কাজী নজরুল ইসলাম


 বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক দলের যেমন অভাব নেই, নেতা-নেত্রীদেরও তেমন কমতি নেই। দু‘দিন কোন দলীয় কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করলে, গাছের মাথায় নেতা-নেত্রীর সাথে ছবি টাঙগালে, কোন জনপ্রতিনিধির পেছনে মিছিল করলে-শ্লোগান দিলে, অমুক ভাই-তমুক ভাইর সাথে সেলফি তুলে ফেইসবুকে দিয়েই একেকজন নেতা বনে যান। শুধু নেতাই নন, তারা জননেতা, জনতার নেতা, গণ মানুষের নেতা, সমাজ গড়ার কারিগর, উন্নয়নের বরপূত্র নানান খেতাবে ভূষিত হতে থাকেন। আসলে রাজনৈতিক বিবেচনায় এগুলো পাপতুল্য। তথাকথিত কিছু রাজনীতিবীদ নামধারি জ্ঞানপাপীদের উদাসীনতা আর দল ভারীর অসুস্থ্য প্রতিযোগিতার ফলে প্রকৃত রাজনৈতিক নেতাদের পবিত্র খেতাবগুলো আজ বাজারের সস্তা পণ্যের কাতারে সামিল হয়েছে।

যারা যুগে যুগে জননেতা হয়েছেন, গণ মানুষের আস্থার ঠিকানা হয়েছেন তাদের ইতিহাস অনেক লম্বা, অবর্ণনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষার। সে সকল নেতারা কখনো বিপ্লবী ধারায় দখলদার হঠানোর লড়াইয়ে জীবন বাজি রেখেছেন। আবার কখনো পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্তির জন্য মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে সংগ্রাম করেছেন। জনমত তৈরী করতে গিয়ে জেল-জুলুম, নির্যাতন ভোগ করে নিপীড়িত মানুষের মাঝেই মিশে গেছেন। এখনো দেশে এমন অনেক নেতা রয়েছেন যাদের হৃদয় মন্দিরে শুধু বঞ্চিত মানুষের কল্যানে সাম্যের সুর ধ্বনিত হয়। শৈশব থেকেই তারা পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে মানবতার জয়গানে নিজেকে উৎসর্গ করেন।

তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, রাজনৈতিক বা দলীয় বড় কোন পদ বা আর্থিক সক্ষমতা না থাকলেও অনেক বড় আশ্রয় করে নিয়েছেন গণ মানুষের অন্তরের গহীনে। তৃণমূল থেকে রাজপথ, যেখানেই যাবেন দলে দলে অসহায় নিঃস্ব মানুষেরা এসে ভীড় জমান এমন নেতাদের ঘিড়ে। নিষ্পেশিত মানুষের সুখ-দুঃখের কথায় মনোনিবেশ করেন গভীর নিমগ্নতায়। দুখী মানুষের সমস্যা ঘোচাতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন নিজের শেষ স্বামর্থটুকু দিয়ে। বার বার অলংঘনীয় জীবন ঝুঁকিতে পরেও কোন অবস্থাতেই তারা জনতার ভালবাসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারেননা । মৃত্যুভয় কখনো তাদের তাড়া করেনা। অসুর শক্তির বন্দুকের নিশানা থেকে বারংবার বেঁচে এসে তারা হয়ে উঠেন মৃত্যুঞ্জয়ী। আর সে কারনেই এমন সব নেতা বা ব্যক্তিকে লাখো মানুষ মনের অজান্তেই খেতাব তুলে দেন জননেতা বা গণ মানুষের নেতা নামে। আর এমনটি এক দিনে, এক বছরে, এক দশকেও সম্ভব হয়না। যুগের পর যুগ একজন জননেতা হয়ে উঠেন অযুত মানুষের আরাধ্য পুরুষ।

