চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযান ও শুদ্ধি অভিযান চলছেই। গ্রেফতার হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। ধীরে ধীরে সারাদেশে জোরদার হচ্ছে প্রশাসনের এ অভিযান। 

শোনা যাচ্ছে অভিযান তৎপরতায় বাদ যাবে না চট্টগ্রাম জেলা তথা কর্ণফুলী উপজেলাও। যে কোন সময় অপকর্মে জড়িত অনেক দুর্নীতিবাজেরা ফেঁসে যেতে পারেন। এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

একটি নির্ভযোগ্য সুত্র নিশ্চিত করেছে, এবার গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর দক্ষিণ জেলাসহ শহরের পার্শ্ববর্তী উপজেলা সমূহ। বেশ কিছু বির্তকিত ব্যক্তিদের বিষয়ে গোপনে অনেকের আমলনামার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

শুধু ক্যাসিনো কেলেংকারি নয়, এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িত। অনেকে দলবদল করে অনুপ্রবেশ করেছেন। আবার অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের পদ পদবির নাম ভাঙিয়ে পৌছে গেছেন কোটিপতির ক্লাবে।

গড়েছেন অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণে সহায় সম্পদ। সরকারি-বেসরকারি কাজে টেন্ডারবাজি, সাগরে চোরাচালান, জাহাজ থেকে তেল চুরি, ভূমিদস্যুতা, জুয়া, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও মাদক সংশ্লিষ্টতায় অনেকেই অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এদের মধ্যে রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সরকারি চাকুরিজীবী, মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকাবারী ও সিন্ডিকেট গ্যাং লিডারসহ নানা পেশার ব্যক্তিরা রয়েছেন।

তবে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্পষ্ট না করলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি বিশেষ বাহিনীর এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনেকের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তারা অল্প সময়ে কিভাবে এত কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জন গড়েছেন। এমনকি যে কোন সময় তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’

সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় প্রশাসন ইতোমধ্যে তাদের ব্যাপারে মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় অনেকের নাম উঠে এসেছে। যারা জিরো হতে হিরো হয়েছেন বিগত ১০ বছরে। তাদের অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব করা হতে পারে। এক্ষেত্রে বাড়তি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা তথা কর্ণফুলীর অনেকেই বিগত সময়ে খুব অভাবে থাকলেও চাল চলনে তাদের বিলাসি ভাব দেখা যাচ্ছে। অল্প দিনে বাড়ি, গাড়ি আর বহু জমি-জামাসহ শহরে ফ্ল্যাটের মালিক বনে গেছেন। অথচ অতীতে তাদের কোন দৃশ্যমান ব্যবসা ছিল না।

শোনা যায়, গোয়েন্দা সংস্থার নজরধারীতে যারা রয়েছে। এদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নানা উপায়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। কেউবা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি কাজে টেন্ডারবাজি ও ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে গত কয়েক বছরেই শত কোটি টাকা মালিক হয়েছেন। নিরীহ মানুষের জমি-জামা দখল ও মদ জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণসহ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের লালন পালনের অভিযোগও রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। অনেকেই আবার মাদক কারবারীর টাকায় নিজের ভাগ্য বদলিয়েছেন। সর্বোপরি নদীতে মাদক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ততা ও চোরাকারবারে শেল্টারদাতা হিসেবেও অনেকের নাম রয়েছে। যা প্রশাসন যাচাই বাচাই করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু ব্যক্তির নামে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন, ভূমিদস্যুতা, ও মাদকের ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ব্যক্তিই রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত। অনেকে গত কয়েক বছরে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে ব্যাংক একাউন্টসহ নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে অবৈধ টাকার পাহাড়সহ বিঘা বিঘা জমির মালিক হয়েছেন। জমি ব্যবসার নামে বায়না তৈরি করে অনেকে দুর্বল অসহায় মানুষের জমি কেড়ে নিয়েছেন বলেও সংবাদপত্রে আসছে। আবার কেউ কেউ শহরেই বসবাস করেন। তবে উপজেলায় তাদের প্রভাব পরিচিতি বেশি হওয়ায় তারা সেখানেই গোয়েন্দা তালিকাভুক্ত হয়েছেন।

