সজল কুমার সরকার


মানুষ যখন প্রথম পৃথিবীতে আবির্ভূত হয় তখন থেকেই সে ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করে। আর ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ তৃণ ও গাছ- গাছড়ার উপরই নির্ভর করে। পরে মানুষ যখন পাথরে পাথরে ঘর্ষণ করে আগুন জ্বালাতে সক্ষম হয়েছে তখন থেকে তাপে সিদ্ধ করে খাদ্য গ্রহণ শুরু করে। এভাবে ক্রমান্বয়ে ক্ষুধা নিবারণের জন্য যে সকল খাদ্যশস্য বা প্রাণীজ অংশ মানুষ তার জন্য অতি উপযোগী বলে মনে করেছে তাই প্রধান খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত ও সমাদৃত হয়েছে।

বিভিন্ন গ্রন্থে বা কিতাবেও খাবারের প্রকারভেদ ও আহার গ্রহণের উপর সাবধানতা অবলম্বনের জন্য আমাদেরকে বহু উপদেশসহ সর্তক সংকেত দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে রিযিকের ফয়সালা যেমন আছে তেমনি রিযিকের পবিত্রতা (হারাম হালাল) রক্ষার জন্যও যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সনাতন ধর্মে খাবারকে তো পবিত্রতার প্রতীক স্বরূপ প্রসাদ বলা হয়েছে।

বনবাসী থেকে নগরবাসী মানুষের সমাজ আর সভ্যতার ক্রমবিকাশ বিশ্লেষণেও দেখা যায় মৌলিক চাহিদায় অন্নকেই শীর্ষ স্থানটি দেয়া হয়েছে। আয়ু, বল, তেজ, সুখ ও স্বাস্থ্যবৃদ্ধির জন্য মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে। সেই সঙ্গে আমরা সবাই জানি, যে যেমন খাদ্য গ্রহণ করে তার চিন্তা ও মনোবৃত্তিগুলো সেভাবেই গড়ে উঠে। ৫ম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের Food pyramid গল্পেও এই কথাই বলা হয়েছে যে "As you eat so you fit" আসলে শরীরের স্নিগ্ধভাব, মাথা ও মন ঠান্ডা রাখা, কর্মে স্পৃহা জাগাতে খাদ্যের ভুমিকা অনস্বীকার্য। তাইতো দেখা যায় বিদ্বান ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাদের চিন্তা ও মেজাজ ঊর্ধ্বমুখী রাখার জন্য বাছ বিচার করেই খাদ্য গ্রহণ করতেন।

এখন আমারা যা খাচ্ছি সেই খাদ্যের বিশুদ্ধতা বা গুনগত মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। খাদ্য উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ থেকে শুরু করে তার বিপনন বা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়ার এই লম্বা প্রক্রিয়ায় কোন খাদ্যই আর তার জন্মগত বা প্রকৃতিগত বিশুদ্ধতা নিয়ে পৌঁছাতে পারছেনা।

মূল থেকে ফুল, জল থেকে ফল সবকিছুতেই বিষক্রিয়ার এক বিষাদময় উপস্থিতি। পন্ডিতজন আর পুষ্টিবিজ্ঞান আমাদের এই জ্ঞান দান করে যে, খাদ্য গ্রহণের উপর একজন মানুষের মেজাজ, মর্জি, আচরণ, হিংস্রতা, নম্রতা, ভদ্রতা, সুস্থতা নির্ভরশীল।

তাহলে, আজকের দিনে এই যে এতো অনিয়ম, অনাচার, আত্মম্ভরিতা, অসহিষ্ণুতা এসব ই কি এই বিষক্রিয়ার ফল? একটা বীরের জাতি কি তাহলে ধীরে ধীরে বিষবৃক্ষে পরিণত হবে? তাহলে শুধু শিক্ষক বা শিক্ষার্থী নয় পুরো দেশবাসী যে মানের খাদ্য ভোজন ও হজম করে দিনাতিপাত করছে তাতে কি ভেজালের বেড়াজাল হতে মুক্ত হয়ে গুণী, জ্ঞানী আর পরিশ্রমী জাতি গঠন সম্ভব?

আমার এসব বিষয়ে বলার বা লেখার তেমন কোন জ্ঞান নেই। তাই এতোগুলো প্রশ্ন বা গুনবিচারের কথা আমার মুখে হয়তো মানায় না। তবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা বা চিকিৎসার মতো সকল মৌলিক প্রয়োজনগুলোর মান বা শুদ্ধতা রক্ষা করা দরকার। আর তার দায়িত্বও আমার আপনার সবার।

মূলত সরকারের বালাই দমন কর্মসূচি যত সমন্বিত হবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ততই হবে তরান্বিত। শিক্ষাকে মানসম্মত করতে হলে শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় সহ সকল গুরু আলয়কেই তো মানরক্ষার কাজটি করতে হবে। কেননা বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় প্রাথমিকে যথেষ্ট মান অর্জন করা শিশুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে গিয়েই জাত বিসর্জনের কর্মটি সম্পন্ন করে।

তাই দেশকে ভালোবাসতে হলে কিংবা দেশমাতৃকাকে ভালো রাখতে চাইলে সমাজের সকলকেই বালাই মূক্ত থাকতে হবে। নইলে মান গেল, মান গেল বলে মাড়ি বের করে যে মাতামাতি করি তাতে শুধু ফোকলা মাড়িটিই দেখা যাবে। হাসিতে আর মুক্তা ঝরবেনা।

মানসম্মত সুস্থ জাতি গঠন তখনই সম্ভব যদি আমরা সবাই Robert Frost এর সেই বিখ্যাত কবিতার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে প্রত্যয় ব্যক্ত করি.......

"I have promises to keep

And miles to go before I sleep

And miles to go before I sleep "

লেখক : প্রধান শিক্ষক, দুল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেন্দুয়া, নেত্রকোণা।