রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জিয়ালা দুগ্ধ গ্রাম হুমকির মুখে পড়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর  তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ঘোষপাড়ায় ডেঙ্গু বিরোধী ও পরিবেশ পরিচ্ছন্নতার অভিযানের নামে  আচমকা অভিযান চালিয়ে দু’জনকে ১৫ দিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ছয় জনকে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করায় খামারী ও শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে শুক্রবার সকালে জিয়ালা ঘোষপাড়ায় গেলে বৃদ্ধ নন্দ লাল ঘোষসহ কয়েকজন খামার মালিক জানান, ১৯৮৯ সালে এখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গাভী পালন শুরু হয়। দিবস চন্দ্র ঘোষ, প্রশান্ত ঘোষ, অমল কৃষ্ণ ঘোষ ও নিমাই কৃষ্ণ ঘোষকে গাভী পালনকারিদের অগ্রদুত হিসেবে বলা যায়। দুগ্ধ শিল্পের উন্নয়নে তৎকালিন বিএনপি সরকার খামারীদের গরু কেনার জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে অনুদান দেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ সাধারণ মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে দুগ্ধ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বার বার জিয়ালা ঘোষপাড়া পরিদর্শন করেন ও খামারীদের পরামর্শ দেন। ২০০০ সালে জিয়ালা ঘোষপাড়াকে দুগ্ধ পল্লী হিসেবে ঘোষণা দেন তৎকালিন জেলা প্রশাসক ।

ন্যয্যমূল্যে দুগ্ধ বিক্রয় ও খামরীদের উন্নয়নকল্পে গঠণ করা হয় জিয়ালা ঘোষপাড়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারি সমবায় সমিতি লিমিটেড(রেজি নং-৯৪/০৭)। ওই সমিতির সভাপতি হেসেবে ২০০৯সালে জাতীয় সমবায় ও মিল্ক ইউনয়ন পুরষ্কার পান দিবস ঘোষ। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষ্ িপুরষ্কার হিসেবে ব্রোঞ্জ, জাতীয় শ্রেষ্ঠ সমবায়ী পুরস্কার ও(মিল্ক ইউনিয়ন) ও বিভাগ ভিত্তিক শ্রেষ্ঠ সমবায়ী পুরষ্কার পান তিনি। ২০১১ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক জাতীয় সমবায় সম্মাননা পুরষ্কার পান। এ ছাড়া ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরসাতক্ষীরা বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারি পুরষ্কার পান। এ ছাড়া ২০১৭ সাল পর্যন্ত তালা উপজেলার শ্রেষ্ঠ সমবায় পুরষ্কার পান।

নন্দ দুলাল ঘোষ বলেন, জিয়ালা ঘোষপাড়ার দেখাদেখি চণ্ডিপুর ঘোষপাড়া, মহান্দি ঘোষপাড়া, আটারুই ঘোষপাড়া, রায়পুর ঘোষপাড়া ও মাছিয়াড়া ঘোষপাড়াসহ বিভিন্ন মুসলিম পল্লীতেও গাভী পালনের কাজ শুরু হয়। জিয়ালা ঘোষপাড়ায় বর্তমানে দেড় শতাধিক ছাট বড় খামার রয়েছে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তি কয়েকটি পাড়ায় রয়েছে তিন শতাধিক খামার। গরুর বর্জ্য অপসারন, মশাল তৈরি, ঘাস লাগানো, ঘাস কাটা, বিচালী কাটা, দুধ দোহানো, দুধ বহন, গরু স্নান করানোসহ খামারের বিভিন্ন কাজে কমপক্ষে এক হাজারের বেশি পুরুষ ও নারী শ্রমিক নিয়োজিত।

কাজ অনুযায়ী প্রতি মাসে এক একজন শ্রমিক ছয় হাজার টাকা থেকে ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন উপার্জন করে থাকে। এখানকার উৎপাদিত দুধ মিল্ক ভিটা, প্রাণ, ব্রাক ও আকিজ কোম্পানীসহ খুলনা, সাতক্ষীরাও যশোরের বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে সরবরাহ করা হয়। বিভিন্ন সময়ে ল্যাব টেকনিশিয়ানের দূর্ণীতির কারণে প্রাচীন ম্যশিনে দুধের ফ্যাট মেপে কতিপয় খামারীকে ঘুষের মাধ্যমে বেশি সুবিধা দেওয়ায় প্রকৃত খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ভারতীয় গুড়া দুধের সাথে শ্যাম্পুসহ বিভিন্ন তেজষ্ক্রিয় পদার্থ মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করে দুধের বাজারকে অশান্ত করে তোলে একটি চক্র। কালের আবর্তনে জিয়ালা ঘোষপাড়ার দুগ্ধ শিল্পকে বিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়।

