মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যা তালিকায়  চা একটি জনপ্রিয় পানীয় দ্রব্য। বর্তমান সময়ে চা পান করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ গরম চা না হলে অনেকেরে কাছে পুরো দিনটাই এলোমেলো। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে ছেলে-বুড়ো সকলেই চায়ের ভক্ত। এর কোন বয়স সীমা নেই। 

চায়ের নানা ধরণ যেমন আছে সেই সাথে স্বাদের ভিন্নতা, আছে গন্ধের ভিন্নতাও । এক কথায় চা এখন জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আমাদের সমাজ জীবনে।

তবে সব কিছুকে ছাঁপিয়ে চায়ের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চায়ের গুণগত মান নির্ণয়ে রয়েছে অনেক গুলো ধাপ। এই অনেক গুলো ধাপ শেষেই তেরী হয় মান সম্পন্ন চা।

প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার লড়াইয়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের গুণগত মান নির্ণয়ে সবগুলো চা বাগানই তাদের কারখানায় উৎপাদিত চায়ের মান নিয়ন্ত্রনে নানা পন্থা অবলম্বন করলেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সিটি গ্রুপের মালিকানাধিন প্রতিষ্ঠান নাহার চাবাগান কর্তৃপক্ষ। তাদের বাগানে উৎপাদিত চায়ের গুণগত মান নিয়ন্ত্রনের লক্ষে ইতি মধ্যেই বিভিন্ন ধাপ পেড়িয়ে প্রথমবারের মত চালু করেছে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি বা বৃষ্টির পানি দিয়ে চায়ের মান নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্রতিদিনই কারখানায় চা উৎপাদন শেষে ফেক্টরিতেই চায়ের মান নির্ণয় করা হয়।

জানা যায়, ১৯৬৪ সালে স্থাপিত নাহার চা বাগানটির অবস্থান শ্রীমঙ্গলের দুর্গম পাহাড়ী সীমান্ত এলাকায় হওয়ায় এখানে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চা উৎপাদনের জন্য কোন কারখানা ছিলনা। অন্য বাগানে ভাড়ায় নাহার চা বাগানের সংগ্রহকৃত চাপাতা ট্রাকটর বোঝাই করে নিয়ে চা ভাঙ্গানো হত। ২০০৮ সালে সিটি গ্রুপ বাগানটি ক্রয় করে নেয়ার পর থেকে বাগানের বর্তমান ব্যবস্থাপক পীযুষ কান্তি ভট্রাচার্যের প্রচেষ্টায় একের পর এক পরিবর্তন আসতে থাকে। নানা উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নাহার চাবাগান কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালে নিজস্ব কারখানায় চা উৎপাদনের লক্ষে স্থাপন করা হয় অত্যাধুনীক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ কারখানা। ২০১৫ সালে উৎপাদনে আসার পর থেকে কোন পদ্ধতি ছাড়াই মানসম্পন্ন চা উৎপাদন করে আসছে নাহার কর্তৃপক্ষ।

তবে এবছর ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি চালু হওয়া নিশ্চিত হয় চায়ের গুণগত মান। বেসরকারী এনজিও ওয়াটার এইড ও সিটি গ্রুপের যৌথ তত্বাবধানে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুরো বছরের জন্য প্রায় তিনলক্ষ লিটার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তৈরী করা হয়েছে একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প। মূলত এই প্রক্রিয়াজাতকৃত পানি থেকেই রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতিতে চায়ের মান নির্ণয় করা হয়।

সাধারণত পুকুর কিংবা টিবওয়েল এর পানিতে আয়রণ থাকার কারনে চায়ের রঙ কালো রঙ ধারন করে , সেক্ষেত্রে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতিতে চায়ের রঙ ও মান সঠিক থাকে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি হলো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে বিশেষ প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে বৃষ্টির পানিকে পুরোপুরি আয়রণ মুক্ত করে চায়ের জন্য ফুটন্ত পানিতে কয়েক মিনিট পরিমানমত চা রেখে তার পর চায়ের পাত্রে ঢেলে চায়ের সঠিক রঙ এবং মান নির্ণয় করা হয়। এটাকেই বলে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি।

নাহার চা বাগানের ব্যবস্থাপক পীযুষ কান্তি ভট্রাচার্য্য বলেন,এই পদ্ধতি মূলত আমাদের নিজস্ব পদ্ধতি। আমরা চায়ের গুণগত মান নিয়ন্ত্রনে নানা পন্থা অবলম্বনের পাশাপাশি এখন যুক্ত করেছি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি। আমারা প্রতিদিনই প্রতিটা গ্রেড কারখানায় পরীক্ষা করা করে থাকি।

তিনি বলেন, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেমের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের কোম্পানীর নিজস্ব অর্থায়নে নাহার চাবাগানের কারখানায় রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম প্রকল্প তৈরী করেছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম এর পানি ব্যবহার করে উন্নত ও মানসম্পন্ন চা তৈরী করা সম্ভব।

পীযুষ কান্তি ভট্রাচার্য্য বলেন, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং এর মাধ্যমে সংরক্ষণকৃত পানি শতভাগ নিশ্চিত নিরাপদ, বর্তমানে এর পানি শুধু মাত্র চায়ের গুণগত মান নির্ণয় করা হয় তা নয়, এই নিরাপদ পানি এখন বাগানে কর্মরত চা শ্রমিকরা নিয়মিত ব্যবহার করেও আসছেন।

বাংলাদেশ চা গবেষনা ইন্সটিটিউট (বিটিআরআই) পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী বলেন, চায়ের গুণগত মান নির্ণয়ের অকেগুলো ধাপ রয়েছে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি অনেক ভাল । এটি একটি ন্যাচারাল পদ্ধতি। তিনি বলেন চায়ের গুণগত মান নির্ণয়ে এটিই কোন চুরান্ত পদ্ধতি নয়,এর সাথে আরো অনেক পদ্ধতি রয়েছে।

এ বিষয়ে ইস্পাহানী কোম্পানীর জেরিন চা বাগানের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ সেলিম রেজা বলেন, চায়ের গুনগত মান নির্ণয়ে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি আমার দৃষ্টিতে ভাল পদ্ধতি, এটি আমার কাছে প্রথম মনে হয়েছে। তিনি বলেন মূলত একেক বাগানে একেকরকম মান নির্ণয়ের পদ্ধতি চালু থাকলেও বর্তমানে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি সবচেয়ে আপডেট।

উল্লেখ্য, গত ২৯ সেপ্টেম্বর শ্রীমঙ্গলের গহীণ অরণ্যঘেরা দুর্গম সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত নাহার চা বাগানে দেশের চা শিল্পে প্রথমবারের মত চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে তাদের সুপেয় ও নিরাপদ পানি সর্বরাহ ও উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতায় স্থাপিত রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম প্রকল্পের উদ্বোধন করা । বেসরকারি এনজিও আইডিয়ার সার্বিক সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।

(একে/এসপি/নভেম্বর ০৪, ২০১৯)