মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : আট-দশ মিটার উঁচু উঁচু ঢেউ। ২৪ নাবিককে বহনকারী কন্টেইনার জাহাজটি তলা ফেটে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে একদিকে কাঁত হয়ে ডুবে যাচ্ছে। জাহাজের মাষ্টার কেবিনে মধ্যে দাড়িয়ে একেকজন নাবিক উদ্ধারের জন্য কন্ট্রোলরুমসহ ৯৯৯ এ যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোন সাড়া নেই। দিনের আলো শেষে রাতের আধাঁরে বিক্ষুদ্ধ সাগরের ঢেউকে আরো ক্ষুধার্ত মনে হয় নাবিকদের কাছে। যে সাগরের প্রতিটি মোহনা নাবিকদের কাছে ছিলো পরিচিত, হঠাৎ জাহাজ ডুবিতে সেই সাগরের অগ্নিমূর্তি দেখে তারা আতংকিত হয়ে পড়ে। 

পরিবার-পরিজন ও প্রিয়জনদের মুখগুলো ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে ছবির মতো ভেসে আসে তাদের মনে। বাঁচার তীব্র আকুতিতে পানি ও খাবার ছাড়াই ডুবন্ত জাহাজের মাস্তুলে এভাবেই প্রায় ১৪ ঘন্টা কাটিয়ে দেয়।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার পায়রা বন্দর সংলগ্ন ফেয়ারওয়ে বয়ার কাছে ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধায় ১৪ নাবিক নিয়ে এ জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে। পরদিন সকালে ৯৯৯ থেকে থেকে তথ্য পেয়ে সমুদ্রে টহলরত নৌবাহিনীর জাহাজ সাঙ্গু ১৪ নাবিককে উদ্ধার করে।

১৫২টি কন্টেইনার বাহী জাহাজ এমভি গলফ আরগো ১৪ নাবিককে ১৪ সেপ্টেম্বর(শনিবার) বিকালে ডুবে যাওয়া জাহাজ গলফ আরগোর লজিষ্টিক ম্যানেজার মো. নুরুজ্জামানের হাতে হস্তান্তর করে খুলনা নেভাল প্রভোষ্টের চীফ পেটি অফিসার নাজমুল ইসলাম।

সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজটি ১৫২টি কন্টেইনার নিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে চট্রগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। প্রায় ৩৮০ নটিক্যাল জলসীমায় গত ১২ সেপ্টেম্বর হঠাৎ সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে জাহাজের তলদেশ ফেঁটে যায়। এতে জাহাজটি প্রায় নয় মিটার গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যায়। ভেসে যায় জাহাজে থাকা কন্টেইনার। দীর্ঘ বছর জাহাজ চালানোর অভিজ্ঞতা থাকলেও এভাবে জাহাজ ডুবির অভিজ্ঞতা সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই জাহাজের ক্যাপ্টেন কাজী আব্দুল্লাহ আল মুহিতের। সেদিনের সেই ভয়াল ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে ঘটনার দুইদিন পরও চোখে-মুখে আতংকের ছাপ তার। একই অবস্থা জাহাজের অন্য নাবিকদের।

ক্যাপ্টেন কাজী আব্দুল্লাহ আল মুহিত বলেন, আল্লাহ নৌবাহিনী সদস্যদের দূর্ঘটনাস্থলে না পাঠালে হয়তো তারা সাগরেই ভেসে যেতেন। নৌবাহিনী সদস্যরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তাদের উদ্ধার করেছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। একই কথা বলেন ডুবে যাওয়া জাহাজ গলফ আরগোর অন্য নাবিকরা।

নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী জাহাজ সাঙ্গুর লেঃ কমান্ডার এম মনজুর হোসাইন বলেন, ৯৯৯ থেকে তথ্য পেয়ে ঘটনার দিন রাতেই তারা সাগরে সার্ভে শুরু করেন ডুবে যাওয়া জাহাজের সন্ধানে। পরদিন ১৩ সেপ্টেম্বর সকালে তাঁরা জাহাজের সন্ধান পান এবং ১৪ নাবিককেই নিরাপদে উদ্ধার করেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পায়রা বন্দর থেকে প্রায় ২০ নটিক্যাল মাইল দূরে ডুবে যাওয়া জাহাজটি তারা সনাক্ত করলেও দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সাগরে তিন সম্বর সিগন্যাল থাকায় তাদের উপকূলে নিয়ে আসতে পারেন নি। তবে নাবিকরা সবাই সাহসী থাকায় ভয়াবহ বিপদের মধ্যেও সবাই একজোট হয়ে লাইফ জ্যাকেট পড়ে ডুবে যাওয়া জাহাজের মাষ্টার রুমে অবস্থান নেওয়ায় সাগরে প্রচন্ড ঢেউ থাকলেও তারা সাগরে ভেসে যায়নি।

নৌবাহিনী সদস্যরা বলেন, ডুবে যাওয়া জাহাজটি পায়রা চ্যানেলের প্রবেশ মুখের পাশে ডুবে গেলেওএই চ্যানেলে অন্য জাহাজ প্রবেশে কোন অসুবিধা হবে না।

খুলনা নেভাল প্রভোষ্টের চীফ পেটি অফিসার নাজমুল ইসলাম বলেন, নৌবাহিনী সদস্যরা জাহাজ ডুবির খবর পেয়েই তাদের সন্ধান শুরু করে এবং উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ১৪ নাবিককে। শনিবার দুপুরে ১৪ নাবিককে গলফ ওরিয়েন্ট সীওয়েচ লিমিটেডের লজিষ্টিক ম্যানেজারের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

গলফ ওরিয়েন্ট সীওয়েচ লিমিটেডের লজিষ্টিক ম্যানেজার মো. নুরুজ্জামান বলেন, জাহাজ ডুবির খবর পাওয়ার পর থেকে তারা বিচলিত ছিলেন। নৌবাহিনী সদস্যদের আন্তরিকতায় তাদের ১৪ নাবিক নতুন জীবন পেলো। তারা এজন্য নৌবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং ৯৯৯ হেল্পলাইনে কল দিয়ে তাদের নাবিকরা জাহাজ ডুবির ঘটনা জানাতে পেরেছেন। সরকারি এ গুরুত্বপূর্ণ হেল্পলাইন না থাকলে হয়তো জাহাজের মতো সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যেতে তাদের ১৪ নাবিক। তবে ডুবে যাওয়া জাহাজটি উদ্ধারের জন্য এখনও উদ্ধার অভিযান শুরু হয়নি।

(এস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৯)