জানা যায়, কয়েকদিন আগেও সরকারি বিশেষ বাহিনীর কয়েকটি সংস্থার ডাকে সাড়া দিয়েছেন বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক ব্যক্তি। মাঠে অনেকে অপরিচিত লোকজনকে দেখছেন যারা নানা বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন।

নাম প্রকাশ করতে রাজি না হওয়া কর্ণফুলীর উপজেলার এক চেয়ারম্যান জানান, ‘কয়েকদিন আগে গোয়েন্দা সংস্থার লোক পরিচয়ে আমার কাছ থেকেও সুনির্দিষ্ট কিছু লোকজন সর্ম্পকে জানতে চেয়েছে। তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছে বলে মনে হয়েছে। যা সেনসেটিভ বিষয় বলে প্রকাশ করতে বিধি নিষেধ ও করেছেন।’

শিকলবাহা এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া আরেক শিক্ষার্থী মতিউর রহমান (প্রনা) জানান, গত ১০/১২ দিন যাবত বিভিন্ন সংস্থার লোকজন আমাদের এলাকায় ও এসে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত জানতে চেয়েছে।’

সূত্রে আরও জানা গেছে, অনেক আগে থেকেই এ সকল বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহণের কাজ শুরু করছে। তবে সম্প্রতি সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরপরই এ সকল ব্যক্তিদের প্রতি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, চলমান অভিযানে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এ সময় তার নিয়ন্ত্রিত ক্যাসিনো থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক, নগদ টাকা, অস্ত্র জব্দ করা হয়। ২০ সেপ্টেম্বর যুবলীগের অপর নেতা জিকে শামীমকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার অফিস থেকে নগদ ২ কোটি টাকা, পৌনে দুইশ’ কোটি টাকা এফডিআর, আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়। এরপর ঢাকার আরও কয়েকটি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে সরকার দলীয় বেশ কয়েকজন নেতা, বিসিবি’র কর্মকর্তাসহ ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা হয়।

গত ১ অক্টোবর গুলশান অফিস ও বনানীর বাসায় অভিযান চালিয়ে কোটি টাকার বিদেশী মুদ্রা, ২৯ লাখ দেশী টাকা, বিপুল পরিমাণ মদ ও হরিণের চামড়াসহ ব্যবসায়ী সেলিম প্রধান গ্রেফতার হয়। তার বিরুদ্ধে অনলাইন জুয়া পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। সবশেষ ৬ অক্টোবর যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমান আলীকে গ্রেফতার হয়। তাদের কাছ থেকেও অস্ত্র, মাদক ও নগদ অর্থ জব্দ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং, মাদক, বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়েছে।

একাধিক আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, যে অভিযান চলছে, তা রাজনৈতিক বিষয় নয়। সারাদেশে যারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তারা গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন। এ শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকবে। ক্যাসিনো-দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে কোনো শ্রেণী-পেশার মানুষ রেহাই পাবেন না। সে যেই হোক। যারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের প্রত্যেক কে ধরা হবে। এমনকি সাংবাদিকদেরও ছাড় দেওয়া হবে না।

এ প্রসঙ্গে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব-৭ এর এএসপি তারেক আজিজ বলে, ‘চট্টগ্রামে যারা নানান দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কাজের সাথে জড়িত তাদের বিষয়ে নানান তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। অপরাধী যেই হোক না কেনো তাদের বিরুদ্ধে র‌্যাব আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সিএমপি বন্দর বিভাগে কর্মরত উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হামিদুল আলম বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ি, ভূমিদস্যু, জঙ্গীবাদ, চোরাকারবারী, মদ-জুয়া, সন্ত্রাসবাদ নিরসনে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এসব অপরাধের বিরুদ্ধে পুলিশ সামনে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।’

(জেজে/এসপি/নভেম্বর ১৪, ২০১৯)