আমি এধরনের নেতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট বা গুন খুঁজতে খুব দুরে যেতে চাইনা, কোন ভিন গ্রহেও হাত বাড়াবোনা। আমার দৃষ্টির খুব সন্নিকটে, হাতের বেশ নাগালেই খুঁজে পাই একজনাকে। যিনি আর কেউ নন, আমাদের শরীয়তপুর-১ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য, জননন্দিত পুরুষ, সময়ের সাহসী সন্তান ইকবাল হোসেন অপু। প্রকৃত অর্থেই তিনি জননেতা, জনতার নেতা, গণ মানুষের নেতা, হাজারো অসহায়ের ভরসারস্থল, লাখো জনতার আরাধ্য পুরুষ, বঞ্চিত-নিপীড়িতের সূহৃদ-স্বজ্জন, দুস্থ্য-অবহেলিতের আশার বাতিঘর, মুজিবাদর্শের লড়াকু সৈনিক, জননেত্রী শেখ হাসিনার গত তিন যুগের পরম বিশ্বাসের অদম্য সাহসী এক ত্যাগী সিপাহসালার। একজন আদর্শবান পিতার সুযোগ্যতম সন্তান। সুখে-দুখে, রাত্রি-দিবসে, দুর্যোগ-দুঃসময়ে হাজারো মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নিবেদিত বন্ধু। বিত্ত-বৈভব, সম্পদের মোহ, অবৈধ উপার্জণ, বিলাসী জীবন কিছুই যাকে স্পর্শ করেনা এমন এক দেবতুল্য মানবিক নেতা, মানতার ফেরিওয়ালা। সব বয়সের, সকল শ্রেনি-পেশার মানুষের “প্রিয় অপু ভাই”।

এদশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখন চিরায়ত নিয়ম হয়ে গেছে, কোন রাজনৈতিক নেতা ক্ষমতা পেলেই পাল্টে যান। পাল্টায় তার বেশ-ভূষন, চাল-চলন, খাবার মেনু, বন্ধুত্বের তালিকা, শোবার ঘর, আসবাব, ড্রয়িং রুম, গাড়ির মডেল, সামাজিক ও পারিবারিক জীবন, আচার-আচরণ, চশমার ফ্রেম, চলার পথ, কথা বলার ভঙ্গি এমনকি আত্মীয়তাও। অনেককে ক্ষমতার মোহ বৈধ-অবৈধ পন্থায় কাড়ি কাড়ি টাকা কামানোর নেশায় বুদ করে রাখে। কেউ কেউ জাত-বিজাতের হিসেব ভুলে দলীয় আদর্শের পৃষ্ঠমূলে কুঠারাঘাত করে সামান্য ভিক্ষা কুড়ানোর লোভে অনাদর্শের দাশ হয়ে যান। ক্ষমতা অনেককে এমনই এক উম্মাদ বানিয়ে তোলে কিছু চামচা-চাটুকার পোষন করে তাদের মাধ্যমে দরিদ্রের হক আত্মসাতেও দ্বিধা করেননা।

আবার কেউ কেউ আছেন, যাদের এক সময় চৌকিদারী টেক্স পরিশোধের সক্ষমতা ছিলনা ক্ষমতায় গিয়ে তাদের সন্তানদের অবৈধ রুজির পয়সায় উন্নত দেশের শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ করে দিয়ে মহা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন। হঠাৎ ক্ষতাবান হয়ে অনেকেই আছেন যাদের কাছে জরুরী দরকারে আসা ভুখা নাঙ্গা মানুষদের ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখে স্ত্রী-সন্তানের প্রশংসার গীতি কবিতা শুনিয়ে মুগ্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। আবার কখনো দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাবা-দাদাকে ঘোড়ায় চড়িয়ে ১২ ভূঁইয়াদের এক ভূইয়া বানানোর মিথ্যে রূপকাহিনী শুনিয়ে অত:পর “তন্দ্রাদেবীর কোলে ঢলিয়া পরিয়া কুসুম কুসুম নিদ্রার হাই তুলিয়া বলিয়া উঠেন, রাত্রি বুঝি পোহাইয়া গেলগো, তোমরা বরং কিয়ৎকাল বাদেই আসিও, আমার শুধাইবার আরো বহুধা কথন অসমাপ্ত রহিয়া গিয়াছে” (ধিক জানানোর মত এমন লোকেরাও এদেশে এখন জননেতা) !

