মানিক সরকার মানিক, রংপুর : রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত হলেও সামাজিকভাবে একটি সুখবর আছে পায়রাবন্দের। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের উদ্ঘাটিত সেই ‘মাকড়া বুড়ো’ চরিত্রের লোকজন এখন আর নেই পায়রাবন্দে। ‘মাকড়া বুড়ো’ তার ৮৪ বছর বয়সে একে একে বিয়ে করেছিলেন ১৯টি। ৮৪ বছর বয়সে সবশেষ যে মেয়েটিকে তিনি বিয়ে করেছিলেন, তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। তার সঙ্গে সংসারও করেছেন তিনি। আগে এসব কিছুই সম্ভব ছিল শুধুমাত্র অশিক্ষা কুশিক্ষা আর অসচেতনতার কারণেই। কিন্তু এখন সে চিত্র আর নেই পায়রাবন্দে। পাল্টে গেছে পুরোটাই। মাত্র ক’ বছর আগেও যে পায়রাবন্দের নারীরা অনেকটাই ছিল ‘অবরোধ বাসিনী’, অনেকেই ঘর হতে বের হওয়া কিংবা স্কুল কলেজে যেতে বাধার সম্মুক্ষিন হতো, অনুষ্ঠান কিংবা নাটক করা যাদের কিছু ছিল দু:স্বপ্ন আর দু:সাহসের মত, সেই পায়রাবন্দের নারীরাই আজ পাল্টে ফেলেছে সেখানকার সামাজিক চিত্র।

অবাক করার মত ব্যাপার, কয়েক বছর আগেও পায়রাবন্দের ঘর ঘর থেকে তো বের হতেনই না। কেউ কেউ আবার রিকশায় উঠলে রিকশার চতুর্দিক শাড়ি কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে নিতেন। যাতে পুরুষরা তাদের না দেখেন। সেই নারীদেরই আজ ঘর থেকে বের কওে এনে কাজে লাগাচ্ছেন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলো। পায়রাবন্দে ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে তারা। গাঁয়ের অশিক্ষিত নারীদের করে তুলছেন সচেতন। গোটা পায়রাবন্দ ঘুরেও এখন আর একটি মাকড়া বুড়ো কিংবা ১৪ বছরের মেয়ের বিয়ে দেখতে পাওয়া যাবে না।

যে পায়রাবন্দে এক সময় রোকেয়ার অনুষ্ঠান করতে গেলে মঞ্চ থেকে মাইক হারমোনিয়াম নামিয়ে নেয়া হতো, সেই পায়রাবন্দের মেয়েরাই এখন নাটকের দল গঠন করে নিয়মিত নাটক, গান বাজনা করছে।
মা ভিক্ষা করে কিংবা অন্যের বাসায় ঝি এর কাজ কিংবা রিকশা চালায় বাবা, সেইসব পরিবারের সন্তানেরাও এখন স্থানীয় স্কুল কলেজ ছাড়াও লেখাপড়া করছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বপ্ন বুনছে তারা চিকিৎসক ইঞ্জিনিয়ার পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়ারও।

পায়রাবন্দের এক ভিক্ষুকের পরিবারের মেয়ে দেশে লেখাপড়া শেষ করে বেলজিয়ামে ফেলোশীফ শেষ করে দেশে এখন বড় চাকরি করছেন। বেগম রোকেয়া স্মৃতি ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী প্রতিবন্ধী কুমারী দুলালী রানী মহন্ত যার দুটো পা নেই। কামড়ে ভর করে হেঁটে স্কুল কলেজ যেত। জানালেন, তার বাবা ঢাকায় রিকশা চালান। তার বাড়ি থেকে কলেজের দুরত্ম প্রায় ৬ কিলোমিটার। সে এক কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এসে পরে রিকশা কিংবা ভ্যানে করে কলেজে আসে শুধুমাত্র উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়নে। দু’বছর আগে তার এই সংবাদ মিডিয়ায় প্রকাশ পেলে ঢাকা থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি তার জন্য একটি হুইল চেয়ার কিনে দেন এবং পড়াশোনার জন্য প্রতিমাসে কিছু আর্থিক সহায়তা করে থাকেন।

জাফরগঞ্জ গ্রামের মৃত সামসুলের স্ত্রী উম্মে হাবিবা জানালেন, তিনি অন্যের বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন। কাজ না পেলে কখনো ভিক্ষা করেন। কিন্তু তারপরও তার চার ছেলেমেয়েকে তিনি নিয়মিত স্কুল কলেজে ধরে রেখেছেন। তার বড় মেয়ে এবার মাষ্টার্সে পড়ছে। তাদের মত অনেকেই এখন শিক্ষা এবং কর্মে স্বাবলম্বী হতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে শুধুমাত্র নারীদের জন্য পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি ডিগ্রি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও সেখানে এখন মেয়ে ছেলেরা এখন একই সঙ্গে লেখা পড়া করছে।

শুধু লেখাপড়া নয়, সেখানকার নারীরা এখন মাটি কাটছে, কাজ করছে মাঠে ঘাটে। সোনা ফলাচ্ছে ফসলের জমিতে। কেউবা আবার দায়িত্ব পালন করছে সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানেও। এর বাইরে নিজেদের স্বাবলম্বী করতে কেউ কেউ একক এবং দলীয়ভাবেও হস্ত ও কুটির শিল্প গড়ে তুলেছেন। এখানকার নারীরা স্বশিক্ষিত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন গার্মেন্টসে কাজ করার পাশাপাশি দেশে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে অনেকেই। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রাও ঘরে আনছে এক সময়কার পশ্চাদপদ পায়রাবন্দের এই মেয়েরা। শুধু তাই নয়, ঝড়ে পড়া কিংবা পিছিয়ে থাকা দরিদ্র পরিবারের সন্তানদেরও ছেড়ে দিতে রাজি নন সেখানকার উদ্যোগী নারী পুরুষরা।

পদযাত্রা নামের স্থানীয় একটি সংগঠনের পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন মিলন জানালেন, এসব শিশুদের জন্য তারা বিনা খরচে প্রতিদিন নিয়মিত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। বাড়ির উঠোনে অক্ষর জ্ঞান দেয়া হচ্ছে পিছিয়ে থাকা এসব শিশুদের।

মিলন জানালেন, অক্ষর জ্ঞান নয়, এলাকার বিভিন্ন পরিবারে গিয়ে তারা বাল্য বিয়ে রোধ এবং যৌতুক প্রথা বন্ধের জন্যও কাজ করছেন। যে কারণে বন্ধ হয়েছে যৌতুক আর বাল্য কিংবা অসম বিয়ে।

এলাকাবাসী মনে করেন, রোকেয়ার স্বপ্ন পুরণে এখানকার নারীরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন তাতে আগামীতে তারা এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

(এম/এসপি/ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯)