রণেশ মৈত্র


বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান এই উপমহাদেশের তিনটির প্রধান রাষ্ট্র। পরস্পর পরস্পরের অত্যন্ত নিকট প্রতিবেশী। শ্রীলংকা যেন কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে-যেমন চলে মিয়ানমারও। সব কটি দেশই কিছুকাল আগে স্বাধীন হয়েছে পরাধীনতার ছিল গণতন্ত্র এবং ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার। অর্থাৎ সংক্ষেপে যাকে আমরা বলি ধর্মনিরপেক্ষতা।

ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি আলোচনার ক্ষেত্রে পাকিস্তান কোন বিবেচনায়ই স্থান পেতে পারে না-পায়ও না। রাষ্ট্রটির জন্মই একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে তেমন অঙ্গীকারকে সামনে নিয়ে। পৃথক একটি মুসলমানদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে যা কিছু করার তার সবই করেছিল মুসলিম এবং তারা সফলও হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে অখন্ড ভারতবর্ষ থেকে ছিটকে বেরিয়ে পৃথক একটি রাষ্ট্র গঠন করার মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে। অবশেষে তারা তাদের প্রদত্ত ঐ অঙ্গীকার পূরণ করেছিল “ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান”-এই মৌলনীতি তাদের সংবিধানে ঘোষণার মধ্য দিয়ে।

পাকিস্তান আজও ঐ মূলনীতি ধারণ করে। সেখানে যদিও বিপুল সংখ্যক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মানুষের অস্তিত্ব পঞ্চাশ-ষাটের দশকে দেখেছি বেলুচিস্তান উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু এই তিনটি প্রদেশে এবং আংশিক হলেও পাঞ্চাবেও-কিন্তু আজ আর জঙ্গী-সন্ত্রাস মিলিটারীর সর্বগ্রাসী দাপটে তাঁদের কোন সন্ধানই পাওয়া যায় না। তাই অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার ন্যূনতম সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে।

এবারে চোখ মেলা যাক রোহিঙ্গা সমস্যার কল্যাণে অধুনা খ্যাত মিয়ানমার (সাবেক ব্রহ্মদেশ বা বার্মা) প্রসঙ্গে। বেশী কোন কথা আর বলারই দরকার নেই দেশটি সম্পর্কে। দীর্ঘকাল শতভাগ সামরিক শাসনের আওতায় থাকার পর কয়েক বছর যখন দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন-বিরোধী ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সীমাহীন নির্য্যাতনের শিকার অংসান শুচি বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী হলেন তখন যে প্রচ- আশাবাদ বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি হয়েছিল সে দেশে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে, রোহিঙ্গা নির্য্যাতন ও বিতাড়নের মধ্য দিয়ে তা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়েছে।

রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্মম নির্য্যাতন ও গণহত্যার অভিযোগে আজ মিয়ানমার সরকার আন্তার্জাতিক আদালতে আসামী। এই দেশটির সংবিধানে যদিও কোন রকম ধর্মীয় রাষ্ট্র বলে লেখা নেই বরং ধর্ম নিরপেক্ষতাই রাষ্ট্রীয় নীতি বলে ধারণা দেওয়ার রাষ্ট্রীয় নীতি বলে ধারণা দেওয়ার সৃষ্টি করা হয়েছে তবু ঐ রাষ্ট্রটির কার্য্যকলাপই নির্মমভাবে তাকে লংঘন করে চলায় কার্য্যত: দেশটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসাবেই আত্মপ্রকাশ করেছে-যার সহজে পরিবর্তন হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সামরিক বাহিনীর সাথে আপোষ করে ক্ষমতায় আসার ফলে দেশটির কোন কালে যে গণতন্ত্রের মুখ দেখবে তাও এক মস্ত গবেষণার বিষয়।

