প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

বাবা আর একটি সিগারেট ধরিয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বললো, ‘তুমি সত্যি বড় অদ্ভুত ছেলে! সেই শৈশব থেকে তোমাকে দেখে আসছি। তোমার কঠিন এক অসুখ ছিল শিশুকালে, মৃত্যুপথযাত্রী ছিলে কিন্তু তোমার প্রাণশক্তি ছিল প্রচণ্ড। কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে থেকেই সেই প্রাণশক্তি ক্রমে ক্রমে ক্ষয় হতে আমি দেখেছি। তুমি জানো কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় আমি বাধা দেই না। আমি সব জানি, সব বুঝি, তোমাকে ভালো রাখার জন্য টানাটানির সংসারেও যতটুকু পেরেছি করেছি।

কারণ, তোমার যে রাশি চিরদিন তোমাকে নানা রকম মানসিক কষ্টে ভোগাবে। তোমার কুষ্ঠিতেও তাই লেখা আছে। তুমি একজন ভালো লেখক হবে এটা আমি আগেও বিশ্বাস করেছি, এখনো করি। কিন্তু তোমাকে মানসিকভাবে ভালো থাকতে হবে। তুমি যা করতে চেয়েছো করেছো, আমরা বাধা দেইনি। দিলে তোমার আরও মানসিক কষ্ট, বিপর্যস্ততা বাড়তো। তুমি আমার বড় ছেলে। তুমি আমাদের আশা এবং ভরসা। আমি তোমাকে হারাতে চাই না বাবা। আমার ইচ্ছে ছিল, দেশে থেকেই তুমি মানুষ হও। কিন্তু এই দেশ আর সেই দেশ নেই। তুমি যদি আত্মবিশ্বাস থেকে এদেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে গিয়ে দাঁড়াতে পারো, আমার কোনো আপত্তি নেই। আশা করি তোমার মায়েরও অমত থাকবে না।

.......কিন্তু বাবা, কোনো ব্যক্তির প্রতি আক্রোশের বশবর্তী হয়ে বা কোনো প্রকার আঘাত পেয়ে যদি তুমি পালাতে চাও এর পরিণাম কিন্তু ভালো হবে না, তোমারও না আমাদেরও না। কারণ সেখানে গিয়েও তুমি শান্তি পাবে না। ভেবে দেখো।’ আমি এই মানুষটিকে সর্বদর্শী দেবতা বলেই জানি। বাবা কার কথা বলছে, আমার বুঝতে বাকি নেই। আমাকে ও ‘স’কে বাবা অনেকদিন নির্জন ছাদে বসে থাকতে দেখেছে। তাছাড়া শহরেও অনেকেই দেখেছে একসঙ্গে রিক্সায়। বাবার কানে কি সেই সংবাদ যায়নি? অবশ্যই গিয়েছে। কিন্তু বাবা-মা কোনোদিন এই বিষয়ে ভুলেও আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেনি। জানতে চায়নি।

এখন বাবা ভেবেছে ‘স’র সঙ্গে আমার ঘোরতর কোনো ঝগড়া-ঝাঁটি হয়েছে। বা এমন কিছু ঘটেছে আমি ভগ্নচিত্তে মনের দুঃখে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছি। হ্যাঁ অবশ্য এটাও একটি কারণ, তবে গৌণ। তবে এর সঙ্গে পারিবারিক ভবিষ্যতের কারণও যে বহুলাংশে বেশি সেটা বাবা মনে হয় বুঝতে পারেনি। আমি বললাম, ‘বাবা, তুমি জানো, সব বোঝো। লুকোচুরির কিছু নেই। যে কারণেই হোক কারো কারো সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভেঙ্গেছে। এর জন্য কারো প্রতি বিন্দুমাত্র রাগ-বিরাগ নেই। ক্রোধ, আক্রোশ কোনোটাই নেই। আমি নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছি বাবা। আর তোমার, মার ও ভাইবোনের প্রতি রয়েছে গুরু দায়িত্ব সেটা পালন করতেই হবে। তুমি লতিফমামাকে বলে কোনো দেশে পাঠাতে পারো কিনা দ্যাখো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি নিজেও চেষ্টা করবো।

আমি আজকেই রাতের ট্রেনে কুমিল্লা চলে যাচ্ছি। শুনলাম তোমারও বদলির সম্ভাবনা আছে আবার কুমিল্লায়, এটা কি ঠিক? তোমার পাশে যে বসেন সিদ্দিককাকু তিনি বলছিলেন সেদিন।’ বাবা বললো, ‘হ্যাঁ। বদলির অর্ডার হয়েছে। এখন কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছি। দু’মাসের মধ্যেই আবার কুমিল্লা পুলিশ কোর্টে ফিরবো। কোর্ট ফিরে পেতে চাচ্ছে আমাকে। ঠিক আছে বাবা, তোমার ভালোই আমাদের ভালো। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। মে গড ব্লেস ইউ।’ আমি দুচোখ ভর্তি জল নিয়ে বাবাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। কুমিল্লায় ফিরে এসে শুধু প্রতীক্ষা করতে লাগলাম কবে একটি সুখবর নিয়ে আসবেন লতিফমামা। খুব একটা বেরোতাম না বাইরে। স্বপন, বিষ্ণু, শঙ্কর আসতো বাসায় বসেই আড্ডা হতো। বেশি দূর গেলে পার্ক পর্যন্ত।

