স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে নবায়নের আবেদন ফরম হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন পান্থপথের আবির আলী। টাকা জমা দিয়ে ফরম বাসা থেকেই পূরণ করে এনেছেন। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই ফরমও জমা দেন। তবুও তার মাঝে কোনো উৎফুল্লতা নেই। জানতে চাইলে বলেন, আট মাস ধরে ই-পাসপোর্টের অপেক্ষায় ছিলাম। এই মাস-ওই মাস করে এখনো আসেনি। কবে আসবে খবর নেই। তাই আর অপেক্ষা না করে এমআরপির (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) আবেদন করলাম।

আবির আলীর মতো হাজার হাজার পাসপোর্ট আবেদনকারী ই-পাসপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রথম দিকে বলা হয়েছিল, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীকে পাসপোর্ট দেয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। তবে এরপর প্রায় তিন-চারবার উদ্বোধনের তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে উদ্বোধনের কথা থাকলেও ‘প্রধানমন্ত্রী দেশে নেই’ অজুহাতে চালু করা হয়নি।

চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকে ই-পাসপোর্টের একটি পরিপত্র জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। এতে ই-পাসপোর্টের ফিসহ নানা তথ্যাদি জানানো হয়। অনেকেই এ পরিপত্র দেখে ভেবেছিলেন যে, শিগগিরই আসছে ই-পাসপোর্ট। তবে মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো ঘোষণা আসেনি।

এ বিষয়ে মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) পাসপোর্ট অধিদফতর ও ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা কেউ ই-পাসপোর্ট উদ্বোধনের দিনকাল বলতে পারেননি।

বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর ২০১৮ সাল থেকেই ই-পাসপোর্ট দেয়ার কথা বলেছিল। তবে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে অধিদফতর। এরপর আজ আসছে কাল আসছে শুনে যারা অপেক্ষায় ছিলেন তাদের অনেকেই এখন পাসপোর্ট অফিসমুখী হয়েছেন।

সারোয়ার তামজিদ নামে আগারগাঁওয়ের এক বাসিন্দা বলেন, এক বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলাম, পরিবারের পাঁচজনের কেউই ই-পাসপোর্টের জন্য এমআরপি নবায়ন করেনি। ই-পাসপোর্ট এলে একসঙ্গে করব বলে অপেক্ষায় আছি।

সারোয়ারের মতো অনেকেই এখনো অপেক্ষায় আছেন, ই-পাসপোর্ট করবেন। এতসংখ্যক মানুষের অপেক্ষা ঘোচাতে কতটুকু সক্ষম পাসপোর্ট অধিদফতর?

জানতে চাইলে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুর রহমান খান বলেন, ‘পুরোপুরি প্রস্তুত হলে দিনে ২৫ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্ট করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ ২৫ হাজার নাগরিকের পাসপোর্ট একদিনে প্রস্তুত করা সম্ভব হবে। আশা করছি দীর্ঘসূত্রতা হবে না।’

দেশের অত্যাধুনিক এ ই-পাসপোর্ট একটি বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট। যাতে একটি এমবেডেড ইলেকট্রনিক্স মাইক্রোপ্রসেসর (মোবাইলের মেমোরি কার্ডের মতো) চিপ থাকবে। এ মাইক্রোপ্রসেসর চিপে পাসপোর্টধারীর বায়োগ্রাফিক ও বায়োমেট্রিক (ছবি, আঙুলের ছাপ ও চোখের মণি) তথ্য সংরক্ষণ করা হবে, যাতে পাসপোর্টধারীর পরিচয়ের সত্যতা থাকে। ই-পাসপোর্টে মোট ৩৮ ধরনের নিরাপত্তা ফিচার থাকবে। পৃথিবীর ১১৯টি দেশের নাগরিকরা এ ই-পাসপোর্ট ব্যবহার করেন।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান জার্মানির ভেরিডোসের সঙ্গে ই-পাসপোর্টের চুক্তি করেন। এরপর ডিসেম্বরে পাসপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও সেই সিদ্ধান্তে কিছুটা পরিবর্তন আনে অধিদফতর। নির্বাচনের পূর্বে প্রথম ধাপে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও সিআইপিদের ই-পাসপোর্ট দিয়ে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করার কথা ছিল। সর্বসাধারণকে জানুয়ারি থেকে ই-পাসপোর্ট দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে নানা জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি।

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, ই-পাসপোর্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে জার্মানির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পাসপোর্টের ইলেকট্রনিক চিপে ১০ আঙুলের ছাপ থাকার কথা। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী জার্মান কোম্পানি মাত্র দুই আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ করতে চাচ্ছে।

‘মাত্র দুই আঙুলের ছাপে ভবিষ্যতে জালিয়াতি হতে পারে’ -এমন আশঙ্কায় এ প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে না পাসপোর্ট অধিদফতর। বিষয়টি নিয়ে জার্মান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক ও চিঠি চালাচালি হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। এটাও ই-পাসপোর্টের বিলম্ব হওয়ার অন্যতম কারণ।

অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে সব বাধা কাটিয়ে রাজধানীর উত্তরায় ই-পাসপোর্ট তৈরির কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা। তবে কবে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা ই-পাসপোর্টের পরিপত্র অনুযায়ী, ই-পাসপোর্টের (ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট) জন্য সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৫০০ টাকা (ভ্যাট ছাড়া) ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া সর্বোচ্চ ফি ১২ হাজার টাকা (ভ্যাট ছাড়া)।

পরিপত্রে জানানো হয়, বাংলাদেশে আবেদনকারীদের জন্য ৪৮ পৃষ্ঠার পাঁচ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্টের ফি ৩ হাজার ৫০০ টাকা, জরুরি ৫ হাজার ৫০০ ও অতীব জরুরি ফি ৭ হাজার ৫০০ টাকা। ১০ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্টের ফি ৫ হাজার টাকা, জরুরি ৭ হাজার ও অতীব জরুরি ফি ৯ হাজার টাকা।

এছাড়া ৬৪ পৃষ্ঠার পাঁচ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্টের ফি ৫ হাজার ৫০০ টাকা, জরুরি ৭ হাজার ৫০০ ও অতীব জরুরি ফি ১০ হাজার ৫০০ এবং ১০ বছর মেয়াদি সাধারণ ফি ৭ হাজার, জরুরি ৯ হাজার ও অতীব জরুরি ফি ১২ হাজার টাকা। সব ফির সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত হবে।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৯)