বরগুনা প্রতিনিধি : বৈশাখী মেলা আমাদের চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্যের উৎসব। চৈত্র সংক্রান্তি আর বৈশাখী মেলার উৎসব এখনও বাঙালীর প্রাণের উৎসব হিসেবেই টিকে আছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও শত শত বছর ধরে টিকে থাকা মেলার ইতিহাস আছে। কোথাও আবার মেলার বিষয় বৈচিত্র্য ভিন্নতর হওয়ার নজির আছে। মেলার ভিন্নতার কারণে কোন কোন জনপদ বৈশাখী মেলা ঘিরেও আলোচিত ও পরিচিতি পেয়েছে।

আমাদের উপকুলীয় অঞ্চলে গ্রাম গঞ্জে অনেক স্থানের মেলা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে গেছে। এসবের পরেও কোথাও আবার শত বছর ধরে সমৃদ্ধ ইতিহাস হিসেবেই টিকে আছে। তেমনি একটি গ্রামীণ জনপদ উপকুলীয় বরগুনার বামনার ডৌয়াতলা । এটি এ জনপদের একটি বৃহৎ ইউনিয়ন। সেই সাথে বামনা উপজেলা সদরের চেয়েও ব্যবসা বানিজ্যে জমাট এ ইউনিয়ন বাজার। মানুষের সমাগমও বেশি। এখানে এ ইউনিয়ন বাজার ঘিরে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আমাদের দক্ষিণ উপকুলীয় অঞ্চলের অন্য জনপদের বৈশাখী মেলার মত নয়। আলাদা বৈচিত্র্যের এ মেলা অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবছর ২-৩ বৈশাখ।
মেলা ঘুরে জানা গেছে,ডৌয়াতলার এ বৈশাখী মেলা শুরু হয় বিকাল তিনটায় । এরপর সন্ধ্যায় নামলেই মেলা জমতে শুরু করে। মানুষের ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকে। ডৌয়াতলার এ বৈশাখী মেলায় সারা বামনা জনপদের মানুষ তো বটেই দুর দুরান্ত থেকে ব্যবসায়িরা তাদের পসরা নিয়ে আসেন। সারারাত এখানে মেলা জমে থাকে। বাজারের সব দোকান পাট খোলা। কারণ সরারাত এ মেলাকে ঘিরে এ জনপদের ব্যবসায়িদের হালখাতা উৎসব হয়। এই মেলার দুই দিনের রাতে পুরোনো হিসেব নিকেশ মিটিয়ে ফেলে মানুষ। ২ বৈশাখ বিকেল থেকে মেলা শুরু হয়ে সারারাত মেলায় মানুষের সমাগম অবিশ্বাস্য রকমের সত্য। মেলা চলে পরদিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত। মেলার সময়ে যেন দিন রাতের পার্থক্য করা যায় না। এখানে এই ইউনিয়ন বাজারে মেলার বৈচিত্র্য একদিকে যেমন আলাদা তেমনি বামনা উপজেলা সদরে বৈশাখী মেলা না হওয়ায় ডৌয়াতলার মেলার প্রতি আগ্রহ বেশি। রাতভর মেলা মানে উৎসবের অন্য এক আমেজ। এই দিনে ব্যসায়িরাও তাদের লাভের অংকে যেন সমৃদ্ধশালী হন। নানা রকম খেলনা,মাটির পুতুল থেকে মাটির তৈজষপত্র, মুদি মনোহারী, বৈচিত্র্যময় খাবারের পসরার পাশাপাশি মাছ সবজিও মেলার অন্য অনুসঙ্গ। আর এ মেলা রাতভর হওয়ার কারনে মেলার আমেজটা অন্যজনপদের তুলনায় বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
স্থানীয়দের জনশ্রুতি সূত্রে জানা গেছে,বামনা ও মঠবাড়িয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী বামনা অংশে ডৌয়াতলা ইউনিয়ন বাজারটি গড়ে ওঠে শত বছর আগে। স্থানীয় সম্ভ্রান্ত দুই ব্যক্তি পণ্ডিত খাঁ ও কদম আলী জমাদ্দারসহ আরও কয়েক ব্যক্তি মিলে ডৌয়ালা গ্রাম্য বাজারটির সূত্রপাত ঘটান। শতবছর পরে এ বাজারটি এখন উপজেলার সবচেয়ে বড় ব্যবসা বন্দরে পরিণত হয়েছে। বাজার গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রতিবছর বৈশাখ মারে দ্বিতীয় দিন বিকালে দুই দিন ব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। তবে বৈশাখী মেলা সারারাত ধরে অনুষ্ঠিত হওয়ার ইতিহাস বেশি দিনের নয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ি ফিরোজ হাওলাদার জানান, এ মেলাকে ঘিরে এখানে সারা বাজারের ব্যবসায়িরা হালখাতা উৎসব করেন। তাছাড়া বাজারের স্কুল ও কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত হয় গান বাজনা। বাজার কমিটি এ মেলার আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা করে আসছেন। শান্তি শৃংখলা ভাল বলে মানুষ রাতের মেলায় নিশ্চিন্তে উৎসবের উচ্ছাসে মেতে থাকে। ১০০ বছরের এ মেলা নিয়ে এ জনপদের মানুষ এখনও গর্ববোধ করে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে সব ধরনের মালামাল সারারাত ধরে বেচা কেনা হয়। আর এখানকার ব্যবসায়িরা রাতের এ মেলায় ভাল লাভবান হওয়ায় মেলাটি টিকে আছে ঠিক আগের মতই।
