নোয়াখালী প্রতিনিধি : দীর্ঘদিন নোয়াখালীতে কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য চলছে। ‘বড়ভাই’ ও ‘মামাদের’ প্রশ্রয়ে অস্ত্রধারী কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্যসীমা অতিক্রমের পথে। অন্তত ৮টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে এ জেলায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক সময় এদের বিরুদ্ধে কঠোর হলেও শেষ মুহূর্তে অদৃশ্য সুতোর টানে পিছু হটতে দেখা গেছে।

“অপরাধী সে কিশোর হোক আর যুবক হোক বা প্রৌঢ় হোক, যত প্রভাবশালী হোক না কেন অপরাধী অপরাধীই। যে অপরাধ করবে তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে কোনো ছাড় নেই”এসপি

কথা হয় নোয়াখালী পৌরসভার প্যানেল মেয়র রতন কুমার পালের সঙ্গে। তিনি জেলা শহরের মাইজদী বাজারে একটি সশস্ত্র কিশোর গ্যাংয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই গ্রুপটি বরগুনার ‘নয়ন বন্ডের বাহিনীর চেয়েও ভয়ংকর। তিনি বলেন, গত ঈদুল আজহার আগের বৃহস্পতিবার আমার স্ত্রী ও ছোট ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সীমান্ত অটোরিকশায় চৌমুহনী যাচ্ছিল।

পথে মাইজদী বাজারে পৌঁছার পর মুনিম, রায়হান, শাওন, সজিব ও সাব্বিরসহ আরও ৭-৮ কিশোর তাদের গাড়ির গতি রোধ করে। তারা প্রকাশ্যে সীমান্ত পালকে মারধর করে এবং আমার স্ত্রীর স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকাসহ ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। আমার সন্তানকে অপহরণের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে ওরা পালিয়ে যায়।

মেয়র বলেন, সন্ধ্যায় কয়েকজন কাউন্সিলরকে নিয়ে সুধারাম থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা না নিয়ে সাধারণ ডায়েরি করে। অভিযুক্তদের গ্রেফতার না করে পুলিশ একজন সিএনজিচালককে আটক করেই দায়িত্ব শেষ করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরা সবাই ‘মামা’ বাহিনীর সদস্য।

জানতে চাইলে সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নবীর হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি আমাদের কন্ঠকে বলেন, জেলা শহরে দুটি কিশোর গ্যাংয়ের কথা জানা যায়। তাদের ব্যাপারে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মোতাবেক আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌরসভার সাবেক কমিশনার জানান, মাইজদী বাজারের এই গ্রুপটি ‘মামা’ বাহিনী নামে পরিচিত।

প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে এরা সক্রিয়। এরা খুবই ভয়ংকর। এদের কারণে স্থানীয় ত্যাগী নেতারা কোণঠাসা। এ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে গোলাগুলিতে দু’বছর আগে পুরাতন কলেজ এলাকার অনন্তপুরে ৩টি খুন হয়। ওই মামলাও অদৃশ্য সুতোর টানে ধামাচাপা পড়ে আছে।

এদের প্রথম টার্গেট- গ্রাম থেকে শহরে আসা প্রবাসী, তাদের স্ত্রী ও সন্তানরা। এরা সুযোগ বুঝে তাদের অপহরণ করে নির্জন স্থানে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে। কোরবানির ঈদে উত্তরবঙ্গ থেকে আসা পশুর বেপারিরা এই বাহিনীর ব্যাপক চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন।

কিশোর অপরাধীদের নিয়ে কথা হয় নোয়াখালী পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। তিনি আমাদের কন্ঠকে বলেন, অপরাধী সে কিশোর হোক আর যুবক হোক বা প্রৌঢ় হোক, যতই প্রভাবশালী হোক না কেন অপরাধী অপরাধীই। যে অপরাধ করবে তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে। কোনো ছাড় নেই । কিশোর অপরাধী, মাদক ব্যবসায়ী, মাদকসেবী ও অস্ত্রবাজদের ব্যাপারে ইতিমধ্যে ওসিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

