বিশ্বজিৎ বসু


সদ্য গ্রাম থেকে শহরে এসেছি। দুই বছর পর এস এস সি পরীক্ষা। সুতরাং কে এস এস সি পরীক্ষা দিচ্ছে, কার রেজাল্ট কিরকম। এগুলো খোঁজ রাখার আগ্রহ তখন প্রবল। রথখোলার মানস মুখার্জী এসএসসিতে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে রাজেন্দ্র  কলেজে ভর্তি  হয়েছে। সে তখন আমাদের  কাছে আলোক বর্তিকা। তার আরেকটা গুণ তার এস এস সির ফলাফলকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। সে তবলা বাদক এবং করুণা স্যারের ছাত্র। মানস মুখার্জীকে নিয়ে কোন আলোচনায় প্রথম করুণা স্যারের  নাম শুনি। 

গ্রামে আমাদের পাশের বাড়ী লতিফ ভাইয়ের বড় মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে মাইক এনেছিল। কয়েকদিন সে মাইক বেজেছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে বসে বসে মাইক বাজানো দেখতাম। সেখান থেকে শুনে শুনে কয়েকটি গানের প্রথম কলিগুলো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। গোধূলি বেলায় কৃষ্ণনগর স্কুল মাঠ থেকে ফুটবল খেলে বাড়ী ফেরার সময় ফাঁকা মাঠের মধ্যে এলে ভয়ে যখন বুক দুরু দুরু করতো তখন উচ্চ স্বরে হেরে গলায় গানের প্রথম লাইনগুলো গাইতাম। সেই গানগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল "আমার সোনার ময়না পাখি। এছাড়া "আল্লাহ আল্লাহু, তুমি জানলে জালালু", "খাঁচার ভীতর অচীন পাখি কেমনে আসে যায়", " মাঝি বাইয়া যাওরে "," ওকি গাড়িয়াল ভাই" গানের প্রথম কয়েকটি লাইন গলা ছেড়ে গাইতে গাইতে মাঠে পাড়ি দিতাম।

শহরে পড়তে এসে হেরে গলায় সেই গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পাশে বাসায় ছিল রাম কাকা। সংগীত পাগল লোক। রাম কাকার বাবা ফরিদপু্রের স্বনামধন্য ডা: রাখাল চন্দ্র দাস। কোলকাতা বেতারের গানের অনুষ্ঠানগুলো ছিল রাম কাকার নখদর্পনে। বিশেষ করে রাত সাড়ে দশটার দিকে সংগীতানুষ্ঠান, আকাশ বানীর সংবাদ পরিক্রমার পর শুরু হতো সে গানের অনুষ্ঠান। গান শোনার জন্য পাড়ার কয়েকজন জড়ো হয়ে যেত নাগ বাড়ির উঠোনে। প্রথম গানটার পর রাম কাকা হয়ে যেত ঘোষক। প্রথম গানটা শেষ হবার পর রাম কাকা বলে দিত, পরের শিল্পী কে এবং কোন গানটি গাইবে এবং হুবহু মিলে যেত। রাম কাকার সেই ক্ষমতা দেখে পড়া বাদ দিয়ে সেখানে যেতাম গান শুনতে।
এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নাম শুনি কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপ্যাধ্যায়, মান্না দে, ভুপেন হাজারিকা ,আশা ভোসলে, লতা মুঙ্গেস্কর, সন্ধ্যা মুখোপ্যাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীদের। রাম কাকার কন্ঠে "কারো কেউ নইকো আমি, কেউ আমার নয়। কোন নাম নেইকো আমার শুন মহাশয় " কিশোর কুমারের গাওয়া এই গানটি শুনতে শুনতে আমারও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।