কেনো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলাম কেউ জিজ্ঞেস করলেও আমি উত্তর দিতাম না। লাইব্রেরি থেকে এনে প্রচুর বই পড়তে লাগলাম। আর রাত হলেই গান। এভাবে মাস খানেক চলে গেল। লতিফমামা একদিন বললেন, ‘বিদেশে যেখানেই যাও গ্রাজুয়েশনটা থাকলে ভালো হয়। চট্টগ্রাম না যাও, ঢাকায় চেষ্টা করে দেখো না এম এতে ভর্তি হওয়া যায় কিনা? আমিও চেষ্টা করে দেখি। এম এ করার ফাঁকে লাইনঘাট যদি পাই তখন চলে যেও। টাকার ব্যবস্থা আমি করবো পরে শোধ করে দিলেই হবে।’ মামার কথায় কিছুটা আশান্বিত হলাম। মফিজের কথা মনে পড়লো। তার বাসায় গেলাম।

মফিজের ছোট ভাইটিকে বলে রাখলাম ও কুমিল্লা এলে পরে যেন অবশ্যই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। কিছুদিন পর মফিজ কুমিল্লায় এলে পরে বাসায় দেখা করতে এলো। তাকে সব খুলে বললাম। শুনে বললো, ‘ঢাকায় আয় আমার রুমে থাকিস। দেখি কি করা যায়।’ সে ছাত্রলীগের নেতাগোছেরও ছিল। বললো, ‘আমিও চেষ্টা করছি আমেরিকাতে পাড়ি দিতে। তুইও চেষ্টা করে দেখতে পারিস। তাজু তো ফ্লোরিডাতে থাকে।’

একদিন ঢাকায় গিয়ে মফিজের ওখানে উঠলাম মহসীন হলে। একদিন দেখি আফজালও এসে হাজির। সে উঠেছে তার আত্মীয়র রুমে সূর্যসেন হলে। বললাম, ‘কিরে তুই এখানে কেন?’ বললো, ‘তুই চলে এসেছিস, আমি থাকি কি করে? রাজনীতি আসলে ঢাকায়, চিটাগাঙে নেই। তাই দেখছি এম এতে ট্রান্সফার হওয়া যায় কিনা। তোর কিছু হলো নাকি?’ বললাম, ‘না। খুব টাফ্ মনে হচ্ছে। দেখা যাক।’

একদিন কুমিল্লা থেকে স্বপন এসে হাজির হলো মহসীন হলে। বললো, ‘মাওইমা অসুস্থ দেখতে এলাম।’ মাওইমা মানে স্বপনের সেজবোন রত্নাদির শাশুড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই কোথায় যেন থাকতো তখন তারা। সেখানে ‘স’র বয়সী অপুও থাকে। অপুর আসল নাম শিল্পী সরকার, স্বপনের বেয়াইন। পরবর্তীকালে টিভি নাটকের তারকা হয়েছিল। নাট্যকার হিসেবেও সুনাম করেছিল। আমাকে নিয়ে গেল স্বপন। অনেকদিন পর দেখা হওয়াতে খুব ভালো লাগলো। এখনো দেশে ফিরলে একবার যাই অপুর বাসায়। সেবার দারুণ যত্নআত্তি করলো।

ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘স’র সঙ্গে কী এমন হলো, মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ!’ বললাম, ‘ও এক নৌকায় পা দিয়েছিল, আর আমি দু’নৌকায় একসঙ্গে তাই আমাকেই পা হড়কে জলে পড়তে হলো। দোষ আমারই। বাকিটা ওকে জিজ্ঞেস দেখো কী বলে?’ তারপর একদিন স্বপন বললো, ‘যাবি একবার দেখা করতে?’ বললাম,.......‘কি হবে স্মৃতির ফুল সুরভি দিলে / কাঁটার বেদনা যদি লুকিয়ে থাকে.....।’ তবুও জোর করে নিয়ে গেল। খালাম্মা দেখে অভিযোগ করলেন, ‘আমি তো মনে করেছিলাম, আমাকে তোরা ভুলে গিয়েছিস! যাক্, এতদিন পর এলি তাহলে।’ খুব আদারযত্ন করে রাতের খাবার পর্যন্ত খাইয়ে দিলেন।

‘স’এর কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। আগের মতোই। বললো, ‘কেমন আছেন?’ বললাম, ‘যেমন দেখছো। ভাবছি বাইরে চলে যাবো।’ একটু চঞ্চল হতে দেখলাম। বললো, ‘কবে নাগাদ? কোন্ দেশে?’ ‘এই বছর না হলে আগামী বছরের মাঝামাঝি। আমেরিকা বা জাপান।’ দীর্ঘ ঘন চুল আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে নির্বিকার কন্ঠে বললো, ‘ভালোই তো। বিদেশে গেলে আপনি শাইন করবেন কোনো ভুল নেই।’ আমি হেসে বললাম, ‘অত শাইন করার ইচ্ছে নেই, খেয়ে-পরে বাঁচতে পারলেই হলো।’ শুনে হঠাৎ ‘স’ অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছুঁড়ে বললো, ‘স্বপ্নহীন, সাহসহীন লোক তাই আমার দুই চোখের বিষ!’ বলেই উঠে চলে গেল ভিতরের ঘরে।.............চলবে

আলোকচিত্র: আমার পরম পূজণীয় বাবা ও মা সুদীর্ঘ বছর যাঁরা আমাকে আগলে রেখেছেন সব অশুভ শক্তি থেকে

লেখক : জাপান প্রবাসী