শ্রীলংকায় তো সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে দীর্ঘকাল ধরে অপ্রকাশ্য ভারতীয় মদদে তামিল নিধনের নামে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সংঘাত চলার পর মাত্র কয়েক বছর আগে তার সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার আগুন আপাতত: নিষ্প্রভ বলে মনে হলেও তা ধিকি ধিকি করে তুষের আগুনের মত এখনও জ¦লছে সে দেশের শাসক গোষ্ঠীর কল্যাণে। এ ব্যাপারে ভিন্নমতও থাকতে পারে-যা সঠিক বলে মনে হয় না। কামনা করবো আর যেন কখনও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা না ঘটে-অতীতের মত আর যেন হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি না ঘটে।

এবারে আসি উপমহাদেশ কেন সমগ্র বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ভারত প্রসঙ্গে। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিদেয় দিয়ে ভারত যখন ১৯৫৩ সালে তার প্রথম সংবিধান রচনা করে তার মূলনীতিতে গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা স্থান পেয়েছিল। সেই মূলনীতিগুলি সংবিধানে আজও অক্ষত আছে।

কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতার পর পর দুটি নির্বাচনে অধিষ্ঠিত হলো হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বি জে পি)। দলটির ঘোষিত নীতি স্পষ্টত:ই ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী বা সাম্প্রদায়িক। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও রাম মন্দির নির্মান স্থান পেয়েছে। কোন ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রই মন্দির, মসজিদ, গীর্জা নির্মাণ করতে পারে না। পারে না কোন বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্য দিতে। সকল ধর্মাবলম্বী মানুষই একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সমান সুযোগ-সুবিধা, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সমান অধিকারও ভোগ করবেন।

রাম মন্দির নির্মাণকে বা বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে অতীতে সমগ্র উপমহাদেশে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু, নারী ধর্ষণ, সম্পদ লুণ্ঠন প্রভৃতি করা হয়েছে। এগুলির মূলে ছিল বি জে পি-আজও তারা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমগ্র ভারতে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট নিয়েছে। এটা সংবিধান-বিরোধীই শুধু নয়, সম্ভবত: নির্বাচনী বিধিমালারও বিরোধী। তা সত্বেও শত শত বছর ধরে চলা বিরোধটি নিয়ে আজও পরিস্থিতি শান্ত নয়।

সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে “অযোধ্য মামলা” নামে খ্যাত এক চাঞ্চল্যকর মামলার রায়ে বলে দিলেন “বিতর্কিত স্থানে” রাম মন্দির নির্মিত হবে। ঐ রায়ে ভারত সরকারকে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, তিন মাসের মধ্যে ভারত সরকার একটি পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাষ্ট গঠন করবেন এবং ঐ ট্রাস্টিই নির্দিষ্ট এলাকায় রাম মন্দিরটি নির্মাণ করবেন।

নির্দেশটিতে আরও বলা হয়েছে ভারত সরকার একটি সুবিধাজনক স্থান ভারতের ওয়াকফ বোর্ডকে পাঁচ একর জমি দেবেন বাবরি মসজিদ নির্মাণের জন্য।

যে স্থানে ভারতের মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা, সেখানে আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় দুটি ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণের আদেশ দান রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা সঙ্গতভাবেই সে প্রশ্নটি থেকেই যায়।

তদুপরি এই রায় ভারতের জনগোষ্ঠীর অন্তত: অর্ধেক অংশকে (মুসলিম সম্প্রদায়, ধর্মনিরকেক্ষতায় বিশ্বাসী কোটি কোটি মানুষকে) খুশী করতে পারে নি। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলে আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার আশংকা থাকা সত্বেও ভারতের কোন কোন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায় মিছিল সমাবেশ করেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ও স্বভাবত:ই ক্ষুব্ধ। তাই এ রায় আবারও “পুনর্বিবেচনার” জন্য সুপ্রিম কোর্টেই আবেদন জানানো হবে বলে সে দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি সংগঠন তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সেখানকার মানুষ অপেক্ষায় থাকবেন। তবেই এই রায় যে বি জে পি শিবসেনা প্রমুখের পক্ষে গিয়েছে তা স্পষ্ট।

বি জে পি সরকার প্রথম দফায় দিল্লির ক্ষমতা দখলের পর তাদের সাম্প্রদায়িক চেহারা স্পষ্ট করে তুলেছিল। কোন কোন রাজ্যে মুসলমান, খৃষ্টান বিশ্বাসীদেরকে জোর করে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করা শুরু করে। তবে এই বে-আইনী এবং ধর্মীয় বিশ্বাসী সকলের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা হরণ করার প্রক্রিয়া দেশ-বিদেশের প্রবল বিরোধিতার মুখে দু’তিন মাসের মধ্যেই প্রক্রিয়াটি পরিত্যক্ত হয়।

অত:পর শুরু হয় গো-হত্যা, গো-মাংস ভক্ষণ বিরোধী অভিযান। বিজেপি শাসনাধীন কোন কোন রাজ্যে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা হয় আইন করে এবং অত:পর ঐ সব রাজ্যে এবং অপরাপর কোন কোন রাজ্যে গো-হত্যা, গো-মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণ, গো-মাংস বহনের বিরুদ্ধে কোন আইন থাকলেও ঐ অপরাধে অপরাধী আখ্যা দিয়ে যত্রতত্র মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের উপর নানাবিধ আক্রমণ নির্য্যাতন চালানো হয়। যদিও ভারত সরকার ইউরোপের দেশগুলিতে বিপুল পরিমাণে গোমাংস রফতানি করে।

অর্থাৎ নিজেরাই গো-হত্যা করে এবং অত:পর তার মাংস রফতানি করে। এভাবে নিজ নিজ রুচি অনুযায়ী খাবার নির্ধারণের অধিকার কেড়ে নিতে উদ্যোগী হয়। উল্লেখ্য, শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায় গো-মাংস ভক্ষণ করেন না কিন্ত বাদ-বাকী সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ গো-মাংস ভক্ষণ করে থাকে। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসীদের কথা অবশ্য আলাদা কারণ বৌদ্ধ ধর্মে জীব হত্যাই নিষিদ্ধ।

অত:পর বেশ কিছুকাল ধরে চলছে এবং সম্ভবত: আগামী লোকসভা নির্বাচন পর্য্যন্ত টেনে নেওয়া হবে নাগরিক পঞ্জী প্রকাশের মাধ্যমে মুসলমান উৎখাতের মতো ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক অভিযান। বিগত ২৩ নভেম্বর দৈনিক সংবাদে “ভারত জুড়ে নাগরিক পুঞ্জ হবেই” শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছেঃ

“ভারত জুড়ে নাগরিক পঞ্জী হবে জানিয়ে আসামের বর্তমান তালিকা বাতিলের ইঙ্গিত দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং বি জে পি সভাপতি অমিত শাহ্। একই সঙ্গে আসামে নতুন করে এন আর সি হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর এই বক্তব্যে উত্তর-পূর্ব রাজ্যটির নাগরিক পঞ্জী কার্য্যত: বাতিল হওয়ার পথে কিন্তু নতুন এন.আর.সিও আসামে প্রণীত হবে যার লক্ষ্য মুসলিম বিতাড়ন।

আসামের পরে ভারতের অপরাপর রাজ্যেও অনুরূপ অভিযান চালান হবে বলে ঘোষণা দেওয়ায় স্পষ্টত:ই বুঝা যায়-এন.আর.সি প্রণয়ন এবং মুসলিম বিতাড়নের মত নোংরা অভিযান দীর্ঘমেয়াদী রূপ পাবে। তার ফলে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক আবহও দীর্ঘ মেয়াদী রূপ পেতে পারে। তদুপরি যদি রাম মন্দির নির্মাণ সুরু হয়ে যায় তবে তো সোনায় সোহাগা। আর একটি নির্বাচন পাড়ি দেওয়াও হয়তো কঠিন হবে না।

