মাহবুব আরিফ


 

জাতিসংঘ আয়োজিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৫ মাদ্রিদ-এ প্রিয় সংগঠন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগদান  উপলক্ষে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আসা আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীদের হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার  অবস্থা! বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ গত ১ ডিসেম্বর থেকেই স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ শহরে সমবেত হতে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য, মাদ্রিদে নাগরিক বা গণ সংবর্ধনা আয়োজনের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ প্রধানের সান্নিধ্যে এসে ইউরোপে আওয়ামীলীগের কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা ও মতামত ব্যক্ত করা। যখনই আওয়ামীলীগ প্রধানের বিশেষ কোন সরকারি কাজে ইউরোপে আগমন ঘটে ঠিক তখনই ইউরোপের নেতা কর্মীদের মাঝে এ ধরনের  হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার ঘটে। নেতা কর্মীরা তাদের মনের অব্যক্ত কথা, আবদার, অনুযোগ বা অভিযোগ সরাসরি তাদের প্রাণ প্রিয় নেত্রীকে জানাতে পারেন।

এবারের মাদ্রিদ মিশনে অংশ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হল, দল প্রধানকে সংবর্ধনা দেওয়া ও তাঁর সাথে মতামত বিনিময়ের সুযোগটাকে উপেক্ষা করতেই সবাই মাদ্রিদে মিলিত হয়েছেন। ইউরোপীয় আওয়ামীলীগ, বিতর্কিত স্পেন আওয়ামীলীগের নতুন কমিটি ও মাদ্রিদের বাংলাদেশ দূতাবাস নিজেদের নির্বাচিত স্থানীয় অতিথিদের সমন্বয়ে খুবই সীমিত আকারে গত ১ ডিসেম্বর স্থানীয় একটি হোটেলে আওয়ামীলীগ প্রধানকে সংবর্ধনার আয়োজন করে। ওই দিন সন্ধ্যা ৭ টার দিকে ওই হোটেলে এসে দেখতে পাই, ইউরোপ থেকে আসা বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা হোটেল লবীতে সমবেত হয়ে সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছে ও তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ প্রকাশ করছে। তাদের বিক্ষুব্ধ বক্তব্যে উঠে আসছে, কী করে একজন জামাতপন্থী ও যুদ্ধাপরাধী পক্ষের ব্যবসায়ী রবীনকে স্পেন আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হল! মাল্টায় তড়িঘড়ি আওয়ামীলীগের সম্মেলনের নামে দায়সারা গোছের এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে হাইব্রিড মশিউর রহমানকে সভাপতি করা হল!

মাদ্রিদের হোটেলে খুবই সীমিত আকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ প্রধানকে দেয়া সংবর্ধনাকালে ইউরোপ আওয়ামীলীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান রবীন ও মশিউর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দেন। এতে সবার ক্ষোভ যায় আরও। ইউরোপ আওয়ামীলীগের এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নেতা কর্মীরা সভাপতি নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে খুবই কুৎসিত ভাষায় শ্লোগান দেয়। ইতোমধ্যে মাল্টা আওয়ামীলীগের সভাপতি মশিউর রহমানের বিগত দিনে আওয়ামীলীগ প্রধানকে কটাক্ষ করে যেসব বিতর্কিত স্ট্যাটাস দিয়েছেন, সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে দুঃখজনক ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রবাসে এমন এমন পরিস্থিতি দেশের জন্যও অবমাননাকর।