ফরিদপুরে আমার স্কুলে যাবার সাথী পাশের বাসার নেপাল আর সুবল। আস্তে আস্তে সেই যাতায়াতের সাথী বাড়তে থাকে। স্কুলে যাবার সময় পুরাতন আলিমুজ্জামান ব্রিজ পার হয়ে রিকশায় উঠতাম। শেয়ারে স্কুল পর্যন্ত ভাড়া পঞ্চাশ পয়সা। যাতায়াতের পথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল একটি ছেলের সাথে, সেও ফরিদপুর হাই স্কুলের ছাত্র। একই ক্লাসে অন্য সেকশনে পরে। নাম লাভলু। কিছুদিন পর জানতে পারি সে করুণা স্যারের ছেলে। এমন একজন গুণী মানুষের সন্তানের দিকে ঝোঁকটা আমার বেড়ে গেল। সেও বিশেষ কারণে আমার দিকে ঝুকে পড়ল। কারণ আমার কাকা অরুণ বসুর সংগে তাদের বিশেষ পারিবারিক সম্পর্ক। উল্লেখ্য যে আমি শহরের স্কুলে এসে ভর্তি হয়েছিলাম কাকাদের অভিভাকত্বে। মা বাবা থাকতো গ্রামের বাড়িতে। লাভলু আগে আমাদের বাসায় চলে আসত। তারপর একসাথে যেতাম স্কুলে।
অধিকারী পরিবারে আমার পরবর্তী পরিচিতজন আভা অধিকারী। তাঁকে ডাকতাম পিসি বলে। আভা পিসি তখন ঈশান বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থার কার্যকরী কমিটির সদস্য। ইতিমধ্যে সংস্থার প্রোগ্রাম গুলোতে যাওয়া শুরু করেছি এবং আভা পিসির স্নেহভুক্ত হয়ে গিয়েছি। তিনি আমাকে ডাক নামে তুই বলে সম্বোধন করতেন। অধিকারী পরিবার তখন আমাদের কাছে আলোক শিখা। করুণা স্যার তখন ফরিদপুরের সংগীত গুরু, আভা পিসি নৃত্য পরিচালক, তার ভাই কীরিটি অধিকারী দেশের স্বনামধন্য তবলা বাদক। করুণা স্যারের রের ছাত্র হিসাবে তখন যারা দ্যুতি ছড়াচ্ছে তাদের কয়েকজনকে চিনতাম। এদের মধ্য মানস মুখার্জী ছাড়াও ছিল অঞ্জনা বিশ্বাস, মিহির গাঙ্গুলী প্রমুখ। এর মধ্যে মিহির গাঙ্গুলীর পরিচয় ছিল করুণা স্যারের পোষ্যপুত্র বলে।

এই সময়কালে আমার মনি কাকা তপন বসু বাসায় একটি ফিলিপস্ এর টু ইন ওয়ান নিয়ে এলো। সেই সাথে কিছু ক্যাসেট। বলা যায় জেনে শুনে এই প্রথম রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুলের গীতি শোনা শুরু এসময়ে থেকেই। এর আগে শুনলেও সেগুলো রবীন্দ্রসংগীত না নজরুল গীতি তা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা ছিল না।

প্রথম প্রথম গানগুলোর প্রতি কোন আকর্ষণ অনুভব করতাম না। কানের কাছে সব সময় বাজত। কখন বুঝতে পারলাম না, দেখি দেবব্রত বন্দ্যোপ্যাধ্যায়ের কন্ঠে" কি গাব আমি কি শুনাব আজি আনন্দধামে" গানটি আমার কন্ঠ গুন গুন করছে। তারপর এক সময়ে বুঝলাম আমি রবীন্দ্রসংগীত মজে গেছি। দেবব্রতের কন্ঠে " তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনা হরিণ চাই", চিন্ময়ের কন্ঠে ”আমি চিনিগো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশীনি", শান্তি দেব ঘোষের কন্ঠ " দুই পাখি, সুচিত্রা সেনের কন্ঠে" কৃষ্ণকলি আমি তাকেই বলি", "যে তোকে পাগল বলে তাকে তুই বলিসনে কিছু" গানগুলো মনে ধরে গেল। এর মধ্যে " যে তোকে পাগল বলে তাকে তুই বলিস নে কিছু " গানটি আমার জন্য আলোক বর্তিকা হিসাবে উঠে আসে। এখনও এই গানটি আমার এগিয়ে যাবার পরে আলো দেখায়। এছাড়া কণিকা বন্দ্যোপ্যাধ্যায়, সাগর সেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কাদেরী কীবরিয়া, তপন মাহমুদ, ফিরোজা বেগম প্রমুখের গাওয়া গান বুদ হয়ে শুনতাম।