ভালো কাজের জন্য ইতিমধ্যে নোয়াখালী ডিবি ইউনিট চট্টগ্রাম রেঞ্জ শ্রেষ্ঠ হয়েছে। তিনি বলেন, দায়িত্বে অবহেলা করলে কোনো পুলিশ সদস্যকেও ছাড় দেয়া হবে না। কিশোরদের গ্রেফতার করে কিশোর আইনে বিচারে সোপর্দ করা হবে। তিনি এ ব্যাপারে সাংবাদিক জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নোয়াখালী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও আইনজীবী মো: আবদুর রাজ্জাক আমাদের কন্ঠকে বলেন,কিশোর গ্যাং সমাজে একটি মারাতœকভাবে হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে ।গ্যাংদের কে শেল্টার দিচ্ছে বা কিভাবে আশ্রয়-প্রশয় পাচ্ছে প্রশাসনের আরোও সজাগ দৃষ্টি দেওয়া উচিত। কঠোর বা দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে কিশোর গ্যাং-ঠ্যাং থাকার কথা নয়।তিনি অভিভাবকদের উদ্দেশ্য বলেন, আপনার ছেলে কার সাথে মিশতেছে বা কার সাথে ঘুরতেছে নাকি অতি বিলাসিতার জন্য এই রকম গ্যাংয়ে পরিণত হচ্ছে বিষয়গুলোর প্রতি আপনারা আরোও সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।

অনুসন্ধ্যানে দেখা যায় ,জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায় ভাইয়া বাহিনী নামে একটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। শহরের প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার কব্জায় বেড়ে ওঠা এই বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই কিশোর। এরা সংখ্যায় ৫০-এর বেশি। এদের রাজত্ব চৌমুহনী বাজার, বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা, মেডিকেল কলেজ এলাকা, রমজান বিবি, একলাশপুর, হাজীপুর থেকে জমিদার হাট, সুবর্ণচর, পর্যনাত বিসিৃত।

এরা খুন, ছিনতাই, ধর্ষণ, লুটপাট, জমি দখল ও মাদক ব্যবসা সবই করছে। এরা কখনও ১০-১২টা আবার কখনও ২-৩টা মোটরসাইকেল নিয়ে অপারেশনে নামে। মোটরসাইকেলগুলোর বেশিরভাগই আবার ‘চোরাই’ বা ‘টানা’। ট্রাফিক পুলিশ, থানা ও হাইওয়ে পুলিশের সামনে দিয়েই তাদের চলাচল। কিছুদিন আগেও এ বাহিনীর সদস্যদের গোলাগুলিতে একজন নিহত হন। এর পর এক মাস কেটে গেলেও খুনিরা আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে। গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি অস্ত্রধারীদের। উদ্ধার হয়নি অস্ত্রটিও।বেগমগঞ্জে আরেকটি ভয়ংকর গ্যাং রয়েছে। নাম ‘নিজাম বাহিনী’ ওরফে ‘ফেনাঘাটা নিজাম বাহিনী’ ওরফে ‘দস্যু নিজাম বাহিনী’। তাদের দস্যুতা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসার বিস্তৃতি বেগমগঞ্জের পশ্চিম থেকে লক্ষ্মীপুরের পূর্ব পর্যন্ত। দুই জেলার অন্তত ২ লাখ মানুষ এদের কাছে জিম্মি।

এ বাহিনীতে সক্রিয় রয়েছে কয়েকজন নারী সদস্য।কিশোর ছেলেদের পাশাপাশি নারীদের দিয়ে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। গত ১ আগস্ট এ বাহিনীর মাদক ও পতিতা ব্যবসায় বাধা দেয়ায় দস্যু সর্দার নিজামের নেতৃত্বে বাহিনীর মঞ্জু, করিম ও সুরমা বারইচতলের সর্দার বাড়ির ফয়েজকে সুরমার মাধ্যমে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে অত্যাচার করে হত্যা করে। বেগমগঞ্জ থানায় হত্যা মামলার পর র‌্যাব-১১ নিজামকে ২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেফতার করে।

