রহিম আব্দুর রহিম


হিন্দু, মুসলিম, ওরাঁও, সাওতাল, পলিয়া, কোচ ও রাজবংশীয় ধর্ম বর্ণের জনবসতির পঞ্চগড়। ১৩১৮ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত পঞ্চড়ের মোট আয়তন ১৪৯৫.৬৯৭ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী জেলার মোট জনসংখ্যা ১০৫০০১৪ জন। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী যার সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। পঞ্চগড়ের প্রশাসনিক দপ্তর পাঁচটি। এর মধ্যে পঞ্চগড় সদর, বোদা, তেঁতুলিয়া, আটোয়ারী এবং দেবীগঞ্জ। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত পঞ্চগড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রকৃতি প্রেমিদের আকৃষ্ট করবেই।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের ৩০১টি (প্রায় বিলুপ্ত) নদীর মধ্যে ৩৩টি নদীই পঞ্চগড়ের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। সবুজ শ্যামলে ঘেরা পঞ্চগড়ের তিন দিকেই ভারতের সীমানা। দক্ষিণ দিকে অবারিত বাংলার বিশাল রাজ্য। ‘চোঙ্গা’ আকৃতি, নদ-নদীর সমাহার, সবুজ শ্যামল ঘেরা পঞ্চগড় যে, বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ অতিথিশালা এতে কোন সন্দেহ নেই। এই ভূ-খন্ডের জন-মানুষরা শান্ত-নিরীহ এবং মার্জিত স্বভাবের। এখানকার কৃষ্টি কালচার দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন।

আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে অঞ্চলটি বেলুয়াভূমি নামে পরিচিত ছিল। কালের আবতের্, সময়ের ব্যবধানে এই জনপদ ‘পঁচাগড়’ থেকে পঞ্চগড়ে রূপ নেয়। কাশ্মীর যেমন পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ তেমনি পঞ্চগড় বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ। এই স্বর্গে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী যার সংখ্যা ৬৯৪০ জন। প্রায় ১৪ লাখ জন আবাসনের বাসস্থানের কৃষ্টি-কালচারেও রয়েছে অফুরন্ত ব্যাঞ্জনা। কারণ, আজ থেকে ১৫শ বছর আগে অঞ্চলটি শাসন করতো মহারাজ বংশীয় শাসকরা।

পরবর্তীতে এই জনপদে সম্ভবত: কোন এক সময় ভূমিকম্পন ঘটায় প্রকৃতির আদল, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-চালচার, নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কয়েকধাপ পরিবর্তন ঘটেছে। সময়ের ঘূর্ণায়নে এই অঞ্চলে তৎকালীন উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকার মানব সম্পদ আপদে-বিপদে জীবন জীবিকা রক্ষায় পঞ্চগড়ের শান্ত প্রকৃতিতে আবাসন গড়ায় আস্তে আস্তে মিশ্র সংস্কৃতির অপূর্ব পঞ্চড়ের বির্নিমাণ ঘটে। যে কারণে হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়ের সংস্কৃতি অন্য দশটি অঞ্চলের চেয়ে ব্যাতিক্রম ও সমৃদ্ধ।

হিন্দু -মুসলিমসহ ৭টি ধর্মের মানব সভ্যতায় সৃষ্ট সংস্কৃতির মধ্যে মাছ ধরা, জার বুনন, মাটির হাড়িপাতিল তৈরী, হাঁস মূরগী পালন, বাঁশ-বেতের কাজই ছিল এ অঞ্চলের জীবন জীবিকা অর্জনের অন্যতম সংস্কৃতি। পরবর্তীতে কৃষি সংস্কৃতি শুরু হয়, চীনা কাউন, ভূট্টা এবং পয়রা চাষের মধ্য দিয়ে। কৃষি সংস্কৃতি কয়েকধাপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে হচ্ছে ধান, গম, আখ, ভুট্টা, ডাল, চিনাবাদাম, তরমুজ, কমলালেবু, স্ট্রবেরিসহ উন্নত ফল ও ফসল। কর্মে যুক্ত হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ, পাথর-বালি আহরণ।