গান নিয়ে বাসায় আলোচনাও হতো। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে আলোচনা গুলো শুনতাম। কারা রবীন্দ্রনাথের সুরে গান, কে সুর ভাঙতে চায়। কুসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন দিয়ে যায় গানটি চিন্ময় কিভাবে গেয়েছে, দেবব্রত কিভাবে গেয়েছে। এ নিয়ে দেবব্রতর মত " কসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন তো আলতো ভাবেই দিতে হয়, না হলে যে কুসুম থেতলে যাবে। হেমন্ত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নয়।"আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার কেন যে রবীন্দ্রনাথের সংগীত গায়" এরকম বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মন্তব্য ও আলোচনা।

সেইরকম এক আলোচনা থেকেই একদিন জানতে পারি করুণা স্যার রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করেন না। কারণ সেখানে শিল্পির স্বাধীনতা নেই। নজরুল গীতি তাঁর পছন্দ। কারণ নজরুল গীতিতে শিল্পী যে স্বাধীনতা পায়, নিজের সৃষ্টিশীলতা দেখাতে পারে, রবীন্দ্রসংগীতে সে সুযোগ নেই।

এতদিনে তিনি আমার চোখে ফরিদপুরে সংগীতের প্রধান পুরুষ হিসাবে পরিণত হয়ে গেছেন। কেন তিনি পছন্দ করেন না? মনে মনে প্রশ্ন জাগতো, দেবব্রত বিশ্বাস নাকি রবীন্দ্রনাথের দেয়া সুর ভেঙে গাইতেন। কেন গাইতেন তার উত্তর শুনেছি "দেবব্রত বিশ্বাসের এজমা ছিল, তাই তিনি ভেঙে ভেঙ্গে গাইতেন"।

তখনও করুণা স্যারের সংগে পরিচয় হয়নি। মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখতাম তিনি হেঁটে যাচ্ছেন। সাদা ধূতী, সাদা পাঞ্জাবী, কাঁধে একটি শান্তিনিকেতনী ঝোলা। হাতে ঝুলছে একটি ছাতা। পানের রসে মুখে লাল টুকটুকে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পাশে হাঁটছে তার কোন ছাত্র। বেশীর ভাগ সময়ই দেখতাম মিহির গাঙ্গুলী।

চৈতন্যদেবের পাঁচশততম জন্ম বার্ষিকী এবং মহেন্দ্রজীর শততম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন ফরিদপুর বিশাল উৎসবের আয়োজন করে। সে উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল জগদ্বন্ধু সুন্দরের জীবনী নিয়ে নাটক। নাটকটি দেখতে আঙ্গিনা মাঠে জড়ো হয়েছিল কয়েক হাজার লোক। ফরিদপুর শহরেরর প্রায় সকল নাট্যদলের কর্মীরা সেখানে অভিনয় করেছিল। নাটকটি আমার আজন্ম স্মরণীয়। কারণ এ নাটকে পাহাড়াদারের একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আমার মঞ্চাভিনয় শুরু। নাটকে জগদ্বন্ধু চরিত্রে অভিনয় করেছিল প্রদীপ সিনহা। মহেন্দ্রজি চরিত্রে অভিনয় করেছিল অরুন বসু।

সাতদিন ব্যাপি অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল সংগীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। আর উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেছিলেন করুণাময় স্যার। সেদিনই আমি প্রথম করুণা স্যারের কন্ঠে গান শুনলাম এবং তিনি গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান " কি গাব আমি কি শুনাব আজি আনন্দ ধামে"।

কলেজে ক্লাস করার সুবিধার্থে বাবা আমাকে বাই সাইকেল কিনে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সেই সাইকেল এক্সিডেন্ট করে ঘরে বসা। আমাদের বাসায় তখন কবিতা আবৃত্তির চর্চা হয়। আমি পাশের রুমে বসে বসে শুনি। গ্রামের স্কুলে কবিতা আবৃত্তি করে প্রতিবছর পুরস্কার পেতাম। গত কয়েক বছর সেটা হয় না। আবৃত্তির প্রতি মোহ অনেক। ঢাকায় তখন কন্ঠশীলন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফরিদপুর থেকে ফুল কাকা যান সেখানে মাঝে মাঝে ক্লাস নিতে। চেষ্টা করছেন ফরিদপুরেও সেরকম একটা কিছু গড়ে তুলতে। পাশের ঘর থকে শুনে শুনে নতুন কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি শিখে ফেললাম। তার মধ্যে দুটি কবিতা মনে পরে একটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "প্রশ্ন" আরেকটি "দুঃসময়"।

