রাণীশংকৈল ও হরিপুর প্রতিনিধি : প্রতি বছরের ন্যায় এবছরেও শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল ও হরিপুর উপজেলার সীমান্তে বসলো এপার-ওপার দুই বাংলার মিলন মেলা। লক্ষাধিক মানুষের মিলন মেলায় যেমনি ছিলো কান্নার রোল তেমনি বয়ে গেছে আনন্দের বন্যা ।

স্বজনেরা প্রতি বছরে অপেক্ষা করে এই দিনটিতে নিজ নিজ নিকটআত্বীয়ের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য। লাখো লোকের ভিরে অনেকে নিজ স্বজন কে খুজতে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় পার করে । জেলা শহর থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দুরে রাণীশংকৈ উপজেলার কোচল ও হরিপুর উপজেলার ভাতুরিয়া ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে জামোরকালি জিউ মন্দির কমিটি প্রতিবছর এই মেলার আয়োজন করে ।

ঠাকুরগাঁওয়ের দুই উপজেলার কোচল ও চাপসার সীমান্তের নিভৃত পল্লী গোবিন্দপুরে কুলিক নদীর পাড়ে বসেছে ভারত-বাংলাদেশীদের মিলন মেলা।

দুই দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আগত হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও আবালবৃদ্ধ দুই দেশে বসবাসরত তাদের আত্বীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করে মনের ভাষা আদান-প্রদানের জন্য সুর্য উঠার সাথে সাথেই ভিড় করতে থাকে উভয় সীমান্তে ।

স্থানীয়রা বলেন, বৃটিশ আমল থেকেই সীমান্ত ঘেষা গোবিন্দপুরের এই মেলা "পাথর কালি মেলা" নামে পরিচিত। প্রতি বছরে এখানে একদিনের জন্য এই মেলাটি বসে আসছে। দেশ স্বাধীনের পরে মেলাটি বাংলাদেশের অংশে পড়লেও মেলায় ভারতীয়দের অংশগ্রহনের জন্য ঐদিন সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয় ভারত । কোন প্রকার বাধা ছাড়ায় সীমান্তের কাটা তারের কাছে এসে আত্বীয়-স্বজনদের সাথে কুশল বিনিময় করতে পারে দুই দেশের মানুষ ।

ভারত-বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ এ মেলায় এসে দুই দেশে বসবাসরত আত্বীয়-স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত করে খুশি করার জন্য এক অপরকে মিষ্টি, আপেল, কমলা, থ্রীপিজ শাড়ি, লুঙ্গি, ইলিশ মাছ'সহ নানা প্রকার খাদ্য ও কাপড় আদান প্রদান করে । খবরটি লোক মুখে দুই দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পরে ।

এতে দুই দেশে বসবাসরত আত্বীয়-স্বজনরা সহজেই দেখা করার জন্য এ দিনটির অপেক্ষা করে দুই দেশের মানুষ ।

সাধারণত কালিপুজার পরে ডিসেম্বর মাসের সপ্তাহের প্রথম শুক্রবার এ মেলা বসানো হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও আত্বীয়স্বজনদের সাথে দেখা করতে গত কয়েকদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ স্থানীয় আতœীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।

এছাড়াও শুক্রবার সকাল থেকে সাইকেল, মটরসাইকেল, ভ্যান, অটোচার্জার, পাগলু, মাইক্রোবাস, পিকাপ, নছিমন যোগেও হাজার হাজার মানুষ আত্বীয়স্বজন ও "পাথর কালি" নামের এই মেলাটি দেখতে আসে । সকাল ৯টা থেকে শুরু করলেও সীমান্তের কাছে ১০টাই ভীড়তে শুরু করে মানুষ । ভারতের মাকড় হাট ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা সীমান্তের ৩৪৬নং পিলারের সীমানায় কাটাতারের পাশে সাক্ষাত করতে দেয় দুই দেশের মানুষকে । শুরু হয় দুই দেশের মানুষের দেখা-সাক্ষাৎ ও ভাব বিনিময় । দীর্ঘদীন পর স্বজনদের কাছে পেয়ে একে অপরকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

মেলাস্থলে কথা হয়, গাইবান্দার গোবিন্দ উপজেলার অখিল চন্দ্র পাল(৬২) এর সাথে কথা হয়। তিনি জানালেন ভারতের রায়গঞ্জ তার বড় ভাই শিশির চন্দ্রের বাড়ি । দেশ স্বাধীনের আগে তার বড় ভাই ভারতে চলে যাই। দেশ স্বাধীনের পরে তার পরিবারের লোকজন এবং সে ভিসা পাসপোর্ট ছাঢ়া খুব সহজে যাতায়াত করতে পারেনা । তাই ভাই ও ভাইয়ের ছেলে-মেয়েদের সাথে দেখা করতে প্রতিবছর এই মেলায় আসে ।

এছাড়াও দিনাজপুরের জ্যাতিষ চন্দ্র রায়ের সাথে কথা হয়, জ্যাতিষ চন্দ্র রায় (৫০) বলেন লোক মুখে শুনে আসছি এই মেলার কথা তাই এবার নিজে দেখতে এসেছি ভারতের উত্তর দিনাজপুরে আমার বোন জামাই থাকেন তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে তবে এখনো কারো সাথে দেখা করতে পারিনি। র

সুলপুরের মুর্তজা (৫৫) জানান, মালদা'র কালিয়াচোখ থানাই ভাগিনা আশরাফ আলী (৩৫) থাকেন দেশ স্বানীদের আগে আমার বোনের ভারতে বিয়ে হয়েছে বোনের শশুরবাড়িতে যাওয়া হয় না তাই এখানে এসেছি সবার সাথে দেখা করতে।

সেতাবগঞ্জের বিমল, রঞ্জন, দীপু, সঞ্জয়, পীরগঞ্জের রাজু, শাহাআলম, ঠাকুরগাঁওয়ের অনিল, গনেশ, পুলক, মধু, পঞ্চগরের বিনয় চন্দ্র, মহেশ চন্দ্র, গীতা রানী, দেবীগঞ্জের শ্যামলী'সহ তারা জানান ভারতে বসবাসরত আত্বীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতেই এ মেলায় এসেছে এবং এই দিনটির জন্য প্রতিবছর তারা উপেক্ষা করে বলে জানায়।

জামোরকালি জিউ মন্দির কমিটি সভাপতি ও পুজা উদজাপন কমিটি সভাপতি নগেন কুমার পাল বলেন, পাথর কালি পুজা ও দু'দেশের মানুষের মিলন মেলা দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই এই মেলা হয়ে আসছে, দেশ ভাগের পরে এই মেলার কারনে বছরে এই একটি দিনে দু'দেশের মানুষেরা নিজের আত্বীয়-স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে ।

উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন বাধা নেই সব ধরনের সহযোগীতা করবে তারা জানিয়েছে।

মেলাকে কেন্দ্র করে বিজিবি ও বিএসএফ এর পতাকা বৈঠক হয়েছে তারাও সব ধরনের সহযোগীতা করবে বলে জানিয়েছে । এটি এই অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য। তাছাড়া মানুষে মানুষে মিলন যে বাধা মানে না তার প্রামাণ্য দলিল এই মেলা ।

(কেএস/এসপি/ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯)