্রের চালান মাঝে মধ্যেই তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হচ্ছে সে সম্পর্ক নিস্পৃহ থাকার আর কোন সুযোগ যেমন নেই তেমনি আবার ক্যাম্পগুলেতে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে গোপন রাজনীতি বা গোপন অস্ত্র ও ইয়াবার সাথে জড়িতদের গ্রেফতাররেও কোন উদ্যোগও সরকারের তরফ থেকে নেই।

ফলে দিন দিনই ক্যাম্পগুলিতে পরিস্থিতির অবনতিই ঘটে চলেছে। এগুলি দেখেও যাঁরা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের নামে যথেচ্ছাচার সহ্য করার পরামর্শ দেন তাঁদের আসল মতলব বুঝে ওঠা কঠিন নয়। আন্তর্জাতিক চাপ মিয়ানমারের উপরে যেমন প্রবলভাবে বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে তেমনই আবার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা স্বাদেশে ফেরত না গেলে (হতে পারে ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে) বাংলাদেশ সরকার আশ্রয় শিবিরগুলি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন।

সরকারের দায়িত্ব কক্সবাজার, উথিয়া অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদেরকে এই অনাকাংখিত সংকট ও বিপর্য্যয় থেকে মুক্ত করা। জামায়ত, হেফাজত, জঙ্গী সন্ত্রাসী সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করা নয়।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত