বিনোদন ডেস্ক : বলিউডে যখন সুন্দরীদের নিয়ে আলোচনা হয় তখনি সবার আগে উঠে আসে যে নাম তিনি মধুবালা। প্রয়াত এই নায়িকার সৌন্দর্য নিয়ে চিরকাল গর্ব করবে ভারতীয় সিনেমা। তার রূপ লাবণ্যের যে রোশনাই তাতে আলোকিত ছিলো পঞ্চাশ- ষাট দশকের বলিউড।

মিষ্টি হাসির এই অভিনেত্রীর অভিনয় ও গ্ল্যামারের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিলো হলিউডেও। পেয়েছিলেন তিনি কাজেরও প্রস্তাব। অতি লোভী বাবার কারণে হলিউডের সিনেমায় অভিনয় করেননি মধুবালা। হলিউডে মধুবালাকে দেখতে না পাওয়ার আফসোস তাই চিরকালই থেকে যাবে ভারতের দর্শকের।

সৌন্দর্যের জন্য মধুবালাকে ‘ভেনাস কুইন‘ বলে সম্বোধন করা হতো। এই কারণে তার প্রেমিকের অভাব ছিলো না। শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, খেলোয়ার থেকে শুরু করে ডাকসাইটে সব নায়কেরা মধুবালাকে পেতে চাইতেন। চলতো তাকে অধিকারে রাখার স্নায়ুযুদ্ধও।

মধুবালাও ছিলেন চঞ্চলা হরিণীর মতো। যখন যাকে ভালো লেগেছে তার কাছে ধরা দিয়েছেন প্রেমের জোছনা হয়ে। মধুবালার জীবন ঘেঁটে তার অনেক প্রেমিকের গল্পই পাওয়া যায়। কারো কাছ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, কারো কাছে প্রতারিত হয়েছেন। তবে সাতজন পুরুষের নাম মধুবালার জীবনে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়। যার শুরুটা দিল্লীতে শৈশবের প্রেমিক লতিফকে দিয়ে।

দিল্লী ছেড়ে মুম্বাই পাড়ি দেওয়ার সময় নিজেদের ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে লতিফকে একটা লাল গোলাপ উপহার দেন মধুবালা। শোনা যায় সেই গোলাপ সারাজীবন নিজের কাছে রেখেছিলেন লতিফ। পরে মধুবালার মৃত্যুর পর তার কবরে সেই গোলাপ রেখে আসেন লতিফ। এরপর প্রতি বছর প্রেমিকার মৃত্যুবার্ষিকীতে মধুবালার সমাধিতে একটা লাল গোলাপ রেখে আসতেন লতিফ।

তালিকায় অন্য নামগুলো হলো পরিচালক কিদার শর্মা, পরিচালক কমল আমরোহি, অভিনেতা প্রেমনাথ, জুলফিকার আলি ভুট্টো, কিশোর কুমার আর দিলীপ কুমার। তবে সব নামের ভিড়ে দিলীপ কুমারের সঙ্গে মধুবালার প্রেমটা অমরত্ব পেয়েছে, ইতিহাসে যেমন অমর হয়ে আছে এই জুটি অভিনীত ‘মুঘল-ই-আযম’ ছবির সেলিম ও আনারকলি।

মুঘলদের ইতিহাস বলে সেলিম-আনারকলির প্রেমের প্রতিবন্ধক ছিলেন নায়কের স্রমাট বাবা। আর মধু-দিলীপের গল্পের ভিলেন নায়িকার অর্থলোভী বাবা আতাউল্লাহ খান। মধুবালার বাবা ছিলেন অত্যন্ত মুনাফালোভী মানুষ। মেয়েকে তিনি টাকার মেশিন হিসেবে দেখতেন। তার সেই বাজে স্বভাবের কারণে মধুবালাকে অনেক ভুগতে হয়েছে। মধুবালার অকাল মৃত্যুর জন্য তার বাবাকে দায়ী করলে বিন্দুমাত্র বাড়াবাড়ি হবে না। সেই বাবার জেদের কাছে মধুবালা কোরবানি করেছিলেন দিলীপ কুমারের জন্য তার প্রেম।

দিলীপ কুমারকে ভুলতেই হয়তো আরেক কিংবদন্তি নায়ক ও গায়ক কিশোর কুমারকে কাছে টেনেছিলেন মধুবালা। অনেকে বলেন কিশোরকে ভালোবেসে বিয়ে করে দিলীপের উপর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন তিনি।

তবে সেই কিশোর কুমারের সঙ্গেও সুখে থাকা হয়নি মধুবালার। বিয়ের কিছুদিন পরই মধুবালার শরীর খারাপ হতে থাকে। জানা যায় জন্ম থেকেই তার হার্টে ছিদ্র ছিলো। মধুবালা অনেক দিন আগে থেকেই নিজের এ অসুখ সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু ঘটনাটি জানাজানি হলে মেয়ে বেকার হয়ে পড়বে এই ভয়ে তার বাবা এটি প্রকাশ করতে বারণ করেন।

অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি নিয়মিত কাজ করে গেছেন দিনের পর দিন, পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য। প্রায়ই শুটিংয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তেন মধুবালা। কিন্তু সেটাকে আমলে নিয়ে সঠিক চিকিৎসা হয়নি কখনো। দিনে দিনে এই অসুখ মারাত্মক হয়ে ধরা দিলো একটা সময়।

দুঃসহ যন্ত্রণায় নয়টি বছর পার করে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন অনিন্দ্য সুন্দরী মধুবালা।

এত এত মানুষের স্বপ্নের রানী ছিলেন, ভালোবেসার মালা দিয়েছেন অনেকের গলায়, বিয়েও করেছিলেন একজনকে। কিন্তু মৃত্যুশয্যায় কাউকেই পাশে পেলেন না মধুবালা! আহা জীবন! বড্ড বেশিই করুণ। এজন্যই হয়তো মধুবালাকে নিয়ে বলতে গিয়ে অনেকে ‘দ্য বিউটি উইথ ট্র্যাজেডি’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন।

শুধু অসামান্য রূপই নয়, অভিনয় দিয়ে পঞ্চাশের দশকে নার্গিস, মীনা কুমারীদের ছাপিয়ে হিন্দি সিনেমায় নিজের সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৮- ১৯৬০ সাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে তিনি আরোহণ করেন যশ ও খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু এড়াতে পারেননি নিষ্ঠুর নিয়তিকে।

সত্য হয়েছিল সেই দরবেশের কথা। যিনি খুব ছোটবেলায় মধুবালাকে দেখে বলেছিলেন ‘এ মেয়ে অনেক খ্যাতি লাভ করবে। কিন্তু সুখী হতে পারবে না। অকাল মৃত্যু হবে তার।’
৩৬ বছরে মধুবালার জীবনাবসান হবার পর সেই দরবেশের বাক্যটাই ঘুরেফিরে এসেছিলো বারবার। আজও মধুবালার মৃত্যু নিয়ে কথা হলেই ফিরে ফিরে আসে সেই অজানা-অখ্যাত দরবেশের কথা। যিনি একটি রূপকথার চরিত্র হয়ে আছেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৩৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দিল্লির এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মধুবালা। তার পারিবারিক নাম ছিল মমতাজ জাহান দেহলভী। বাবা আতাউল্লা খান পেশোয়ারের ইয়ুসুফজায়ি গোত্রের পাঠান।

তার বাবা পেশোয়ারের একটি তামাক কোম্পানিতে চাকরি হারানোর পর তারা ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমান বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই)। তার পরিবার অসহায়ত্বের মাঝে পড়ে যখন পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই তার পাঁচ ভাই-বোন মারা যায়। এরপর ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল মুম্বাই ডকে বিস্ফোরণের ঘটনায় হারিয়ে যায় তাদের ছোট্ট ঘরটিও। পরিবারের এমন দুর্দশার মধ্যে একমাত্র আশার আলো ছিলেন মমতাজ জাহান।

পরিবারের জন্য আয়ের ব্যবস্থা করতেই মাত্র নয় বছর বয়সে শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয়ে নামেন মধুবালা। তখনও তিনি মমতাজ বলেই পরিচিত সবখানে। এই নাম নিয়েই মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ১৯৪৭ সালে ‘নীল কমল’ ছবিতে নায়িকা হিসেবে হাজির হন তখনকার সুপারস্টার রাজ কাপুরের বিপরীতে।

এরপর ১৯৪৯ সালের ‘মহল’ সিনেমার মাধ্যমে বলা যায় রাতারাতিই তিনি মহাতারকা বনে যান। তখন তিনি মধুবালা নামে সিনেমা করা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে নির্মিত ‘মহল’ সিনেমাটির বিপুল সাফল্য তার ক্যারিয়ারে অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠে। এরপর মধুবালার জনপ্রিয় হয়ে উঠেন ‘দুলারি’(১৯৪৯), ‘বেকসুর’(১৯৫০), ‘তারানা’(১৯৫১), ‘বাদল’(১৯৫১), ‘মুঘল-ই-আজম’(১৯৬০০ সহ আরও অনেক সফল সিনেমা দিয়ে।

তার সময়ে বলিউডের ত্রিরত্ন দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর ও দেব আনন্দ; এই তিন নায়কের সঙ্গেই সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। জুটি বেঁধেছেন কিশোর কুমারের সঙ্গেও।

মধুবালার তারকা-খ্যাতি ভারত পেরিয়ে সাড়া ফেলে হলিউডেও। ১৯৫২ সালের আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘থিয়েটার আর্টস’ এ তাকে নিয়ে “The Biggest Star in the World – and she’s not in Beverly Hills” শিরোনামে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়।

সেসময় অস্কারজয়ী আমেরিকান পরিচালক ফ্রাঙ্ক ক্যাপরা তাকে হলিউডের একটি ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মধুর বাবা রাজি না হওয়ায় সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি।

(ওএস/এসপি/ডিসেম্বর ০৩, ২০১৯)