রূপক মুখার্জি, নড়াইল : দালাল অফিস  চালায় একথা লোকমুখে প্রচলিত হলেও বাস্তবে নড়াইল বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) অফিসের হর্তাকর্তা উজ্জ্বল হোসেন নামের এক দালাল। সরকারী এই অফিসে তার জন্য বরাদ্দ আছে চেয়ার-টেবিল। প্রতিনিয়ত সরকারী কাগজপত্র আর সীল দিয়ে তৈরী করেন মোটর ড্রাইিভিং লাইসেন্স এর কাজ। টানা  ১২ বছর উপরের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে সরকারী গুরুত্বপূর্ণ  এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ঘুষের টাকায় বাড় বাড়ন্ত দালাল উজ্জ্বল।

নড়াইলের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের লাগায়ো বিআরটিএ অফিস। যশোর এবং নড়াইল এই দুটি জেলা মিলে সার্কেল। নড়াইল অফিসে নিয়মিত কর্মচারী মাত্র দুই জন। দুই বছর আগে রেকর্ড কিপার হারুন-অর-রশীদ আর ৬ মাস আগে ইনড্রোলমেন্ট অফিসার আবু হুরায়রা এখানে যোগদান করেন। যশোর থেকে কর্মকর্তারা অনিয়মিত আসলেও উজ্জ্বল হোসেনের উপস্থিতি এ অফিসে নিয়মিত। এলাকার সকলের কাছেই যিনি বিআরটিএ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। অথচ, তিনি একজন নিরেট দালাল।

২৩ সেপ্টেম্বর বিআরটিএ অফিসে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রত্যাশীদের ভীড়ে অফিস গমগম করছে, সবাই ভীড় করে আছেন উজ্জ্বলের টেবিলে। তিনি খুব গুরুত্বের সাথে সিল ছাপ্পর মেরে কাজ সারছেন। পদবী জিজ্ঞেস করায় সাবলীল ভঙ্গিতে বললেন “সীল মেকানিক”। পাশের রুমে কম্পিউটার এর সামনে বসে আসেন সজীব নামের আরেক দালাল,পদের কথা জিজ্ঞেস করতেই বলেন, আমি ইন্সপেক্টর স্যার এর সাথে এসেছি।

অন্য রুমে যশোর থেকে আসা মোটর ইন্সপেক্টর রামকৃষ্ণ পোদ্দার। তার কাছে নড়াইল বিআরটিএ অফিসে কর্মরত লোকদের সংখ্যা-পদবী জানতে চাইলে তিনি তেড়ে বললেন “আমার পরিচয় নেন,অন্যদের পরিচয় নিতে গেলে যশোরে সরকারী পরিচালকের সাথে দেখা করে জেনে আসুন, আর না হলে নিজে খুজে বের করুন” এই বলে রুম থেকে প্রায় তাড়িয়ে দিলেন।

বর্তমানে দালাল উজ্জ¦লের আশ্রয়দাতা হলেন ইন্সপেক্টর রামকৃষ্ণ পোদ্দার। ফিল্ড টেস্ট এর দিনে টাকা আদায়ে সজীব কে নিয়ে আসেন তিনি। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে কর্মকর্তা সেজে কাজ করা উজ্জ্বল হোসেনের পদের কোন অস্থিত্বই নেই নড়াইলে বিআরটিএ তে । সরকারি জনবল নিয়োগ বিধিতে “সীল মেকানিক” পদের অস্থিত্ব নেই। কেবলমাত্র ঘুষের টাকা আদায়ে এই পদ তৈরী।

উজ্জ্বল এর বাড়ি যশোর। মাইকপট্টি এলাকায় “উজ্জ্বল ডট কম” নামে একটি ইলেকট্রিক শপ থাকলেও মূলতঃ বিআরটিএ কর্মকর্তার পরিচয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়াই তার কাজ। ৭ থেকে ১০ হাজার টাকায় হালকা ও ভারী যান এর লাইসেন্স করে দেন উজ্জ্বল। চালকের ফিটনেস কিম্বা দক্ষতা নির্ভর করে টাকার উপর, টাকা দিলেই ইন্সপেক্টর তাদের উত্তীর্ণ করে লাইসেন্স দেন। টাকা না দিলে দিনের পর দিন ঘুরেও লাইসেন্স পায়না ভূক্তভোগীরা। টানা একযুগেরও বেশী সময় কাজ করে উজ্জ্বল যশোরে বিলাস বহুল বাড়ি আর বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন অনুসন্ধান কালে জানা গেছে।