পায়ের প্লাস্টার খুলে ফেলেছি, কানাইপুরে খেলাঘরের সম্মেলন। শুনলাম খালেদা এদিব চৌধুরী, কবি নির্মলেন্দু গুণ আসছেন। ব্যাথা পায়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে গেলাম কানাইপুর। প্রবীর সিকদার সুজন এ আয়োজনের মধ্যমণি। তিনি কানাইপুর খেলাঘরের সভাপতি। চলে গেলাম ওনাদের বাড়ী। গিয়ে দেখি নির্মলেন্দু গুণ সেখানে। দুপুরের খাবারের পর সুজন কাকাদের বাড়ীর উঠোনে ওনার কাছে অনেক গল্প শুনলাম। বিকালে শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমি কাউকে জানালাম আমি কবিতা আবৃত্তি করতে চাই। আয়োজকরা সানন্দে রাজী হয়ে গেল। আমি আবৃত্তি করলাম লুকিয়ে লুকিয়ে শেখা কবিতা "প্রশ্ন"। সেদিন প্রশংসিত হয়েছিলাম। আর আরেকটা স্বীকৃতি মিলেছিল "যোগ্য কাকার যোগ্য ভাইপো।" আবৃত্তি শেষে আমাকে দায়ীত্ব দেয়া হলে কবি নির্মলেন্দু গুণকে ফরিদপুর এসে ঢাকার বাসে তুলে দেয়া। সেদিন কবি নির্মেলেন্দু গুণের সানিধ্য পেয়ে নিজেকে গর্বিত অনুভব করেছিলাম।

এরপর যুক্ত হয়ে গেলাম কাকার আবৃত্তি শেখার টিমে। আর আমাদের বাসা হতে সেটা স্থানান্তরিত হলো আভা পিসির বাসায়। প্রথমদিন সবার আগে পৌঁছে গেলাম আভা পিসির বাসায়। গরমের কাল সেটা বেশ মনে আছে। দেখি আভা পিসি তাঁর ঘরের ফ্লোর মুছে রেডি করছেন আমাদের বসার যায়গা। ঘরের মেঝো ফ্যানের বাতাসে শুকানোর পর ঢুকলাম ঘরে। তারপর একে একে সবাই এলো। শুরু হলো অধিকারী বাড়ীতে আমাদের কবিতা আবৃত্তি শেখার আসর।
এ আসরে কানাইপুর থেকে আসত জাহাঙ্গীর ভাই, কাশেম ভাই, ব্রাহ্মণকান্দা হতে আসত আনু আপা, পূর্ব খাবাসপুর থেকে আসত বিলু কাকা, সিরাজ কাকা, লিপি এবং রোজি, লক্ষীপুর থেকে আসত মমিন ভাই। থাকত আভা পিসি, ফুলকাকা অরুন বসু আর কাকিমা কবিতা গোস্বামী। ফরিদপুর উপস্থিত থাকলে এখানে আসত বিপ্লব কাকা। মাঝে মাঝে সেখানে অংশগ্রহণ করতো করুণা স্যার আর ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে উপস্থিত হতেন ওয়াহিদুল হক। যোগ দিতেন করুণা স্যারের মা।

একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম, আসরের সবাইকে কাকা বা পিসি বা ভাই বলে সম্বোধন করলেও কিন্তু করুণা স্যারকে ডাকা শুরু করলাম মাস্টার মশাই বলে। আসরের শুরুতে তিনি মজার মজার গল্প শোনাতেন। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে কিভাবে তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হলো, কিভাবে উচ্চাঙ্গ সংগীত মানুষকে আবিষ্ট করে ফেলে। উচ্চাঙ্গ সংগীতের আলোচনায় যাঁদেরকে তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতেন তাঁদের একজন হলেন নৃপেন্দ্র কুমার সিংহ রায়। মাস্টার মশাইয়ের কাছে গল্প শুনে শুনেই উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ তৈরি হয়ে যায়।