গত সাড়ে ৯ মাসেরও বেশী সময় পার হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। যে নির্বাচনে ইকবাল হোসেন অপুও শেখ হাসিনার মনোনীত একজন সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু এতদিনে তার মধ্যে ন্যুনতম পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। ঠিক আগের মতই রয়ে গেছেন অপু ভাই। একটুও বদলাননি তিনি। তার স্বভাবে আচরনে একজন সাধারণ মানুষের জীবন চিত্রই এখনো স্পষ্ট। পরম মমতায় কাছে টেনে নেন কর্মীদের। নিজের খাবার টুকু পর্যন্ত ভাগ করে খান কর্মীদের নিয়ে। মানুষের ভোগান্তি হয় বা সাধারণ মানুষ সামান্যতম বিরক্ত হন এমন একটি কাজও তিনি করেননি। আগের সেই ৯ শত বর্গ ফিটের ছোট্ট ভাড়া বাসাটিতেই থাকছেন স্বাচ্ছন্দে। অন্য সব সংসদ সদস্যগণ ন্যাম ভবনে ফ্লাট বরাদ্দের জন্য হুমরি খেয়ে পরলেও তিনি সেখানে যেতে পছন্দ করছেননা। এমনকি তার সহধর্মিনীও চাচ্ছেননা, যেখানে নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ সহজে যাতায়াত করতে নানা বিঘ্নতায় পরবেন সেখানে বাসা পরিবর্তন করে যেতে। সাংসদদের জন্য বরাদ্দকৃত বিলাশবহুল ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি আমদানির কথাও ভাবছেননা তিনি। অপু ভাই আগের মতই নিয়মিত ধানমন্ডির ৩/এ সভানেত্রীর দলীয় কার্যালয় সংলগ্ন আমতলাতেই বসেন। সেখানে সকাল থেকে বিকেল, সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি খোলা আকাশের নিচে অফিস করেন। যদিও জাতীয় সংসদে সরকার তাকে একটি অফিস বরাদ্দ দিয়েছেন, সেখানে প্রশাসনিক অনেক আনুষ্ঠানিকতা মোকাবেলা করে মানুষের যাতায়াতে সমস্যা হওয়ায় বাবুয়ানা ভাবটা পরিহার করে গাছতলায় বসেই জনসেবা করে যাচ্ছেন ইকবাল হোসেন অপু।

একেবারে অতি সাধারণ মানুষের মতই এখনো তার চলাফেরা। বাসা থেকে বেড়িয়ে রিক্সায় চড়েন আবার রিক্সায় করেই বাসায় ফিরেন। যখন নির্বাচনী এলাকায় আসেন, তখন বিলাসবহুল শীততাপ নিয়ন্ত্রিত দামী গাড়িতে না ঘুরে তিনি বন্ধু-বান্ধব ও কর্মীদের নিয়ে অটো রিক্সায় চলাচল করেন। নির্বাচনী এলাকার দুর্গম কোন এলাকায় গেলে সেখানে নিজে মোটর বাইক চালিয়েই ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষের জীবন চিত্র প্রত্যক্ষ করেন। রাস্তার পাশে কাজ করা শ্রমজীবী নারী-পুরুষদের সাথে মিশে যান শিশুর মত। তাদের কথা শুনেন মন দিয়ে। কখনো কারো অতি অসহায়ত্বের কথা জানলে সন্তোষজনক আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন তৎক্ষনাত।

সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ প্রকোপ যখন শরীয়তপুরে বিরাজমান ছিল, প্রতিদিন একাধিকবার হাসপাতালে গিয়ে রুগিদের খোঁজ নিয়েছেন, দেখে এসেছেন। চিকিৎসকদের সাথে সভা করেছেন। নিজের বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত এ্যাডভোকেট আলহাজ সুলতান হোসেন মিয়া ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে রুগিদের নিয়মিত ঔষুধ পথ্য কিনে দিয়েছেন। এমনকি তিনি এও গোষনা দিয়েছেন, তার নির্বাচনী এলাকার (পালং-জাজিরায়) ডেঙ্গু আক্রান্ত সকল রুগিদের চিকিৎসা করাবেন নিজ খরচে। করিয়েছেনও তাই। আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের চরযাদবপুর গ্রামের এক হতদরিদ্র পিতার দৃষ্টি প্রতিবন্ধি ডেঙ্গু আক্রান্ত কিশোর সন্তানকে বাঁচানোর সব আশা ছেরে দিয়েছিলেন শরীয়তপুরের চিকিৎসকরা।