গড়ে ওঠেছে মিল ও ফ্যাক্টরী। সবুজ ঘেরা সমতল পঞ্চগড়ের উর্বর মাটিতে চা-চাষের মহোৎসব এখানকার মানুষের কৃষি কালচারে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। পঞ্চগড়ের চিনিকল, জুটমিল, ডিস্ট্রিলারিজ, খাম্বা, জেমকন ফ্যাক্টরীতে উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও শিল্প কালচারে এ অঞ্চলের জনমানুষের মাঝে তা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। এখানকার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ধর্মের জনমানুষরা আলাদা আলাদা সার্বজনীন অনুষ্ঠানাদি পালন করায় সম্প্রীতির স্বাক্ষর বহন করছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আধুনিক যুগের নিরানন্দ, বিউটি পার্লার নির্ভর পারিবারিক বিয়ে বাড়ির সংস্কৃতি যখন অন্ধকারে ওই সময় পঞ্চগড়ের হিন্দু সমাজের সাতপাকের বিয়েবাড়িতে এখনও ঢাক-ঢোলে উত্তাল হয়ে ওঠে।

মুসলিমদের বিয়ে, অন্ষ্ঠুানে এখনো গ্রামের সাধারণ খেঁটে খাওয়া মানুষরা দাদা-দাদী, নানা-নানী চাচা-চাচীদের সমন্বয়ে বর-কনের গায়ে হলুদের সংস্কৃতি টিকে রয়েছে। বিয়ে বাড়িতে প্রতিবেশী মহিলাদের গলায় হাত রেখে দল বেঁধে বরের আগমণে হেরুয়ার সুরে কনের বাড়িতে ‘বর ধোলাই’, একইভাবে বরের বাড়ি কনের আগমনে প্রতিপক্ষ প্রতিবেশীদের কনের ‘জাত ধোয়া’ হেরুয়ার সুর সত্যিই এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে। ফলে বিয়ে বাড়িতে দাওয়াতি-বিনাদাওয়াতি উৎসুক জনতার ভীড় পঞ্চগড়ের মান সভ্যতায় ইতিহাস পরিমার্জন করে চলছে। কন্যা কূলে বদ্ধ ধারণা, নতুন বিবাহিত কনে ভাদ্র মাসের প্রথম তিন দিন মেয়ে বাপের বাড়িতেই থাকতে হবে।

কারণ স্বামীর দেখা মিললে কনে অন্ধ হয়ে যাবে। নতুন বিবাহিত এই তিন দিন কনের বাপের বাড়ি থাকাকে পঞ্চগড়ে ‘ভাদর-কাটানি’ উৎসব হিসেবে উৎযাপিত হয়। এই উৎসব ঘিরে নতুন বিবাহিত মেয়ের বাপের বাড়ি তিনদিনের উৎসবের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এরপরও এলাকার জনমানুষরা এই উৎসবকে আদি সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। সবচেয়ে বড় সম্প্রীতির মহোৎসব শুরু হয়, প্রতিবছর দুর্গাপূজা ঘিরে।

জেলার বিভিন্ন এলাকার মন্দিরে মন্দিরে ঢাক-ঢোলের তালে আরতি নৃত্যানুষ্ঠানে মানুষের বাঁধভাঙ্গা ঢল নামে। লক্ষীপুজা উপলক্ষে গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় মন্দিরের আঙ্গিনায় ‘ধামেরগান’ নামক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় অত্রাঞ্চলের লোকজপালা। আঞ্চলিক ভাষায়, পরিবেশিত মানপাঁচালি, রংপাঁচালির কাহিনী নির্ভর আসরে হাজারও নারী-পুরুষ, বয়:বৃৃদ্ধ ,কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুনীদের ভীড় লক্ষণীয়।

ছেলেরা, মেয়ে সেজে এই পালাগানে অভিনয় করে। সমাজের খেঁটে খাওয়া জনমানুষদের দু:খ, কষ্ট, হাসি-কান্না নিয়ে নির্মিত পালাগানেই এই অঞ্চলের সম্প্রীতি আত্মপরিচয় উঠে আসছে অনাদিকাল থেকে। খেলা-মেলার পঞ্চগড়ের অন্যতম সংস্কৃতি বিভিন্ন মেলা-পার্বন।

এর মধ্যে জেলার আটোয়ারী উপজেলার নাগর নদী ঘেঁষে ৪০দিন ব্যাপী আলোয়াখোয়া রাশমেলা, বোদা উপজেলার কাজলদিঘী কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের ঘাগড়া আরাজি গ্রামে বুক চিরে প্রবাহিত করতোয়া পাড়ের ৩দিন ব্যাপী বারুনি “বান্নী” মেলা, তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের ভদ্রেশ্বর গ্রামে দক্ষিণ করতোয়া ও সাও নদীর মিলন স্থলের শিবমন্দির ঘিরে অনুষ্ঠিত ৩ দিন ব্যাপী ভদ্রেশ্বর শিবযাত্রা মেলা, আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বার আউলিয়ার মেলা, বলরামপুর ইউনিয়নে লীলার মেলা, দেবীগঞ্জের শিব চতুর্দশী স্নান মেলা, শুধু এই অঞ্চলের নয়, সারা বাংলার মানব মনের নিত্যদিনের দু:খগাঁথা, কর্মশৈলী, জীবনালেখ্য, ধর্মীয় আচার-আচরণ প্রকাশ হয়ে আসছেন।

