মাহবুবা সুলতানা শিউলি


‘তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন, সব সময় এই নীতিতেই মানুষ চলতে চায় কিন্তু অনেক সময় এই নীতিতে চললে শুধুই দুর্বল ভাবা হয়! তাই মাঝে মাঝে ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম, এ নীতিও অনুসরণ করতে হয়। কেবল শারীরিকভাবে আক্রমণই সহিংসতা নয়, ভাষা ও সহিংসতার একটা প্রকাশ। আপনার ভাষা ও চিহ্নিত করে আপনি সহিংস কিনা; আপনার আশেপাশে, ফেইসবুকে, পত্রিকার পাতায়, খুব সাজানো অনুষ্ঠানে কে কী বলেছেন সেটা দেখুন তা হলেই বুঝতে পারবেন। কোথা থেকে সমাজে অসহিষ্ণুতা এবং সহিংসতা বাড়ছে।

কখনও কখনও ভাষাগত আক্রমণ শারীরিক আক্রমণের চেয়েও মারাত্মক। মানুষ আজ বড় অসহিষ্ণু। নিজেকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। কিন্তু কেন? দুঃসময়ের এই লগ্নে বিদ্রোহী কবি নজরুলের একটি কবিতার দুটো লাইন হৃদয়ে বেজে উঠছে, ‘আমরা সবাই পাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি’।

ফেইসবুক কে প্রথমে আমরা এক প্রকার বিনোদনই ভাবতাম। বন্ধুবান্ধব পরিচিত মহলদের ফেসইবুকে দেখলে ভালো লাগতো। কিন্তু এখন সেইটা নেই। সে ধরণের পোস্ট এখন প্রাইভেসিতে অনলি মি বা অনলি ফ্রেন্ড দিয়ে পোস্ট করতে হয়। পাবলিকলি পোস্ট করলে কে কি কমেন্ট কওে ইয়েত্তা নেই! ফেইসবুকে গল্প, কবিতা, ফিচার, প্রবন্ধ ও পড়তে ভালো লাগতো। তারপর আসতে আসতে ফেইসবুক এমন এক অবস্থায় চলে গেছে এখন এটা রাজনীতির জায়গা। কার কি অবস্থান এখন যেন ফেইসবুকই তা নির্ধারণ করে।

এখানে ভাষার দ্বারা পরস্পরকে আক্রমণ, সহিংসতা এমনকি একটু হিসাবের বাহিরে লিখলেই জান খতম! এখন ফেইসবুকই নির্ধারণ করছে, কে বাঁচবে? কে মরবে? একটু এদিক-সেদিক লিখেছেন তো খবর আছে? মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতেই পারে আমাদের সংবিধানও তা বলেছে। কিন্তু এমন কিছু লিখবনা যা সমাজ রাষ্ট্র ও মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে।

গত বছর অকালে ঝরে যাওয়া শিশু রাইফাকে নিয়ে বার বার লিখতে গিয়ে আমার ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে সব ফ্রেন্ডদের ট্যাগ করেছিল। এত জঘন্য পোস্ট আমার ওয়াল থেকে করা হয়েছিল যা কল্পনাও করা যায় না। সৌভাগ্যক্রমে ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে আইডি উদ্ধার করে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলাম। তারপর থেকে একটু হিসেব নিকেষ করে লিখি।

বেশ কিছুদিন ধরে বার বার লিখতে চেয়েও মন সায় দিচ্ছেনা বাঁধা দেয়! লিখতে পারি না!! এই আমিকে আমি নিজেই চিনতে পারছি না। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, কেন আমি লিখছি না বা লিখতে পারছিনা?

‘অসির চেয়ে মসি বড়’-এটাই বিশ্বাস করি। তাই সমাজের নানান অসংগতি দেখলে আমার কলম কোনো বাঁধা মানে না। আবরার হত্যাকান্ডের ঘটনাটি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারি না। একজন সন্তানকে তিলে তিলে কত কষ্ট করে বাবা-মা বড় করে। আর এ রকম হীরের টুকরার পিছনে সেই বাবা-মায়ের শ্রম, ত্যাগ কতটা হতে পারে তা চিন্তা করা দুঃসাধ্য।

এই পিতা-মাতার পায়ে একটি দেশ বিক্রি করে সব অর্থ প্রদান করলেও তাঁদের কলিজাটার ছিটে ফোঁটার সমমূল্য হবে না। কোটিতে একজন আবরার জন্মায়। বাংলাদেশে এমন কোনো বাবা-মা নেই যে তাঁদের সন্তানকে বুয়েটে পড়াতে চান না! তাঁদের স্বপ্নের জগতে একটিব ারের জন্য হলেও তাঁদের সন্তানদের অবশ্যই বুয়েটে পড়াতে চেয়েছেন।

এবং প্রতিটি মেধাবী শিক্ষার্থীরও কলেজ জীবন শেষে পরবর্তী প্রথম পছন্দ-ই বুয়েট। কিন্তু দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরাও আজ হিংস্র জানোয়ার হয়ে গেছে। গুটি কয়েকজনের জন্যে আজ প্রতিষ্ঠানটিও কলংকিত। তিলে তিলে গড়ে তোলা সন্তানকে এখানে পাঠাতে আজ বাবা-মা দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেন, যা আগে কখনও স্বপ্নেও ভাবা যেতো না!