আবৃত্তি শেখার এ আসরে শুরুতে আমরা করতাম গলা এবং জিহ্বার ব্যায়াম। তারপর কিছু বাছাই করা কবিতা। এখানে শিখেছিলাম কিছু বাছাই করা লোকজ ছড়া। ছড়াগুলোর একটি হচ্ছে

"দাদা ভাই চাল ভাজা খাই
রয়না মাঠের মুড়ো
হাজার টাকার বউ এনেছ
খ্যাদা নাকের চুড়ো।
খ্যাদা হোক ন্যাদা হোক
তোর তাতে কি?
দাদাভাই সব সইতে পারি
নাকি নাকে নাকে কথা কয়
সে জ্বালাতেই মরি। "
এরকম আরও কয়েকটি লোক ছড়ার কিছু লাইন মনে আছে
"বর দেখে যা বর দেখে যা
রান্না ঘরের ঝুল
কনে দেখে যা কনে দেখে যা
কণকচাঁপা ফুল"

এখান থেকে শেখা আরেকটি ফোক ছড়া রাজেন্দ্র কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় কৌতুকের অংশ হিসাবে উপস্থাপন করে পুরস্কারও পেয়েছিলাম। লাইনগুলো ছিল এরকম

"হি হি হি
হাসব নাতো কি
হাসির বায়না নিয়েছি ।
হাসি ষোল টাকা মণ
হাসি মাঝারি গড়ন
হাসি বিবিয়ানা জানে
হাসি গুড়ুক তামুক টানে
হাসি ঝোলা গুড়ে ছড়া
.....।"

এ আসরে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকুমার রায়, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, শঙ্খঘোষ, জীবনান্দ দাস সহ অনেক কবির কবিতা আবৃত্তি শিখেছিলাম।

ওয়াহিদুল হক আবৃত্তির সাথে গান ঢোকালেন। আমি গান পারিনা। তিনি বললেন সেটা কোন সমস্যা নয়। সবার সাথে গলা মিলিয়ে গাও, হয়ে যাবে। তিনি প্রথম শেখালেন

"ওঠো ওঠোরে
বিফলে প্রভাত বলে যায় যে
মেল আঁখি জাগে জাগো
থেকো নামে অচেতন
ওঠো ওঠোরে
বিফলে প্রভাত বহে যায় যে। "

তিনি যে গানগুলো এখানে শেখাতেন এগুলো এতদিনের শোনা গানগুলি থেকে আলাদা। একদিন তিনি সুকুমার রায়ের রচনা সমগ্রের শেষ পাতায় চলে গেলেন। সেখানে সুকুমার রায়ের লেখা এবং স্বরলিপিসহ একটি ছড়া গান। গানটি চোখে পড়লেও এর মজা কখনও অনুভব করিনি। ওয়াহিদুল হক শেখালেন

"সখের প্রাণ গড়ের মাঠ
ছাত্র দুটি করেন পাঠ
পড়ায় নাইরে মন
সবাই হচ্ছে জ্বালাতন।
অতি ডেপো দুকান কান কাটা
ছাত্র দুটি বড়ই জ্যাঠা
কাউকে নাহি মানে
তোমরা ধরো ওদের কানে।
গুরু মশাই টিকি ওয়ালা
নিত্য যাবেন ঝিঙেটোলা
জমিদারের বাড়ী
সেথাই আড্ডা জমে ভারী "

ওয়াহিদুল হক যেদিন থাকতেন সেদিন মাস্টার মশাইও থাকতেন। তিনি তানপুরা বাজাতেন মাঝে মাঝে। একদিন তানপুরাটা আমার হাতে দিয়ে বললেন নে বাজা। করুণা স্যার আমাকে তুই বলে সম্বোধন করতেন।
আরে সহজ ধর। ওয়াহিদুল হক সায় দিলেন। ভয়ে ভয়ে তানপুরাটি কোলে তুলে নিলাম। ওয়াহিদুল হক কিভাবে বাজাতে হয় শিখিয়ে দিলেন। কয়েকবার আঙ্গুল চালানোর পর বললেন এইতো হচ্ছে। এরপর হয়ে গেলাম সে আসরের একজন নিয়মিত তানপুরা বাদক।

যখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে এলো, পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । পরীক্ষা শেষ হলে ব্যস্ত হয়ে গেলাম ছাত্র আন্দোলন নিয়ে। আমার আসরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ফুল কাকা সুনিলদার দোকান থেকে নতুন ডুগি তবলা বানিয়ে আনলেন। প্রথম প্রথম কদিন আগ্রহের সাথে বাজানো শেখা শুরু করলাম।

ধা ধা ধিন না বা তেরে কেটে তাক।

কিন্তু মন তখন পুরোপুরি অন্যদিকে। করুণা স্যারের কাছে আর তবলা শেখা হলো না। কিছুদিন পর দেখি তবলা ফেটে গেছে।

গান বা তবলা কোনটার শিল্পী হওয়া আমার দ্বারা হলো না। গানের বদলে গলায় উঠলো স্লোগান। সাইকেলে চড়ে ছুটে বেড়ায় শহরে এমাথা থেকে ওমাথায় খেলাঘর কিম্বা ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তুলতে। সাইকেল চালানোর সময় আপন মনে গাইতাম রবীন্দ্রনাথের গান।

একদিন রাতে বাসায় ফিরছি হেরে গলায় গাইতে গাইতে। পাশের হঠাৎ কানে এলো " ও বিশু। তাইতো ভাবছি এভাবে কে গান করে" দেখি রিকাশায় করুণা স্যার আর আভা পিসি।

আমাদের বন্ধু রাম। সেও করুণা স্যারেকে ডাকতো মাস্টার মশাই বলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলে চলে আসত ফরিদপুর। বিকালে আমরা দল বেঁধে হাটতাম পাড়ার গলি বা মূল সড়ক দিয়ে। মাঝে মাঝে মাস্টার মশাইয়ের সাথে দেখা হয়ে যেত। সেই পরিচিতি চেহারা, সাদা ধুতি, পাঞ্জাবী, কাঁধে ঝোলা, পানের রসে লাল টুকটুকে মুখ। সাথে মিহির গাঙ্গুলীর বদলি বাদল দাস বা অন্য কেউ। দুর থেকে দেখেই আমরা দাঁডিয়ে পড়তাম মাস্টার মশাইয়ের মুখোমুখি। মাস্টার মশাই একগাল হাসি দিয়ে বলতেন

" রামের তীর ধনুক নাই
বিশ্বকর্মার কর্ম নাই
বিশ্বসংসার চলবে কিভাবে।"

রাম খিল খিল করে হেসে ঢুপ করে রাস্তার মাঝখানেই মাস্টার মশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে একটা প্রণাম করতো। সাথে সাথে আমরাও।

সময় এবং স্রোত কাহার জন্য অপেক্ষা করে না। বিলু কাকা সিরাজ কাকা সে আসরটি পাঠচক্র আকারে চালিয়ে নিয়েছে আরও কিছুদিন। সিরাজ কাকা এক সময়ে গড়ে তোলে ফুলকি। রোজি ৮৮ সালের বন্যায় জলে ডুবে মারা যায়। লিপি এখন শিক্ষকতা আর খেলাঘর নিয়ে আছে। মমিন ভাই নিজেকে সপে দিয়েছে আধ্যাত্মিক পথে, জাহাঙ্গীর ভাই এখন কবি জাহাঙ্গীর খান, কাশেম ভাই এখন একটি কলজের অধ্যক্ষ।

রাম পড়াশোনা চলাকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল বিবেকানন্দ শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিষদ এবং জগন্নাথ হলে বিবেকানন্দের সর্ববৃহৎ ভাস্কর্য। এসময়ে আমার সময় কেটেছে রাজপথে স্লোগান দিয়ে। রাম চলে যায় লন্ডনে। সেখানে সে এখন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। অস্ট্রেলিয়াতে আমি এখনও এক কর্মহীন বিশ্ব অকর্মা।
প্রণাম করুণাময় অধিকারী, ফরিদপুরের কিংবদন্তি আমাদের মাস্টার মশাই ।

লেখক : প্রবাসী।