কিন্তু রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা যে কার্য্যত: পরিত্যক্ত হলো, হচ্ছে এবং হবে তার কি হবে? প্রশ্নটি ভারত সহ সমগ্র বিশে^র সকল দেশের মননশীল মানুষেরই।

তাই কালবিলম্ব না করে ভারতের সকল অসাম্প্রদায়িক ও বাম প্রগতিশীল শক্তির আর কাল বিলম্ব না করে ঐক্যবদ্ধভাবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা সংরক্ষণের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণ করা ও সকল সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপ বাতিলের দাবীতে নিখিল ভারত গণ আন্দোলন গড়ে তুলে সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় সচেষ্ট হওয়ার বিকল্প নেই। আর তা না হলে তাঁদের রাজনৈতিক সলিল সমাধিই ঘটবে। তবে ভারতের সংগ্রামী, ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চিন্তায় বিশ্বাসী কোটি কোটি মানুষের উপর আস্থা রাখি তাঁরা দেশের এই মহাদুর্য্যােগের মুহুর্তে আর বেশী দিন ঘুমিয়ে থাকবেন না।

এবারে আসি স্বদেশ বাংলাদেশের প্রতি। এখানে ১৯৭১ এর নয় মাসব্যাপি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য্যময় সকল সমাপ্তির পর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রণীত এবং একই বছরের ৪ নভেম্বর তারিখে সর্বসম্মতিক্রমে তৎকালীন সংসদে অনুমোদিত সংবিধান, যা ‘বাহাত্তরের সংবিধান’ নামে খ্যাত, তাতে যে চার মৌলনীতি গৃহীত হয়।

কিন্তু এর পটভূমি বিশাল এবং অসংখ আন্দোলন সংগ্রামের, আত্মদানের, নির্য্যাতনের করুন ইতিহাসে পূর্ণ।
আমরা জানি, অখ- ভারতবর্ষে ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সম্মেলনে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, মুসলিম গরিষ্ঠ প্রদেশগুলি নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হবে।

অত:পর এবং আগেও, দফায় দফায় ভারতজুড়ে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে ১৯৪৭ এর ১৪ আগষ্ট ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত করে পাকিস্তান নামক মুসলিম রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটে। পরবর্তীতে দেশর সামরিক শাসকেরা দেশটিকে “ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং আজও তা বহাল তবিয়তে ঐ দেশে বহাল আছে। পাকিস্তানের সংবিদানে কদাপি ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে লেখাও হয় নি।

কিন্তু অগণিত মানুষের ক্ষের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে তা লিখিত হলেও যুগ যুগ ধরে পরিচালিত লাড়াই সংগ্রামের ফসলটি মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় হারাতে হলো মুক্তিযোদ্ধ বলে পরিচিত সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের তরবারির খোঁচায়। আর সেই হারানো জাতি তা আজ দীর্ঘ ৪৪ বছরেও ফেরত পেলো না। সহসা তা পাওয়ার কোন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭৫ এর পর, সম্ভবত: ১৯৭৬ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, দেশের বামপন্থী দলগুলির সক্রিয় উধ্যোগে ও অংশগ্রহণে বাহাত্তরের মূল সংবিধান পুন: স্থাপনের দাবীতে ঐক্য বদ্ধ গণ-আন্দোলন পরিচালনা করে এসেছে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্য্যন্ত। ইতোমধ্যে জিয়া আশির দশকে ধর্মনিরপেক্ষতা যেমন উঠিয়ে দিয়েছিলেন, তেমনই সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ স্থাপন ও জামায়াতে ইসলামী সহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলকে সাংবিধানিক বৈধতা ও দান করেন যদিও এ সবই ছিল বে-আইনী এবং তাঁর এখতিয়ার বহির্ভূত।

