সজল কুমার সরকার


বাংলা কেবল যোগাযোগ করার একটি মাধ্যম নয়। এই ভাষা বাঙালির রক্তস্নাত সেরা অর্জনের অন্যতম অহংকার ও বাঙালি চেতনার সৌরজগত। তাছাড়া প্রাথমিকভাবে বাংলা ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ও শিশুকে শিখতে হয় মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে। তাই সাবলীলভাবে পড়তে পারা শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আমরা সাবলীলভাবে পড়তে পারা বলতে বুঝি - বানানছাড়া, বিরামচিহ্ন ব্যবহার করে ও অর্থ বুঝে পড়তে পারাকে।

শিক্ষক, অভিভাবক ও সুধীমহলসহ আমরা সবাই জানি পঠন দক্ষতা একটি শিশুর শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জীবনের শুরুতে পড়ার ভিত মজবুত, ঝরেপড়া হ্রাস, শিখনফল নিশ্চিত তথা প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন কেবল তখনই সম্ভব যদি একটি শিশুর সাবলীল পড়ার অন্তরায়সমূহ আমরা দূর করতে পারি।

এছাড়া মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার সমকালীন আলোচিত বিষয়ও এটি। যাহোক সাবলীল পড়ার দক্ষতা অর্জনের কতিপয় সমস্যা ও এর সমাধানমূলক ভাবনাগুলো নিম্নরূপ ..............

আমাদের যে সব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে :

বর্ণ মালা চিনেনা, বর্ণের সাথে এর উচ্চারিত রূপ মানে ‘ধ্বনি’র সাথে পরিচিত না, বর্ণের সাথে কার চিহ্ন যোগ করে পড়তে পারেনা, বানান করতে পারলেও শব্দ মিলাতে পারেনা, বানান করে এক কিন্তু উচ্চারণ করে ভিন্ন, যুক্তবর্ণ ভেঙে পড়তে বা শব্দ মিলাতে পারেনা, পড়ার ক্ষেত্রে জড়তা দেখা যায় যেমন একই শব্দ বার বার পড়ে, শব্দাংশ সম্পর্কে ধারনা না থাকায় দীর্ঘ শব্দ উচ্চারণে সমস্যা হয়, শব্দ ছেড়ে ছেড়ে পড়া, কঠিন শব্দ বাদ দিয়ে পড়া, মুখস্থ পড়তে পারে কিন্তু শব্দ বললে চিনেনা, কেউ কেউ সুর করে পড়ে, দাঁড়ি, কমা ব্যবহার করে পড়তে সমস্যা, প্রয়োজনীয় উপকরণের ঘাটতি, বিদ্যালয়ে শিশুর অনিয়মিত উপস্থিতি, পাঠসংশ্লিষ্ট প্রতিযোগিতার আয়োজন না করা, শিক্ষকদের যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব ও নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।

এই সব সমস্যার সমাধানের পথগুলোর মধ্যে রয়েছে :

বর্ণ মালা শেখানো, বর্ণের ধ্বনি রূপের পর্যাপ্ত অনুশীলন করানো, বর্ণ বা শব্দ গেমের ব্যবহার --- (যেমন বর্ণ ও ধ্বনি শেখানোর জন্য silent mouthing game, অথবা শিক্ষার্থীর পিঠে একটি বর্ণ লিখে কি বর্ণ লিখা হলো তা বলতে বলা।), টুলস বা মূল্যায়ন উপকরণ তৈরি করা, মূল্যায়ন উপকরণ তৈরির ক্ষেত্রে শ্রেণিভিত্তিক অর্জন উপযোগি যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া, শব্দ থেকে বর্ণ চিহ্নিত করা। যেমন ------- কাক থেকে ক, কলা থেকে ক ইত্যাদি, বর্ণের ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ইত্যাদি প্রমিত উচ্চারণে পড়ানো, পরিচিত বা দৃষ্টির আয়ত্বাধীন শব্দ ভান্ডার বাড়ানো, একসাথে খুব বেশি শব্দ না শেখানো, ধারণামূলক শব্দ যেমন ---অসীম, মমতা, আনন্দ, ইত্যাদি সহজ ভাষায় বুঝানো, ছবি চার্ট দেখে শব্দকার্ড, বাক্যকার্ড মিলকরণ, নোর কৌশলের উপর গুরুত্ব দেয়া যেমন - ছবিসহ তথ্য দেয়া, দলীয় কাজ প্রদান বাক্যানুক্রমিক পদ্ধতিতে পড়ানো, শিশুদের মাঝে পড়ার আগ্রহ তৈরি করা--- সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন, কাগজের টোঙা ইত্যাদি প্রদান, রিডিং চার্ট ব্যবহার করা---(যেমন পাঠ্যবইয়ের পড়ানো গল্প বা কবিতার সারসংক্ষেপ বড় কাগজে লিখে ব্যবহার করা।), পালাক্রমে সব শিক্ষার্থীর ১ মিনিট রিডিং এককভাবে পর্যবেক্ষণ করে পিছিয়ে পড়াদের সহায়তা প্রদান, শিক্ষক পড়ে শিশুদের পড়া শেখানো। কারণ বড়রা পড়লে শিশুরাও পড়তে উৎসাহিতবোধ করে,Supplementary Reading Materials এর নিয়মিত ব্যবহার, শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিযোগিতার আয়োজন ও পুরস্কার প্রদান ইত্যাদি।

SDG’র ১৭টি লক্ষ্য অর্জনের সময়সীমা ২০৩০ এর ৩১ ডিসেম্বর বেঁধে দেওয়া হলেও আমরা যদি আন্তরিকতার সাথে সচেষ্ট হই তাহলে SDG’র ৪র্থ লক্ষ্য মানসম্মত শিক্ষা ২০২০ “মুজিববর্ষেই” অর্জন হবে বলে আশা করি।

লেখক : প্রধান শিক্ষক, দুল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেন্দুয়া, নেত্রকোণা।