তবে এই বাহিনীর অপর সদস্য সুমন, সজিব, মইন, জাহাঙ্গীর, কালা খোকা, মিন্টু ও নিজাম বাহিনীর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হোসেন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজামকে গ্রেফতারের পর স্থানীয়দের ওপর অত্যাচার আরও বেড়ে গেছে। তারা বলছে, র‌্যাবকে সহযোগিতার কারণেই নিজামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া হত্যা মামলার বাদী জামাল উদ্দিন পাটওয়ারী ও তার ছেলেদের হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে গ্যাং সদস্য মইন, সুমন ও হোসেনের বিরুদ্ধে।

বুধবার আদালতে আসার পর এরা মামলার বাদীকে ধাওয়া দেয়। দস্যু নিজাম কারাগারে যাওয়ায় তার মাদক সাম্রাজ্য পরিচালনা করছে তার বোন পারভীন ও স্ত্রী রাশেদা আক্তার পলি। এ ব্যাপারে বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ জানান, তিনি এ থানায় নতুন। বুঝে উঠতে সময় লাগবে। তবুও ইতিমধ্যে দিন-রাতে এ বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।

বেগমগঞ্জ পুলিশ সক্রিয় থাকায় এই গ্যাংয়ের সদস্যরা আগের মতো সড়কে দস্যুতা করতে পারেনি। উল্লেখ্য, এ গ্যাংয়ের সদস্যরা ১ বছর আগে সুলতান কলেজ থেকে এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে যায় এবং আজ পর্যন্ত তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

সেনবাগের বীজবাগে সক্রিয় রয়েছে কিশোর গ্যাং ‘ইয়াসিন আরাফাত জয় বাহিনী’। এই বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে ইমরান হোসেন, হাসান, কামরুজ্জামান, আমির হামজা ও মনির উদ্দিন। এ বাহিনীর সদস্যরা গত জুনে কলেজছাত্রী নাহিদা আক্তারকে তুলে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এ ব্যাপারে ওরা একটি ভুয়া কাবিননামা তৈরি করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে।

এ নিয়ে থানায় মামলাও হয়েছে। এ বাহিনীর হাতে রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় সব ধারালো অস্ত্র। এই গ্রুপটি মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। এদের পেছনে রয়েছে ‘বড়ভাই’। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশও তাদের সমীহ করে চলে। এ ছাড়াও জমিদারহাট, বজরা, চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজার, কবিরহাট, উদয় সাধুর হাটেও গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রভাব স্পষ্ট।

সুবর্ণচরেও বেপরোয়া কিশোর গ্যাং সদস্যরা। গত ১ বছরে ২১টি ধর্ষণ, ১৬টি ছিনতাইয়ের অভিযোগ এই গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ১১টি ধর্ষণ মামলা রেকর্ড হলেও গ্রেফতারের সংখ্যা সামান্যই। অনেক অপরাধী শাসক দলের ছত্রছায়ায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

চন্দ্রগঞ্জে দস্যু ‘সোহাগ বাহিনী’র দাপট ব্যাপক। কথা হয় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আনিসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, এই ‘সোহাগ বাহিনী’ ও ‘ফেনাঘাটা নিজাম বাহিনীর’ কথা অসংখ্যবার উপজেলা পরিষদের আইনশৃঙ্খলা সভায় উত্থাপন করা হয়েছে। এরা এতটাই ভয়ংকর যে, এ অঞ্চলের মানুষের জান ও মালেরই কোনো নিরাপত্তা নাই।

বেশ কয়েকবার এদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হলেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই।এসব করায় নিজাম বাহিনী উল্টো এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অপমান-অপদস্ত করে যাচ্ছে। এসব দেখারও যেন কেউ নেই।

(এস/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৯)