বাগেরহাট প্রতিনিধি : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাগেরহাটসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাসের কারণে জলাবদ্ধতায় জনজীবনে চরম ভোগান্তি নেমে এসেছে। বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরিশাল ও ভোলা এসব উপকূলীয় জেলার নদ-নদীতে অতিরিক্ত পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় অস্বাভাবিক পানির চাপ নদীগুলো ধারন করতে পারছে না। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক জলাবদ্ধতা ও অকাল বন্যা।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদী ভাঙ্গন, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, কৃষির অবনতি ঘটছে। এ অবস্থায় চরম ঝুকির মধ্যে উপকূলীয় এলাকার মানুষগুলো। অতিরিক্ত পলি জমে নদ-নদী ভরাট হওয়ায় জোয়ারের স্ফীতি বাড়ছে, বাড়ছে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা। এসব কিছুই কিন্তু এ অঞ্চলের বন্যা এবং জলাবদ্ধার ইঙ্গিত বহন করে। এর প্রভাবে এ অঞ্চলে অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ছে।

বিভিন্ন সূত্র মতে, উপকুলের নদীগুলোর বহনকৃত বার্ষিক পলির পরিমান ১.২ বিলিয়ন টন। এতে শুষ্ক মৌসুমে প্রধান প্রধান নদীগুলোর শাখা প্রশাখা সমূহের কার্যকারিতা পলি সঞ্চায়নের ফলে বন্ধ হয়ে থাকে। এই উপকূলীয় এলাকা এমন একটি প্রাকৃতিক অবস্থান যেখানে মাটি, পানি, বায়ুর সংমিশ্রন ঘটে থাকে। যা উপকুলীয় অঞ্চলের পরিচিতি নির্ধারনে জোয়ার ভাটার প্রবণতা, লবণাক্ততার অবস্থান, এবং ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব এই তিনটি নিয়ামাকের উপর নির্ভর করে।

উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীর নাব্যতা না থাকায় বর্তমানে সাড়ে ৫ মিমি. বৃষ্টিপাতেই তলিয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ অঞ্চল। নদী গুলোতে বর্ষার পানি নিষ্কাশন হচ্ছেই না বরং নদী উপচে পানি প্রবেশ করছে ফসলের মাঠ ও লোকালয়ে। এসবেব বাস্তব চিত্র আজ দেখা যায় প্রতিটি বসত ভিটায় যখন মাটি দিয়ে ভরাট করে তাদের বাড়ি ঘর উচু করতে হচ্ছে অনাবরত। নদীর লবণ পানি ফসলি ক্ষেতে উঠে দেখা দিচ্ছে তীব্র খাদ্য সংকট, জীবন জীবিকার জন্য করতে হচ্ছে সংগ্রাম।

নতুন করে যোগ হওয়া পোল্ডার সিস্টেমের কারণে নদীর গতিবেগ কমে গেছে। তাই জোয়ারের পলি যুক্ত পানি ভূখন্ডে প্রবেশ করতে না পেরে নদী তার বক্ষ ভরাট করে তুলছে। ভরাট এলাকার নদীর অভ্যন্তরীণ খাল বিলের তুলনায় উঁচু হয়ে পড়ায় পানি নিষ্কাশিত হতে না পেরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে। কেন আজ এ অবস্থা, বিভিন্ন গবেষণায় যে সব বিষয় এসেছে ৪ টি বিষয়। তা হচ্ছে বিপর্যস্ত নদী ব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত চিংড়ী চাষ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত বাঁধ ও উজানে বাঁধ নির্মান।