সেদিন ১৪ আগষ্ট। রাত ১০টার পর এমন সংবাদ জানতে পেরে ব্যাকুল হয়ে অপু ভাই হাসপাতালে পৌছে সেই অন্ধ কিশোরের চিকিৎসার ভার গ্রহন করেন। গভীর রাতে নিজ খরচে ঢাকা প্রেরণ করেন। আল্লাহর রহমতে আর অপু ভাইর চেষ্টায় যথাযথ চিকিৎসায় সুস্থ্য হয়ে বাবা-মা‘র কোলে ফিরে আসে আতাউর মোড়লের ছেলে পবিত্র কোরানের হাফেজ অন্ধ হেলাল উদ্দিন। ইকবাল হোসেন অপু এমন অসংখ্য নজীর সৃষ্টি করেছেন এম.পি নির্বাচিত হওয়ারও বহুকাল আগে থেকেই।

এরই মধ্যে ৯২ দিন তার নির্বাচনী এলাকায় সময় দিয়েছেন সাংসদ অপু। এলাকার উন্নয়নে অনেক পরিকল্পনা গ্রহন করেছেন। রাষ্ট্রীয়-সামাজিক অসংখ্য আচার অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। রাজনৈকিত ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন জনহিতৈষী কাজে। পরিবেশ রক্ষায় গাছ লাগিয়েছেন সড়কের পাশে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সহায়তা প্রদান করেছেন নিজ এবং রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে। ছুটে গেছেন বন্যা-নদী ভাঙ্গনে বানভাসী মানুষের পাশে।

একদিনেই বা হঠাৎ করেই সৃষ্টি হননি অপু। দীর্ঘ ইতিহাসের পথ পেরিয়ে আজ তিনি জননেতা-জনপ্রতিনিধি। এৎধংং জড়ঃব খবাবষ বা তৃণমূল থেকেই রাজনৈতিক উত্থান হয়েছে ইকবাল হোসেন অপুর। অপুর জন্মস্থান শরীয়তপুর সদর উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের রনখোলা গ্রামের ঐতিহ্যবাহি মিয়া পরিবারে। তার বাবা মরহুম আলহাজ্ব এ্যাডভোকেট সুলতান হোসেন মিয়া আইন পেশার কারনে ৫০ এর দশক থেকেই মাদারীপুরে স্যাটেল্ট ছিলেন। সেখানেই অপুর বেড়ে উঠা। অপুর শৈশব, কৈশরের সকল স্মৃতিই জরিয়ে আছে আড়িঁয়াল খাঁ নদের বাঁকে বাঁকে।

৬০ এর দশক থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সম্পর্কের সূত্র ধরে অপুর বাবা সুলতান হোসেন মিয়ার আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। এক সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর এতদাঞ্চলের হাতে গোনা কয়েকজন সহচরের মধ্যে ছিলেন একজন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরন করে অপু পারিবারিকভাবেই অর্থাৎ জন্মগত উত্তরাধিকার নিয়েই আওয়ামী রাজনীতির দীক্ষা গ্রহন করেন। মাদারীপুর শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করে অপু শিশু শ্রেনী থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। স্কুল জীবনেই ছাত্রলীগের সকল মিছিল, শোভাযাত্রা, সভা , সমাবেশে অংশ গ্রহন করতে থাকেন।