লাহুড়িয়া গ্রামের আকরাম হোসেন বলেন, লাইসেন্স এর জন্য উজ্জল ৭ হাজার টাকা চাইছিলো তা দিইনি বলে আমারে ফেল করাইছে,আবার জমা দিলাম।

মোটর ড্রাইভিং লাইসেন্স এর সরকারী ফি জমা দিয়ে এক বছর ঘুরছেন হাটবাড়িয়া গ্রামের সরকারী কর্মকর্তা প্রফুল্ল কুমার কুন্ডু ও সঞ্জয় কুমার কুন্ডু। উজ্জ্বলের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা না দেয়ায় তাদের লাইসেন্স হচ্ছে না বলে অভিযোগ।

কালিয়া সরকারী কলেজের প্রভাষক মো.আবু জাফর বলেন, মোটরসাইকেলের চালক হিসেবে লাইসেন্স পেতে উজ্জল নামের একজন তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে লাইসেন্স করিয়ে দিয়েছে। যা প্রকৃত খরচের চেয়ে ৩ গুন বেশী।

বিআরটিএ সুত্রে জানা গেছে, মোটর সাইকেল/ হালকা যান চালকের লার্নার(শিক্ষানবীশ) ইস্যু ফি ৫’শ ১৮ টাকা আর ড্রাইভিং লাইসেন্স এর সরকারী ফি ২ হাজার ৫’শ ৪২ টাকা। কিন্তু ঝামেলা আর ফিল্ডটেস্টে ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে দালাল উজ্জ্বল প্রত্যেকের কাছ থেকে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিয়ে থাকে। গড়ে প্রতিমাসে ৮০/১০০টি লাইসেন্স আবেদন এর বিপরীতে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্রটি। ভারী গাড়ির চালকের লাইসেন্স নবায়নে সরকারী ফি ১ হাজার ৮’শ ৫২ টাকার স্থলে নেয়া হয় সাড়ে আট হাজার টাকা। গত ১২ বছরে নড়াইলের এই অফিস থেকে উজ্জল এর মাধ্যমে ঘুষ বাবদ আয় হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। এর বিনিময়ে অযোগ্য ও অদক্ষ চালকেরা পেয়েছেন ড্রাইভিং লাইিসেন্স।

নড়াইল পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহির জানান, উজ্জ্বল তো এই অফিসের মূল লোক, এখানকার কর্মচারী না হলে, সে কিভাবে সরকারী অফিসের চেয়ারে বসে, অফিসের কাগজপত্র-সীল ব্যবহার করে।

অভিযোগ বিষয়ে দালাল উজ্জ্বল হোসেন(০১৭১২৬৬০৮০৬)বলেন, আমি একজন ছোট মানুষ,নিয়ম অনুয়ায়ী অফিসের কাজ করি। লাইসেন্স এর সব কাজই কর্মকর্তারা করেন। বেশী টাকা নেবার কথা তিনি এড়িয়ে যান।

মোটর ইন্সপেক্টর রামকৃষ্ণ পোদ্দার(০১৭১৭২২৫৪৯৭) বলেন,উজ্জ্বল আর সজীব আমার হয়ে কাজ করে একথা কে বলেছে? আমিতো মাসে একদিন যাই। আমি এখানে যোগদানের অনেক আগে থেকেই উজ্জ্বল নড়াইলে কাজ করে।

বি আর টি এ এর সহকারী পরিচালক কাজী মোহাম্মদ মোরসালিন(০১৭১৯৩৯৩৭০১) বলেন,অফিসে সব কাজই তো নিয়ম অনুয়ায়ী হচ্ছে। তাছাড়া অতিরিক্ত টাকা দিয়ে লাইসেন্স তৈরীর কোন অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। অভিযোগ আসলে ব্যবস্থা নেব।

(আরএম/এসপি/অক্টোবর ০১, ২০১৯)