অপরিকল্পিত চিংড়ী চাষ : বাগেরহাট-খুলনা এলাকার মিঠা পানির মৎস্য চাষ ও দক্ষিণে নোনা পানির চিংড়ী চাষ করা হয়। মৃতপ্রায় নদী, খালগুলোকে ঘিরে ছোট ছোট মৎস্য চাষ করা হয়। যার অধিকাংশই অবৈধ দখলদারদের দখলে। জোয়ার ভাটার এলাকায় গড়ে উঠেছে চিংড়ী ঘের। অভ্যান্তরীন নিষ্কাশনের অধিকাংশ খালগুলো ঘের মালিকরা তাদের ঘেরের দখলে যথেচ্ছার ব্যবহার, এমনকি স্লুইচ গেটগুলোও তারা তাদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে নদী থেকে খালে জোয়ারের সময় যে পরিমান পানি ঢোকে ভাটার সময় সে পরিমান পানি স্রোতের ন্যায় বের হতে না পারার কারণে নদীগলো একদিকে পলি জমে ভরাট হচ্ছে অন্যদিকে ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি তীব্র লবণাক্ত সৃষ্টি হচ্ছে।
বিপর্যস্ত নদী ব্যবস্থাপনা : ঐতিহাসিক ভাবে দেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলে নদীগুলোর অসংখ্য ছোট বড় শাখা নদী জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেগুলো এখন মৃতপ্রায়। গঙ্গা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রাজমহল ও ভগবানগোলার মধ্যবর্তী ফারাক্কা নামক স্থানে ভারত বাঁধ তেরী করেছে এর ফলে বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের কারনে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলসহ উপকূলের ভাটির নদীগুলোতে বিরুপ প্রভাব পড়েছে।
উজানে বাঁধ নির্মান : ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৫৪টি নদী। এই নদী গুলোর অধিকাংশের উৎসাহ মুখে বিগত কয়েক বছর ধরে ভারত বাঁধ নির্মান করেছে। এবং বাংলাদেশের সাথে ভারতের নদী সিমান্ত রয়েছে ১৮৫ কি.মি.। দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলসহ উপকুলের বন্যাদুর্গত এলাকার জেলা গুলোতে নদী সীমান্ত রয়েছে ৫০কি.মি. ভারতীয় অঞ্চলের বন্যার পানি বের হয় যে সব অঞ্চল দিয়ে সেখানে রয়েছে দীর্ঘ বাঁধ ও অসংখ্য স্লুইচ গেট।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত বাঁধ : নোনা পানি এবং জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর জন্য ৬০’এর দশকে জোয়ার ভাটা এলাকায় ভেড়ীবাঁধ নির্মান করা হয়। যা পোল্ডার নামে খ্যাত। কিন্তু পোল্ডার সিস্টেমের কারণে নদীর গতিবেগ খুব কমে যায় এবং জোয়ারে পলিযুক্ত পানি ভুখন্ডে প্রবেশ না পেরে নদী তার নিজ বক্ষ ভরাট করে তুলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে।

সুন্দরবন গবেষক ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, বাগেরহাটসহ উপকূলীয় এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত ভেড়িবাধঁ নির্মান, স্লুইসগেট ব্যবস্থাপনা না থাকা ও অপরিকল্পিভাবে চিংড়ি চাষের কারনে নদীতে অতিরিক্ত পলি জমছে। ভারত নদীতে বাঁধ দেয়ায় উজানের পানি প্রবাহ না থাকায় লবনাক্ততা বেড়েই চলেছে। এসব কারণে সকল নদী-খাল সমূহ খনন, রেকর্ডীয় নদী খালের অবৈধ বাধ অপসারন ও দখল মুক্তকরন, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ বন্ধ, খননের মাধ্যমে নদী খালের নব্যতা পুরুদ্ধারসহ নদীতে অব্যাহত ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর মাধ্যমে নৌপথ সচল করার বিকল্প নেই।

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারন সম্পাদক ও পেড়িখালি ইউপি চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বাবুল বলেন, নদীর নব্যতা হৃাসের ফলে মংলা- ঘষিয়াখালী আর্ন্তজাতিক নৌরুটের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এবং মংলা বন্দরের সাথে সংযোগ রক্ষাকারী জেলা ও বিভাগীয় সদরের যোগাযোগের মাধ্যম রামপাল সদর খেয়াঘাট থেকে থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার আবাল বৃদ্ধ বনিতা, পলি কাদাযুক্ত বিশাল চর ও হাটু পানি পাড়ি দিয়ে নৌকা ছাড়াই পায়ে হেটে সরাসরি পারাপার হচ্ছে।

এ বিষয়ে কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (সিডিপি)’র নির্বাহী পরিচালক এস জাহাঙ্গীর হাসান মাসুম বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ু দূর্গতদের জীবন জীবিকা ও অস্তিত্ব রক্ষার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ, জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী দেশগুলোর কাছ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। এ অঞ্চলে তীব্র লবাণাক্ততা, ফসলহানি, বৃক্ষ উজাড়, জলাবদ্ধতা, জলোচ্ছ্বাস, পরিবেশ বিপর্যয়, খাদ্যাভাবসহ জনজীবনে সীমাহীন দূর্ভোগ রোধে জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, জলোচ্ছ্বাস, ফসলহানি রোধে রেকর্ডীয় নদীখালের উপর পাবলিক রাইটস প্রতিষ্ঠায় অবৈধ বাঁধ অপসারন, আবদ্ধ বিলগুলো বছরে কমপক্ষে অর্ধেক সময় উন্মুক্ত রাখতে হবে।

(একে/জেএ/আগস্ট ০১, ২০১৪)