১৯৮৪ সালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মাদারীপুর জেলা শাখার প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এ কমিটিতে সভাপতি ছিলেন মাদারীপুর জেলা আওয়ামীলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আওয়ামীলীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক ইরশাদ হোসেন উজ্জল। এরপর ১৯৮৭ সালে মাদারীপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন ইকবাল হোসেন অপু। মাদারীপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার্স শ্রেনীতে ভর্তি হন অপু ভাই। তখন স্বৈরাচারি এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। ছাত্র সমাজের ঐতিহাসিক দশ দফার সংগ্রাম আর এরশাদ হটাও আন্দোলনে সুদুর মাদারীপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত যুগান্তকারি ভূমিকা পালন করেন অপু। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে অপুদের পরিবার মাদারীপুর থেকে শরীয়তপুর শহরে স্থানান্তরিত হয়। তার বাবা সুলতান হোসেন মিয়াও শরীয়তপুরেই শুরু করেন তার আইন ব্যবসা। ওই সময় শরীয়তপুরে গোটা আওয়ামী পরিবার ছিল এক ভয়ংকর জল্লাদের দাপটে ভীত সন্ত্রস্ত। অপুর শরীয়তপুরে আবির্ভাব এবং আওয়ামীলীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখায় ঝিমিয়ে পরা সংগঠনে প্রান সঞ্চারিত হতে থাকে।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মাঝেই ১৯৮৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত হয় ডাকসুর নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ডাকসু প্যানেলে সুলতান-মোশতাক পরিষদ ও হল সংসদ নির্বাচনে বিশেষ করে জহুরুল হক হল সংসদে চুন্ন-রাজা পরিষদের বিজয়ের পেছনে অনেক শ্রম ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন অপু। ৯০ সালে জহুরুল হক হলের ভিপি শহিদুল ইসলাম চুন্নুকে ছাত্রদল-পুলিশ মিলে হল গেইটের কাছাকাছি গুলি করে হত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচক্ষন ও সাহসী ছাত্রলীগ নেতা চুন্নু নিহত হবার পরে গোটা ক্যাম্পাস জুরে ভীতি নেমে আসে ছাত্রলীগ শিবিরে। তখন থেকেই ঢাবি ক্যাম্পাসে সময়ের এক সাহসী যোদ্ধা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে ইকবাল হোসেন অপু নামের ছিপ ছিপে এক তরুনের। ৯০ দশকের গোড়ার দিকে বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুখ-রশীদ চক্র যখন ফ্রিডোম পার্টির ব্যানারে নাজাত দিবস পালনের নামে অপতৎপরতা চালাচ্ছিল, তখন অনেক বীর পুরুষরাই ফারুখ-রশীদের সমাবেশ পন্ড করার জন্য সাহস দেখাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিিেছলেন। কিন্তু ইকবাল হোসেন অপুর সুযোগ্য ও সাহসী নেতৃত্বেই সেদিন শত শত পুলিশ-বিডিআর হঠিয়ে ওই খুনি কুলাঙ্গারদের সভা সমাবেশ ধুলিস্যাৎ করে দেয়া হয়েছিল। অপু তার কর্মদক্ষতা ও সাহসিকতার কারনে ক্রমশই নৈকট্য লাভ করতে থাকেন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনার। নব্বই দশকের শেষ প্রহরে এরশাদের পতন হলে ৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে শরীয়তপুর-১ পালং-জাজিরা নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামীলীগের মনোনয়ন লাভ করেন কে,এম হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ। আওরঙ্গের নির্বচনী বৈতরনী পার করতে অপু ও তার সহকর্মীরা অভাবনীয় সফলতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এলে সারা দেশে শুরু হয় ছাত্রলীগের উপর কঠিন দমন-পীড়ন। সরকারি মদদে ছাত্রলীগকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কখনো মন্টু গ্রুপ, কখনো বরিশাল গ্রুপ আবার কখনো থার্ড ওয়ার্ল্ড নামে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হতে থাকে ছাত্রলীগ। কিন্তু তখন মূল ছাত্রলীগ বা শেখ হাসিনার অস্তিত্ব রক্ষার সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহন করেন ইকবাল হোসেন অপু। ১৯৯২ সালের ২ আগষ্ট তৎকালিন বিএনপি সরকার ছাত্রলীগ নির্মূলের নামে “অপারেশন দূর্বার-৯২” শিরোনামে আইন শৃংখলা বাহিনীর সমন্বয়ে একটি শক্তিশালি মিশন মাঠে নামান। এ সময়কার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ঢাকা ইউনিভারসিটি কেন্দ্রীক রাজনীতিতে অভিভাবকের দায়িত্ব পালনে অনেকাংশেই ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। শত প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে অপু তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে হলে শরীয়তপুর-মাদারীপুরের বেশ কিছু সাহসী ছাত্রলীগের কর্মীদের সমন্বয়ে একটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলেন। এরপর অপুর বিপুল কর্মজজ্ঞের ফল স্বরূপ ১৯৯২ সালে গঠিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে (মাঈন-ইকবাল) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৯৪ সালে গঠিত (শামীম-পান্না) কমিটিতে সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এরপর ২০০২ সাল থেকে টানা ২০১৬ সন পর্যন্ত আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় উপ কমিটির সহ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালে তুমুল আলোচিত-আলোরিত দলীয় কেন্দ্রীয় কমিটিতে জননেত্রী শেখ হাসিনা ইকবাল হোসেন অপুকে সম্মানীত কার্য নির্বাহী সদস্য মনোনীত করে লাখো মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করেন। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জন্ম ইতিহাসে গত ৭০ বছরে শরীয়তপুর সদর উপজেলা তথা পালং থেকে ইকবাল হোসেন অপুর আগে কেউ আ‘লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির নেতা নির্বাচিত হননি। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন থেকেই শরীয়তপুর সদর উপজেলা (পালং) এর আওয়ামীলীগ সমর্থিতরা বাইরের উপজেলার লোকদের ভোট দিয়ে আসছিলেন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ৩৯ বছর পর ১৯৮৬ সালে এই আসন থেকে পালং এর সন্তান তৎকালিন জেলা আ‘লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. মতিউর রহমান দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন। দূর্ভাগ্য যে, সেই নির্বাচনে তার অভাবনীয় পরাজয় হয়েছিল। এর পর গত ৩২ বছর ধরে জেলা সদরের নির্যাতিত আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীরা পালং এর একজন যোগ্য সন্তানের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে আসছিলেন। লাখো মানুষের আরাধনার ফল স্বরূপ ২০১৮ সালের ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরীয়তপুর-১ আসনে পালং এর সন্তান ইকবাল হোসেন অপুকে মনোনীত করেন দেশরতœ শেখ হাসিনা।