যাই হোক, রাজনীতির অন্তরালে আবরার হত্যাকান্ডের ঘটনাটি যেন ধামাচাপা না পড়ে। আমরা আবরার হত্যাকান্ডের সঠিক বিচার চাই। অপ্রিয় হলেও সত্য, একজন আবরারকে হারিয়ে আজ আমরা বুয়েটের ভিতরকার আসল চিত্র ও সব বিষয়গুলো জানতে পেরেছি। আশাকরি বুয়েট থেকে এসব নির্মূল হবে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই। আর এসব জঘন্যতা র্নিমূলের জন্য প্রয়োজন ক্ষমতালোভীদের অপসারণ করে প্রকৃত মেধাবী বিবেকবানদের নিয়োগ। আর দুঃখজনক হলেও একথা ও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না আবরারের সাথে সাথে আরও বিশটি মূল্যবান সম্পদকে হারিয়েছে এদেশ! কিন্তু কেন?

এ সম্পদগুলো যখন তাদের বাবা-মা, শিক্ষকদের অধীনে ছিলো তখন তো তাঁরা সোনার টুকরা ছেলে হয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলো কিন্তু বুয়েটে এসে ওরা নষ্ট হয়েছে!!! হত্যাকারী হয়েছে!!! এর দায়ভার কে নিবে??? এই বিশটি সম্পদ তৈরিতে এদেশ, তাদের পিতামাতা, শিক্ষকদের সারা জীবনের শ্রম মাটির সাথে মিশে গেলো! অথচ ওদের হবার কথা ছিলো, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, গবেষক। হায় রে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যেখানে এত বড় সম্মানের চেয়ারের চেয়ে অন্যকোনো পদের আশায় উপাচার্যের চেয়ার নির্ধিদায় ছাড়তে রাজি!

সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এসে সেরকম শিক্ষকদের দেখতে দেখতে তারাও তাদের মেধা কোথায় ব্যবহার করবে তা ভুলে যায়! সত্যিই দুর্ভাগা জাতি আমরা। আমরা নিশ্চয় এরকম দেশ চাইনিঅ দেশের সম্পদগুলো এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! একটি দেশকে ধ্বংসের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাটা নষ্ট করাই যথেষ্ট নয় কি!

আবরার হত্যার ইস্যুর নিচে যেন চাপা পড়ে গেছে দুর্নীতিবাজ ক্যাসিনো সম্রাটদের কা-কীর্তি ও দুর্নীতির বিরোধী সাড়াশি অভিযান!

প্রতিদিনই নিত্যনতুন চমকপ্রদ নিউজ আমরা পড়ছি। ৮-১০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে কেউ যখন চাকরি পায় তখন ওদের মন মানসিকতাই ওরকম হয়। আগে যে টাকা ইনভেস্ট করেছি তা উদ্ধারের চেষ্টা। আর ততদিনে সে চাকুরিজীবী ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, বিবেকহীন কীটে পরিণত হয়। আর এভাবেই সমাজটা রসাতলে চলে যাচ্ছে। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরীব আরো গরীব হচ্ছে। অথচ এদেশে যে সকল ধনকূবেরা আছে তারা একেকজন একেকটা বাংলাদেশ কিনতে পারবে।

হায়রে এদেশে এখনও নাকি রাস্তায় রাস্তায় মানুষ ঘুমায়। খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থানের অভাবে এখনও মানুষ মরছে। আজকাল পত্রিকা পড়তে ভয় পাই। কি না কী ভয়ংকর নিউজ আসে! অবশ্য তার আগেই ফেইসবুকেই সব পড়া হয়ে যায়। আজকালকার তরতাজা নিউজগুলো হলো, বাবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নির্মমভাবে বর্বরতার সর্বোচ্চ প্রয়োগপদ্ধতি ব্যবহার করে সন্তানকে খুন করে।

মা পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে শিশুকন্যা ও স্বামীকে জবাই করে। পিতা নিজ কন্যাকে ধর্ষণ করে। শিক্ষক ছাত্রাবাসের ছাত্রকে বলাৎকার করে। নিরপরাধ কোন কিশোরীকে বাসায় একা পেয়ে ধর্ষণ করে। হত্যা করে আবার আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়! গ্রামেগঞ্জেও শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ না পাওয়ায় হত্যা!!
অফ্ খুন, ধর্ষণ,

------খুন, ধর্ষণ,
------খুন, ধর্ষণ,
আর কত?????

আবারো ফেসইবুকে লেখা নিয়ে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান। অসাম্প্রদায়িক এই দেশে আবারও কি জানি কি হচ্ছে! বেশি কিছু লিখতে চাইনা। এ সবকিছু দেখতে দেখতে স্বতঃস্ফূর্ত এই আমিও যেন দিন দিন অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছি। মূল্যবান একটা কথা বলে ইতি টানতে চাই। সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। এ বাড়াবাড়ির করার ফলে তোমাদের পূর্বে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবী (সাঃ) এর বাণী এটি। মহান আল্লাহ্ সবাইকে ভাল রাখুক, সুস্থ্য বোধশক্তি দিক।

লেখক: সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ,কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

ই-মেইল : [email protected]