মেলার ভেতর আরেক মেলা বাঙ্গি আর তরমুজ মেলা :
বুধবার রাত নয়টার দিকে ডৌয়াতলা ইউনিয়ন বাজারের মেলা সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে লোকে লোকরন্য। পুরো বাজারের অলিগলি রাস্তাঘাট যেন জনসমুদ্রে পরিনত হয়েছে। পুরো বাজার জুড়ে আলো আর উচ্চসিত মানুষের কোলাহলে মুখরিত। রাতের কোন নিস্তব্দতা এখানে নেই। এ মেলার সব দোকানের পসরার মধ্যে সবার দৃষ্টি করে নেয় বাঙ্গি আর তরমুজের মেলা। যা এখানের বৈশাখী মেলাকে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছে। বন্দরের ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উত্তর পাশের খোলা প্রান্তর জুড়ে বাঙ্গি ও তরমুজের মেলা বসেছে। শতাধিক দোকানের ক্রেতার উপচে পড়া ভির জানিয়ে দেয় পুরো মেলার ভেতরে বাঙ্গি ও তরমুজ মেলাও মোটেই কম জমেনি। এখানে বিক্রেতারা নাচ আর গানের সুরে ক্রেতা সাধারণকে আকৃষ্ট করার চেষ্টায় মহাব্যস্ত। আর ক্রেতারাও আনন্দে কিনছেন।
তরমুজ ব্যবসায়ি মামুন হাওলাদার বলেন, এখানে মেলায় আগত মানুষজন সব কেনা কাটার পাশাপাশি তরমুজ ও বাঙ্গি কেনে আগ্রহ নিয়ে। মেলায় এসে তরমুজ আর বাঙ্গি কেনা এখানের মানুষের রেওয়াজে পরিনত হয়েছে। তাই মেলায় আসা মানুষের হাতে বাঁশি, বেলুন, হাড়ি পাতিলের পাশাপাশি বাঙ্গি ও তরমুজ থাকতেই হবে।
তরমুজ ব্যবসায়ী আলী মুন্সি জানান, মেলার দিনে বাঙ্গি ও তরমুজ না কিনলে মেলায় আসাই বৃথা। তাই মেলায় ঘুরে সব কেনাকাটার পর সব শেষে মানুষজন বাঙ্গি ও তরমুজ কেনে তারপর বাড়ি ফেরেন। মেলায় এখানে শতাধিক দোকনী বাঙ্গি ও তরমুজের পসরা নিয়ে বসেন। এক একজন ব্যবসায়ি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বিক্রয় করে থাকেন। এখানে স্থান সংকুলান না হওয়া ক্রেতা সাধারণের চলা ফেরা কষ্ট হয়। তবু মেলার উচ্ছাসে মানুষের কাছে এ কষ্ট অতি তুচ্ছ। মেলায় বাঙ্গি ও তরমুজের মেলা এখানে বৈশাখী মেলাকে আর প্রাণবন্ত করেছে বলে এ ব্যবসায়ি মনে করেন।
সরারাত বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি এ জনপদে আলাদা বৈশিষ্ট্য ও পরিচিতি এনেছে। ফলে রাতের বৈশাখী মেলা ডৌয়াতলা গ্রামজনপদের এখন সমৃদ্ধ এক ঐতিহ্য।
এ ব্যাপারে ডৌয়াতলা ইউনিয়ন বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আফজাল খান বলেন,এ মেলা শত বছরেরও পুরোনো। এতদাঞ্চলে রাতভর এমন বৈশাখী মেলা আর দ্বিতীয়টি নেই। বাজার কমিটি ও প্রশাসন মিলে এ মেলার ব্যবস্থাপনা করে আসছে। এখানে নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ কোন শংকিত না থাকায় গরমের রাতে মেলা জমে ওঠে ঠিক দিনের মত। আর মেলা এখন মূল বাজার ছাড়িয়ে মহাসড়কের দুই পাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে বামনা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. সাইতুল ইসলাম লিটু মৃধা বলেন, ডৌয়াতলার বৈশখী মেলা শত বছরে এতিহ্য হিসেবেই টিকে আছে। এ মেলা অন্য অঞ্চলের বৈশাখী মেলার তুলনায় কিছুটা আলাদা। রাতের মেলা বলে এর আমেজও আলাদা । এ ঐতিহ্যটি আমাদের বামনার সমৃদ্ধ ইতহাস হিবেই আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
(এমএইচ/এএস/এপ্রিল ১৭, ২০১৪)