আজ থেকে তিন দশক আগে ছাত্রলীগের অস্তিত্ব রক্ষার সেই সারা জাগানো নেতা ইকবাল হোসনে অপু বার বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। ৮০’র দশকের শেষ ভাগ থেকে কখনো আন্ত-দলীয় কোন্দলের শিকার হয়ে, কখনো বিএনপি-জামাতের টার্গেটে পরে আবার কখনো এরশাদ-খালেদার লেলিয়ে দেয়া পেটোয়া বাহিনীর অস্ত্রের নিশানা থেকে বেঁচে এসেছেন অপু। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট শেখ হাসিনার সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সময়ও নেত্রীর খুব কাছাকাছি ছিলেন অপু ভাই। যুবলীগ নেতা মোশতাক হোসেন সেন্টুর সাথে হাতে হাত ধরা অবস্থায় ছিলেন ইকবাল হোসেন অপু। গ্রেনেডের আঘাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন সেন্টু । সৌভাগ্যক্রমে মহান শ্রষ্ঠা সেদিনও জীবন ভিক্ষা দেন অপু ভাইকে। অনেক আগেই ইকবাল হোসেন অপুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ খেতাব দিয়েছেন “মৃত্যুঞ্জয়ী অপু” নামে। অপু শুধু মৃত্যুঞ্জয়ীই নন। অপু ছাত্রলীগের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের এক কিংবদন্তীর নামও বটে।

ইকবাল হেসেন অপু আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পরেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান তার আদর্শবান পিতা আর সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরে মৃত্যুবরণ করেন মমতাময়ী মা। এখন তিনি মা-বাবাহীন একজন এতিম সন্তান। একমাত্র সন্তান দানীব বিন ইকবাল আদর ও স্ত্রীকে ছোট্ট সংসার অপু‘র। এর বাইরে রয়েছে দলীয় লাখো জনতার বিশাল পরিবার। তাকে নিয়ে সহস্র মানুষের সুদীর্ঘ কালের লালিত স্বপ্ন আর নির্বাচনী এলাকা নিয়ে তার পরিকল্পনা। এই দুইয়ের সম্মিলনে চাই আমরা একটি সুখী-সমৃদ্ধ, উন্নত-আধুনিক পালং-জাজিরা। মাদক আর সন্ত্রাস নির্মুলে তিনি অসংখ্যবার যে প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন তা বাস্তবায়নে তার পূর্নাঙ্গ সফলতা কামনা করি। মহান আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন এই মানব দরদী, কর্মী বান্ধব মানুষটাকে দীর্ঘ ও সুস্থ্য জীবন দান করেন। আর বিশ্ব মানবতার জননী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রত্যাশা, তিনি যেন তার ¯েœহধন্য অপুকে আমৃত্যু তাঁর আদর-ভালবাসায় আগলে রেখে দল পরিচালনা ও জনসেবার পথটি আরো প্রসস্ত করে দেন।

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী, শরীয়তপুর, সাবেক আহবায়ক, শরীয়তপুর জেলা ছাত্রলীগ।