শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : দূরের স্বর্গকে নজরবন্দি করতে ঘুরে আসুন বাংলাদেশের উত্তরের পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া। দর্শন করুন প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি নয়নাভিরাম কাঞ্চনজঙ্ঘা। 

সাধারণতঃ অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত আকাশে যখন মেঘ থাকেনা, আবার কুয়াশা পড়া শুরু’তে শুধুমাত্র তখনই তেঁতুলিয়া থেকে দেখা যায় বরফে ঢাকা ধবল পাহাড়ের চূড়া দার্জিলিং-এর কাঞ্চনজঙ্ঘা।তেঁতুলিয়া থেকে এত ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়না। সকাল ৮টা থেকে সূর্যকিরণ যখন তেজ হতে থাকে তখন স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। সকাল দশটা পর্যন্ত বেশ ভাল দেখা যায়। তারপর আস্তে আস্তে ঝাপসা হতে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। শেষ বিকেলে সূর্যকিরণ আবার যখন তির্যক হয়ে পড়ে বরফ পাহাড়ে তখন অপূর্ব মহিমায় অন্যরূপে ধরা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। পর্যটকদের অবাক করতে থাকে তার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে।

এ দৃশ্য বর্ণনা করার মতো নয়। দেখতে দেখতে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে সংশয় হয়। ডাকবাংলোর বারান্দায় দাঁড়ালে আপনার চোখে পড়বে ভারত-বাংলাদেশের অবারিত সৌন্দর্য। ওই স্থান থেকে হেমন্ত ও শীতকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বর্ষাকালে মহানন্দা নদীতে পানি থাকলে এর দৃশ্য আরো বেশি মনোরম হয়।

কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখতে সারাবিশ্ব থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ভারতের টাইগার হিলে ছুটে যান। ভোরে উষার সময় কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর রোদ পড়ে সেই রোদ যেন ঠিকরে পড়ে পর্যটকের চোখে। দার্জিলিং-এর টাইগার হিলই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখার সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। কিন্তু যদি পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই সেই দৃশ্য দেখতে পারেন তবে কেমন হয়? হ্যাঁ এমন সুযোগই রয়েছে।

মহানন্দার তীরে নিরিবিলি ডাকবাংলোতে বসে দেখবেন নদী থেকে পাথর কুড়ানো আর অপর পাড়ে ভারতীয় জনপদে মানুষজনের আনাগোনা। যদি অঝোরে বৃষ্টি নামে তবে নির্জন ডাকবাংলোর বারান্দায় এক কাপ ধূমায়িত চা হাতে নিয়ে চুপচাপ শুনবেন বৃষ্টির গান। আর যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তাহলে তো কথাই নেই-বাংলাদেশে বসেই দেখা যাবে হিমালয়ের অন্যতম বড় পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য!

হ্যাঁ, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে ভারতের দার্জিলিং যাওয়ার দরকার নেই। এই বাংলাদেশ থেকেই এমন দৃশ্য দেখা সম্ভব। দার্জিলিং চায়ের স্বাদও নিতে পারেন তেঁতুলিয়ায় বসেই। সিলেটের পর দেশের সবচেয়ে বেশি চায়ের আবাদ যে এখানেই হয়! এখানকার চা বাগানিদের দাবি, তেঁতুলিয়ার চায়ের মান পৃথিবী বিখ্যাত দার্জিলিং চায়ের কাছাকাছি।

তেঁতুলিয়া পাড়ে নির্মিত হয়েছে ‘তেঁতুলিয়া রিভার ভিউ’। বানিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ভোলায় আসলে বাবা-মা এর কবর জিয়ারত করে অবসর সময় কাটানোর জন্য যান এখানে। ভোলায় যখন কেউ বাণিজ্যমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হয়ে আসলে তাকে নিয়েও তোফায়েল আহমেদ যান এখানে।

নদীবাধের কাজে ব্যবহৃত ব্লকে কাজে লাগিয়ে বাহারি সাজে সাজানো হয়েছে এ ‘তেঁতুলিয়া রিভার ভিউ পার্কটি।’ সারিবদ্ধভাবে ব্লকের উপর আবার ব্লক বসিয়ে ৩টি করে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে তা সাদা, লাল ও হলুদ রঙে রাঙিয়ে সাজানো হয়েছে বাহারি রূপে। তার উপর রোদে পরিবার সহ বসা ও বসে কথা বলার জন্য রয়েছে কংক্রিটের ছাতা ও টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা।