অত:পর এলেন আবর এক সামরিক শাসক কুখ্যাত স্বৈরাশাসক হিসেবে পরিচিÍ হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। জিয়ার অনুরুপ তিনি সংবিধানের বসালেন “বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হইবে ইসলাম।” কেউ এ দাবী জানায় নি বরং এর সর্বাত্মক বিরোধিতা ছিল সচেতন মহলে। আবারও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম যার অন্যতম কর্মসূচী ছিলো “বাহাত্তরের মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তন”। এ আন্দোলনের নৈতৃত্বে ছিলো আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো দফায় দফায়। আজও দলটি ক্ষমতাসীন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ইতোমধ্যে একটি রিট মোকর্দমায় হাই কোর্ট এবং তার, রায়ের বিরুদ্দে দায়ের করা আপীলে সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মত রায়ে জিয়া এরশাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ও তাদের জারী করা ঐ সংশোধনীগুলিতে বে-আইনী এবং সংবিধান ও এখতিয়ার বহির্ভূতি বলে ঘোষণা করলে তড়িঘড়ি করে আওয়ামী লীঘ পার্লামেন্টে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে ঐ বে-আইনী ঘোষিত সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে উপেক্ষা করে জিয়া এরশাদ ঘোষিত ঐ ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী সংশোধন গুলিকে পুন: বৈধতা দিয়ে আজতক অব্যাহত রেখেছেন সকল সচেতন মহলের বিরোধিতা সত্বেও।

এতে উৎফুল্ল হয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মাঝে মাঝেই সংঘটিত হতে থাকে বিশেষ করে ২০০১ সাল থেকে। মন্দির , গীর্জা আক্রমণ, সেগুলিতে আগুন দিয়ে পোড়ালো, মূর্তি ভাঙচুর ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নানাবিধ নির্য্যাতন, জীবনের হুমকি দিয়ে দেশত্যাগে বাধ্যকরণ প্রভৃতি অব্যাহতভাবে চলছে। কিন্তু একটিরও বিচার নেই।

অধিকন্তু আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের ঘোষণা দানকারী নতুন জঙ্গী উৎপাদনকারী হেফাজতে ইসলামের কাছে নতি স্বীকার করে বিপুল পরিমাণ কমি দিয়ে, তাদের হুমকি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে ‘জাষ্টিসিয়া’ নামক শিল্প কর্মটিকে লোকচক্ষুর আড়ালে স্থানান্তের ও তাদেরই পরামর্শেশিশুদের পাঠ্যপুস্তকে খ্যাতনামা অসাম্প্রদায়িক লেখকদের রচিত গল্প, প্রবন্ধ, কবিতাদি বর্জন করে সাম্প্রদায়িক লেখকদের রচনা তার স্থলে পাঠ্যসূচীতে স্থান দিয়ে নতুন বই লাখে লাখে ছেপে বিলি করে কোমল মতি শিশুদের মননে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছে।

এরূপ কার্য্যকলাপের ফলে বাংলাদেশের আদর্শিক পশ্চাদপসারণ চূড়ান্ত পর্য্যায়ে নিয়ে কার্য্যত: পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়া জোরে সোরে চালানো হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া প্রতিরোধের শক্তি আজ দুর্বল এবং শাসক গোষ্ঠি দিব্যি তার সুযোগ পূরোপূরি নিচ্ছে। এই দাঁড়ালো উপমহাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার হাল হাকিকত।

আশার কথা অপর একটি প্রতিবেশী দেশ নেপাল হিন্দু গষ্ঠি দেশ এবং হিন্দু রাষ্ট্র বলে লিখিত থাকলেও সম্প্রতি সে দেশের বাম প্রগতিশীল শক্তিগুলি নির্বাচনে জিতে “হিন্দু রাষ্ট্র” তুলে দিয়ে “ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র” হিসেবে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশ তার সংগ্রামী ঐতিহ্য, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মালা ও নেপালের সংবিধান থেকে “হিন্দু রাষ্ট্র” তুর্কি দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গোষণা করা থেকে শিক্ষা নেবে?

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।