বেরোবি প্রতিনিধি : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বিভাগে বিভাগে সেশনজটের রেকর্ড। ছয় মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত সেশনজট রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির অধিকাংশ বিভাগে। চার বছরের স্নাতক সম্পন্ন করতেই লেগে যাচ্ছে পাঁচ থেকে সাত বছর। যেখানে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট মুক্ত হচ্ছে সেখানে দিন দিন লাগামহীনভাবে বাড়ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির সেশনজট।

জানা গেছে, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার কথা থাকলেও তারা এখনও স্নাতকোত্তর শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। তিন বছরের সেশনজটে রয়েছেন তারা। একই অবস্থা এই বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের। চার বছরের স্নাতক শেষ করতে তাদের সময় লাগছে সাত বছর। এতে করে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে।

শুধু ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগই নয়, এমন সেশনজটের কবলে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ২১টি বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে অধিকাংশ বিভাগে ছয় মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত সেশনজট রয়েছে।

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা এখনও রয়েছেন স্নাতক শেষ সেমিস্টারে। তিন বছরের সেশনজটে রয়েছে তারা। একই অবস্থা এই বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের। ২০১৭ সালে তাদের স্নাতক সম্পন্ন হওয়ায় কথা থাকলেও এখনও রয়েছে স্নাতক সপ্তম সেমিস্টারে এবং ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা রয়েছে পঞ্চম সেমিস্টারে।

আরও জানা গেছে, ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে এখনও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে পারেনি পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন এবং গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী। ফলে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর মিলে পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করতে তাদের সময় লাগছে প্রায় আট বছর। উচ্চশিক্ষায় দীক্ষিত হওয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে তারা ভর্তি হয়েছিলেন, সেশনজটের কারণে সে স্বপ্ন আজ ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে।

জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ এখনও স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টারেই রয়েছে। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা রয়েছে চতুর্থ বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারে, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারে,২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা রয়েছে দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সেমিস্টারে এবং সর্বশেষ ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা এখনও রয়েছে প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টারেই।

২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষা হলেও ফল প্রকাশ হয়নি এখনও। বর্তমানে বিভাগটিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ছয়টি ব্যাচ রয়েছে। সেশনজটের প্রায় একই অবস্থা লোকপ্রশাসন ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগেও। বিভাগ দুটিতে বর্তমানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে ছয়টি ব্যাচ রয়েছে।

হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে নাম প্রকাশ না করা শর্তে ওই বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলছিলেন, কবে স্নাতক পাস করতে পারব কি-না জানি না, চাকরি তো দূরের কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একই অবস্থা বাংলা ও ইংরেজি বিভাগে। বর্তমানে বিভাগ দুটিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সাতটি ব্যাচ রয়েছে। যেখানে ব্যাচ থাকার কথা পাঁচটি। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবস্থাও প্রায় একই।

তবে প্রায় সেশনজট মুক্ত রয়েছে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই), ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দফতর জানায়, প্রতি শিক্ষাবর্ষ দুই সেমিস্টারে বিভক্ত। যেহেতু এক বছরে দুটি সেমিস্টার, সেহেতু জানুয়ারি থেকে জুন এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই সেমিস্টার মিলিয়ে একটি শিক্ষাবর্ষ শেষ হবে। এক সেমিস্টারের মেয়াদ ছয় মাস হওয়ায় সাড়ে চার মাসের মধ্যেই সমস্ত ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, মিডটার্ম এবং প্রেজেন্টেশন শেষ করে পরবর্তী ছয় সপ্তাহের মধ্যেই ফলাফল প্রকাশ করবেন। শুধু স্নাতক শেষ সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হলে পরবর্তী আট সপ্তাহের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করবেন। কিন্তু বেশির ভাগ বিভাগের শিক্ষকেরা এই নিয়মের তোয়াক্কা করেন না।

অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মোরশেদ হোসেন বলেন, বছরের শুরুতে একাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়। বিভাগের সব শিক্ষক নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে ওই ক্যালেন্ডার যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেন। এ টিমওয়ার্কের কারণে এ বিভাগে সেশনজট নেই। সেশনজট নিরসনে অন্য বিভাগগুলো এটি অনুসরণ করতে পারে।

সেশনজটের কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিলম্বে প্রথম বর্ষের ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন ও ক্লাস শুরু করা, শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ সংকট, রুটিন অনুযায়ী ক্লাস-পরীক্ষা নিতে শিক্ষকদের অনীহা ও স্বেচ্ছাচারিতা, পরীক্ষার ফল প্রকাশে কালক্ষেপণ, নানামুখী আন্দোলন, এক ব্যাচের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আরেক ব্যাচের পরীক্ষা নেয়া ইত্যাদি কারণে সেশনজট হচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২-৫ ডিসেম্বর। তাদের ক্লাস শুরু হয় ৩ মার্চ। যেখানে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জানুয়ারির প্রথমেই ক্লাস শুরু করেন। ফলে দুই-তিন মাসের সেশনজট নিয়েই ক্লাস শুরু হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অধিকাংশ শিক্ষকই ব্যক্তিগত কাজ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। সেমিস্টার পদ্ধতির নিয়মও তারা যথাযথ অনুসরণ করেন না। নিয়মানুযায়ী শিক্ষকদের যে পরিমাণ ক্লাস নেয়ার কথা, তার অর্ধেকেরও কম ক্লাস নেন। অনেক শিক্ষক শুধু পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার আগে দু-চারটি ক্লাস নিয়েই ক্লাস শেষ করেন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, সেশনজটে জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও তারা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারেন না। সময়মতো ক্লাস-পরীক্ষার কথা বললেই উল্টো হয়রানির হুমকি দেন শিক্ষকরা। শিক্ষক স্বল্পতা থাকায় তারা আরও বেশি বেপরোয়া। ফলে ছয় মাস থেকে তিন বছরের সেশনজট নিয়েও মন্তব্য করতেও ভয় পান শিক্ষার্থীরা।

এদিকে গত ২৪ জুন থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত নীতিমালা বাস্তবায়নসহ তিন দফা দাবিতে প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে আন্দোলন করেন কর্মচারীরা। ফলে বন্ধ থাকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দফতর, একাডেমিক শাখার কার্যক্রম। এতে অনেক বিভাগের ভর্তি, পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। যা শিক্ষার্থীদের মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতোই।

সেশনজটের ব্যাপারে জানতে চাইলে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মো. আতিউর রহমান বলেন, পূর্ব থেকেই বিভাগটিতে সেশনজট ছিল। বর্তমানে সৃষ্ট সেশনজট নিরসন ও নতুন করে সেশনজট জেনো সৃষ্টি না হতে পারে সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে উপাচার্যের বরাত দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রদানকারী এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাবিউর রহমান প্রধান জানান, সেশনজটের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন ব্যাচগুলোর সেশনজট নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৯)