জিয়ালা গ্রামের ক্ষীতিশ ঘোষ বলেন, গত ৩ সেপ্টেম্বর তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে প্রশাসনের লোকজন জিয়ালা ঘোষপাড়ায় ডেঙ্গু বিরোধী ও পরিবেশ সুরক্ষা অভিযানে নেমে গবাদি পশুর বর্জ্য খালের পানিতে ফেলা হচ্ছে এমন অভিযোগে তার ছেলে উদ্ধপ ঘোষকে ১৫ দিনের জেল দেন। একইভাবে করুনাময় ঘোষের ছেলে আশীষ কুমার ঘোষকেও একই কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয় প্রশান্ত ঘোষ, বিশ্বনাথ ঘোষ, অর্জুন ঘোষ, পার্থ ঘোষ, জামিনী ঘোষও মনোরঞ্জন ঘোষকে। পরিবেশ আইনের ২৬৯ ধারার বিধান মতে ওই জরিমানা করা হয়।

অঞ্জনা ঘোষ, মাদার ঘোষ ও ক্ষীতিশ ঘোষসহ কয়েকজন জানান, তাদের প্রত্যেকের জমিতে গোবর ও বর্জ্য রাখার জন্য গর্ত রয়েছে। গর্ত ভরাট হলেই গোবর দিয়ে মশাল বানানোর পাশাপাশি মাছের ঘেরে গোবর বিক্রিকরাহয়। ফেলা হয় জমিতেও। গোবর দিয়ে তৈরি হয় গোবর গ্যাস প্লান্ট। তবে গরু স্নান করানোর জল ড্রেনের মাধ্যমে অনেক সময় খালে পড়ে। আবার বর্ষা হলে গর্ত ছাপিয়ে ড্রেনের মাধ্যমে বর্জ্য এর অংশ বিশেষ খালে পড়াটা স্বাভাবিক। এরপরও দীর্ঘ দিন ধরে এ প্রক্রিয়ায় ছোট বড় খামারগুলো এভাবেই চলে আসছে। গরুর খামার বা আশে পাশের নর্দমা বা গোবর গর্তে কোন স্বচ্ছ পানি জমতে পারে না। কারণ এসব নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। এডিস মশার লার্ভা কখনো জমা স্বচ্ছ জলে ছাড়া ডিম পাড়ে না।

সুতরাং খামারের কারণে এডিস মশা জন্মানোর সম্ভবনা কম। এরপরও এলাকায় কয়েকজন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। ডেঙ্গু বিরোধী ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার নামে আগে থেকে সতর্ক না করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন যেভাবে তাদের এলাকায় জরিমানা ও কারাদণ্ড দিয়ে ভীতির সঞ্চয় করেছেন তাতে অনেকেই গরু বিক্রি করার চিন্তা করছেন। একের পর এক গরু বিক্রি করে দিলে খামারীদের পাশাপাশি পথে বসবে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত এক হাজারের বেশি শ্রমিক। ফলে এলাকার চুরি , ডাকাতি ও রাহাজানি বাড়বে।

এক সময়কার পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টির চাঁদাবাজি ও ডাকাতদের দৌরাত্মে থাকা খামার মালিকরা বিভিন্ন সময় লড়াই সংগ্রাম করে দেশের মানুষের খাদ্যের পুষ্টিরমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে। এরপরও যদি পরিবেশ রক্ষার নামে নতুন করে পরিকল্পনা বিহীন অভিযান চালানো হয় তাহলে খামারবন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবেনা।

তালা উপজেলা কেন্দ্রীয় দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি দিবস ঘোষ জানান, মোবাইলকোর্টের অভিযান, জরিমানাও কারাদণ্ড নিয়ে বিষয়টি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ও জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তাকে অবহিত করেছেন। তারা বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

তালা উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ সঞ্জয় কুমার বিশ্বাস জানান, জিয়ালাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় উৎপাদিত দুধের উপর খুলনা বিভাগের বড় অংশের জনগনই নির্ভরশীল। তাই পরিবেশের ভারসাম্যবজায় রেখে যাতে খামারগুলো বাঁচিয়ে রাখা যায় সেজন্যসব ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৯)