ঘটনা পরম্পরায় হতবাক হয়ে বিষয়টি জানতে আমি পরের দিন ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় স্পেন আওয়ামীলীগের নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও আমার একান্ত ঘনিষ্ঠজন রেজভী আলমের সাথে যোগাযোগ করি। যুদ্ধাপরাধী পক্ষের ব্যবসায়ী রবীনকে স্পেন আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করার বিষয়ে তাকে সরাসরি প্রশ্ন করে জানতে পারি যে, রবীন ২০১৩ সালে স্পেনের বাঙালি কমিউনিটির কোন একটি সংগঠনের সভাপতি হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। তবে সেটা ছিল যুদ্ধাপরাধী পক্ষের একটি চক্রান্ত, কৌশলে রবীনকে সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করানো হয়, যেটা তিনি বুঝতে পারেননি! পরবর্তীতে তিনি অর্থাৎ স্পেন আওয়ামীলীগের বর্তমান সভাপতি রবীন বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন! যদিও আমার প্রশ্ন ছিল, তিনি যদি বুঝেই থাকেন যে কৌশলে তাকে ওই অনুষ্ঠানে নেয়া হয়েছে, তবে তিনি সেই অনুষ্ঠান বর্জন করেননি কেন? কেনইবা তিনি দীর্ঘ সময় ওই বিতর্কিত অনুষ্ঠানে থাকলেন? এই বিষয়টি অন্তত আমার কাছে বিতর্কিত ও দুঃখজনক। রাশেদা হক কনিকার একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে স্পেন আওয়ামীলীগ ও ইউরোপিয়ান আওয়ামীলীগ নিয়ে লেখাও দেখতে পাই। কিন্তু যে বিষয়টি আমার কাছে খুবই অদ্ভুত লেগেছে যে, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামীলীগ ও স্পেনের আওয়ামীলীগ স্পেনের রাষ্ট্রদূতের সহযোগিতায় কেন খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ প্রধানকে সংবর্ধনার আয়োজন করেন? বিতর্কিত বিষয়গুলোকে ধামাচাপা দিতেই কি সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামীলীগের এই আয়োজন? প্রবাসে বাংলাদেশীদের মাঝে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের এক বিশাল সমর্থন আছে বৈকি, কিন্তু তাই বলে সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামীলীগ বা কোন প্রবাসী আওয়ামীলীগ সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের অঙ্গ, সহযোগী বা শাখা সংগঠন নয়। তারপরও মাদ্রিদে অবস্থান কালে ইউরোপ আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বার বার বলতে শুনেছি, তারা নাকি আওয়ামীলীগ প্রধানের অনুমোদিত কমিটি, এখানে তাদের কমিটির প্রতি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ প্রধানের সমর্থন থাকাই তো যথেষ্ট! তাই বলে গঠনতন্ত্রের বিপক্ষে নিজেদের অনুমোদিত কমিটি বলে প্রকাশ করার যৌক্তিকতা কোথায়? তার পরদিন ৩ ডিসেম্বর স্পেন আওয়ামীলীগের একটি পক্ষ ইউরোপ আওয়ামীলীগের সমালোচনা করে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ও ৪ ডিসেম্বর ইউরোপ আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক একটি ভিডিও বার্তায় ইউরোপ আওয়ামীলীগের অন্যায় ও অসঙ্গত কার্যকলাপের নিন্দা জ্ঞাপন করেন।

৩ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার অনলাইন নিউজ পোর্টাল উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের সম্পাদক প্রবীর সিকদারের একটি স্ট্যাটাস পড়েই আমি সরাসরি প্রবীর দাদাকে ফোন করে জানাই যে, আমি নিজেই এখানে উপস্থিত আছি এবং এ বিষয়ে আমি নিজেই বিস্তারিত লিখে একটা রিপোর্ট আপনার পত্রিকার জন্যে রেডি করছি।

সেইদিন সন্ধ্যায় মাদ্রিদের একটি হোটেলে ইউরোপ আওয়ামীলীগের প্রধানদের আমাদের কয়েকজনের সাথে বৈঠকের আমন্ত্রণ জানাই। এতে নজরুল সাহেবের আন্তরিকতা থাকলেও প্রথম দিকে ইউরোপ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাহেব বেশ বিরক্তির সাথেই অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে হয়তো কোনও চাপের মুখে তিনি আলোচনায় সম্মতি প্রদান করেন। ওই আলোচনায় আমাকে যারা সহযোগিতা করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফিনল্যান্ড আওয়ামীলীগের সৎ ও নির্ভীক সাধারণ সম্পাদক মাইনুল ইসলাম। ওই আলোচনার সূত্রে একটি বিষয়ে আমি নিশ্চিত হই যে, কর্মী বান্ধব রাজনীতিতে ইউরোপিয়ান আওয়ামীলীগ এখনও খুব সাবলীল ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিভিন্ন দেশে আওয়ামীলীগের কমিটি নিয়ে বিভাজন নিরসনে তাদের ভূমিকা খুবই দুর্বল। এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইউরোপ তথা প্রবাসে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সমর্থনে সংগঠন করার সাংগঠনিক অধিকার হয়তো রয়েছে প্রবাসী আওয়ামীলীগ সমর্থকদের। এতে হয়তো বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সমর্থনও জানাতে পারে, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসে আওয়ামীলীগের কমিটি অনুমোদনের বিষয়টি আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। আমার বিবেচনায় আসছে না, প্রবাসে আওয়ামীলীগের কমিটি নিয়ে ভয়ঙ্কর রকমের বানিজ্য নয়; সেই দায় কেন বহন করবে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ! বিভিন্ন দেশে আওয়ামীলীগের কমিটি নিয়ে যে কোন্দল ও বিভাজন চলছে, সেটি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সুনাম বৃদ্ধি তো করেই না, উপরন্তু মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে।এসবের কী খুব প্রয়োজন আছে?

লেখক : সুইডেন প্রবাসী।