বাঙালির মানব মনের এই সংস্কৃতির শুধু উত্তরাঞ্চল নয় সারা দেশের জনমানুষের অনাদিকালের বন্ধন হয়ে টিকে আছে। মেলা উপলক্ষে অত্রাঞ্চলের কৃষি, শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটছে। বিশ্ব সভ্যতায় আধুনিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পা রাখায়, জাতির বৃহৎ অংশ যান্ত্রিক যুগের যন্ত্রনায় ভূগছে; তখন পঞ্চগড়ের জনমানুষের আদি সংস্কৃতি পালাগান, যাত্রাপালা জীবন্ত হয়ে আর্বিভূত হচ্ছে। এছাড়াও আধুনিক যুগের সাথে শুধু তাল মিলাতে নয়, বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পেরেছে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। পঞ্চগড় বিদ্রোহী শিশু-কিশোর থিয়েটার এ যাবৎ পঞ্চগড়ের শিশুদের নিয়ে ৮টি আন্তর্জাতিক উৎসবে এবং ১২টি জাতীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে।

ফলে পঞ্চগড়ের সংস্কৃতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসার দাবীদার। এছাড়াও এক্ষেত্রে পঞ্চগড় বিদ্রোহী যুব উন্নয়ন থিয়েটার, ভূমিজ, কারিগর, উদীচি শিল্পীগোষ্ঠী, পঞ্চগড় শিল্পকলা একাডেমীর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ ও সংশ্লিষ্ট শিল্পী, অভিনেতারা অঞ্চলের ক্রীড়া কালচার নিয়মিত লালন করে যাচ্ছেন। পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক গান চির অমর, ‘আইসা মাসের বাইসা তারিখ, ঠিক হইছে মোর বিয়ার তারিখ....’। এখনও সর্বজেলার স্রোতাদের বিমুগ্ধ করে। সমাজ ও রাস্ট্রের একটি বৃহৎ অংশ যখন অর্থের মোহে অন্ধ, ওই সময় পঞ্চগড়ের ক্রীড়া সংস্কৃতি অত্যন্ত প্রবল এবং প্রখর স্রোতে চলমান।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পঞ্চগড়ের মেয়েরা ফুটবল, হ্যান্ডবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন এক্রোবেটিতে সাফল্যের অধিকারী। মজার ব্যাপার, এখানকার যুবক-যুবতী, কিশোর- কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা মৌসুমী বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্কৃতির চর্চা নিজ উদ্যোগে গ্রামে, পাড়ায়, মহলায় নিয়মিত করে আসায়, বলতে দ্বিধা নেই পঞ্চগড় অঞ্চলটি ক্রীড়া, সংস্কৃতির আঁতুরঘর। আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্কৃতির মধ্যে জনপ্রিয় পাখি খেলা, বৈশাখী উৎসবে ঘোড়দৌড়, লাঠি খেলা এখনও পঞ্চগড়ে জমজমাট হয়ে দেখা দেয়।

পঞ্চগড়ের সবচেয়ে উন্নত এবং মধুর সংস্কৃতির মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্যতম। এখানে দলমত নির্বিশেষে একই টেবিলে একই স্টলে সময়-অসময়ে প্রীতির বন্ধনে একত্রিত হওয়ায়, এখানে কোন রাজনৈতিক সংঘাত নেই। এক কথায় পঞ্চগড়ের সম্প্রীতি সংস্কৃতি পর্যটন শিল্পের জন্য যেমন মহা সম্পদ তেমনি এখানকার মানবের মিলন প্রহর সম্প্রীতির চিরস্বাক্ষর।

পঞ্চদেশের প্রবেশপথ পঞ্চগড়ের পর্যটন শিল্পের জন্য সর্বপ্রথম এখানকার কৃষ্টি কালচারের মৌসুমী চর্চা যেমন জরুরী, তেমনি সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অব্যাহত কর্মপরিধি গতিশীল করাও অনিবার্য। একই সাথে রাষ্ট্রের পর্যটন উন্নয়নের স্থানীয় পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন সময়ের দাবী।

লেখক : সাংবাদিক, কলামনিস্ট, শিশু সংগঠক ও নাট্যকার।