তাছাড়া ছবি তোলার জন্য ও একটি চমৎকার জায়গা আছে পার্কটি। তাই প্রতিদিন এখানে দেখা মিলবে ছবি তুলতে আসা দর্শনার্থীদের। নেই কোন প্রবেশ মূল্য, নেই নিরাপত্তা জনিত কোন সমস্যা বা পার্কিং ফি তাই যেন নিয়মিত বাড়ছে ভ্রমন পিপাসুদের সংখ্যা তেঁতুলিয়া রিভার ভিউতে।

সে যায় হোক। আপনি তো আর চায়ের গুণাগুণ পরীক্ষা করতে যাচ্ছেন না! আপনি দেখবেন, এখানকার সমতল ভূমির সুন্দর সুন্দর সব চা বাগান। পঞ্চগড় শহর থেকে তেঁতুলিয়া রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর রাস্তার দু’ধারে পাওয়া যাবে চা বাগান।

ও হ্যাঁ, রাস্তায় চোখে পড়বে আরও একটা জিনিস। এখানকার অনেক এলাকায় মাটি খুঁড়লেই পাওয়া যায় পাথর। তাই অনেক জমির মালিক মাটি খুঁড়ে পাথর তুলে তুপ করে রাখেন পথের ধারে, বিক্রির জন্য।পাথর পাওয়া যায় আরও এক জায়গায়। সেটি মহানন্দা নদী। স্রোতের টানে ভারত থেকে নেমে আসে পাথর। নদী থেকে এসব পাথর সংগ্রহ করে এখানকার দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ।

তেঁতুলিয়ায় মহানন্দার তীরে সরকারি ডাকবাংলোতে আস্থানা গেড়ে সেখান থেকে চলে যাবেন বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। বর্তমানে এই একটি মাত্র পথেই বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে আমদানি-রফতানির বাণিজ্য চলে। বাংলাবান্ধা সীমান্তের সব চেয়ে কাছে ১০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি শহর।

তেঁতুলিয়া আর পঞ্চগড়ে বেড়াতে গিয়ে দেখবেন আরও অনেক কিছু। এরমধ্যে আছে রকস মিউজিয়াম। পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে ১৯৯৭ সালে স্থাপিত এটি পাথর সম্পর্কে দেশের প্রথম জাদুঘর। এখানে দেখতে পাবেন প্রাগৈতিহাসিক কালের ছোট-বড় নানারকম পাথর, পাথরের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র, পাথরে খোদাই করা লেখা।

পঞ্চগড় সদর উপজেলার ভিতরগড়ে পাবেন মহারাজার দিঘি। এখানেই আছে বন বিভাগের বিশাল শালবন, আছে শালমারা বিল।

সপ্তাহের দু’দিন ছুটি সামনে রেখে বৃহস্পতিবার রাতে ওঠে পড়ুন বাসে। ভোরে নামবেন পঞ্চগড়। সেখানে দেখুন রকস মিউজিয়ামসহ আশপাশের এলাকা। বিকেলে চলে যান তেঁতুলিয়া। রাত কাটিয়ে পরদিন ঘুরেফিরে দেখুন বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, চা বাগানসহ আশপাশের এলাকা। সেদিনই পঞ্চগড় ফিরে রাতের বাস ধরুন, সকালে ফিরে আসবেন ঢাকা।
কীভাবে যাবেন:

রাজধানী থেকে পঞ্চগড়ের সরাসরি বাস পাবেন। বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে। পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়ায় বাস চলাচল করে সারাদিন। এছাড়াও ঢাকা থেকে তেঁতুলিয়ায় সরাসরি চলাচল করে বাস। তেঁতুলিয়ায় নেমে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, চা বাগান বা আশপাশের এলাকায় ঘোরাঘুরির জন্য স্কুটার ভাড়া করাই ভালো। আর যদি মাইক্রোবাস নিতে পারেন তাহলে তো কথাই নেই।

কোথায় থাকবেন:

পঞ্চগড়ে অনেক হোটেল আছে। তেঁতুলিয়ায় মহানন্দা নদী তীরের ডাকবাংলোতে থাকার জন্য তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। বন বিভাগের রেস্টহাউসে থাকার জন্য জেলা সদর অথবা তেঁতুলিয়ায় বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে হবে।বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরেও জেলা পরিষদের ডাকবাংলো আছে, এখানে থাকার অনুমতি নিতে হবে পঞ্চগড় থেকে।

(এএস/এসপি/অক্টোবর ২৩, ২০১৯)