রণেশ মৈত্র


১৯৭১ সাল। তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মতো পাবনা জেলাও উত্তাল গণআন্দোলনে উত্তপ্ত। ১ লা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। তাঁরই ৭ ই মার্চের স্বাধীনতার প্রত্যয়সূচক ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিজাতি স্বাধীনতার দাবিতে উচ্চকিত। পাবনা শহরসহ গোটা জেলা আন্দোলনে মুখরিত। মূল দাবিটি ছিল ১৯৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত দল আওয়ামীলীগের হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর। আর দাবি ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার, ৬-দফা, ১১-দফা দাবি পরিপূরণ, রাজবন্দিদের মুক্তি ইত্যাদি।

প্রবল এই আন্দোলনের সাথে সাথে পাবনাতে একটি দুঃখজনক ঘটনাও চলছিল। তা হলো আওয়ামীলীগের এবং ছাত্রলীগের সাথে মতিন-আলাউদ্দিন-টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নিত্য-নিয়ত সশস্ত্র সংঘাত। এতেও রক্ত ঝরছিল প্রাণহানি ঘটছিল। তাই একদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, যা পাকিস্তানী সামরিকচক্র ইয়াহিয়া গংদের শাসনের বিরুদ্ধে, অপরদিকে উগ্র বামপন্থীদের সাথে সশস্ত্র আত্মঘাতী সংঘাত। ওয়ালী খানের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামীলী পার্টি (মোজাফফর ন্যাপ), প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জন, নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামীলীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ৬-দফা, ১১-দফার আশু দাবি এবং সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের দাবিতে আন্দোলন।

পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পাটির্, যা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নামে মুক্তিযুদ্ধকালে আত্মপ্রকাশ করেছিল, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক দীর্ঘকাল নিষিদ্ধ। কমিউনিস্ট পার্টির কিছু অংশ তাই ছিলেন আত্মগোপনে এবং অনেকেই ন্যাপের অভ্যন্তরে কর্মরত। দুটি শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ছিল ঐ প্রবল জাতীয়তাবাদী স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান শক্তি। প্রতিনিয়ত মিছিলে মিছিলে আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়ন পাবনাকে প্রকম্পিত করে রেখেছিল। শুধু ৭০-এর নির্বাচনেই নয়, ভাষা আন্দোলনের সূচনায়, অর্থাৎ ১৯৪৮ সাল থেকেই পাবনা ছিল জনগণের প্রত্যক্ষ ও বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণমুখর।

৬-দফা, ১১-দফা আন্দোলনসহ স্বাধিকার ও অসহযোগ আন্দোলনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষিত হয়। এ সকল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত অর্থেই জনতার ঐক্য গড়ে ওঠে। ইয়াহিয়া সরকারের চক্রান্তের মুখে এবং নানা স্থানে পুলিশ মিলিটারির গুলিতে ছাত্র-যুবক হত্যার প্রতিবাদে এ-আন্দোলন পাবনাতেও ক্রমশই জঙ্গীরূপ ধারণ করে। এই পটভূমিতে আসে ২৫ শে মার্চের বিভীষিকাময় রাত। ঐ রাতে পাবনা শহরে এসে পৌঁছায় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী সৈন্য। গভীর রাতে যখন পুরো শহরের মানুষ নিদ্রামগ্ন তখন গোপনে তারা পাবনা শহরে ঢুকে পড়ে বর্তমান বিসিক শিল্পনগরীতে প্রধান ঘাটি স্থাপন করে এবং রণকৌশল অনুযায়ী পাবনার পুরাতন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনও দখল করে নেয়।

স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের বিন্দুমাত্র সহযোগিতা না পেয়ে তারা নিজেরাই মাইক ভাড়া করে ভোর থেকে পাবনা শহরে কারফিউ জারীর ঘোষণা দেয়। ঘোষণায় মানুষের ঘুম ভেঙে গেলে ঘটনা জেনে সাময়িকভাবে হতচকিত হয়ে পড়ে। বাঙালিরা দ্রুত সংঘটিত হয় এবং বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। নেতৃত্বের নির্দেশের অপেক্ষায় কারফিউ এবং কোনো ঘোর অনিশ্চয়তাজনিত কারণে নিজ নিজ গৃহেই অবস্থানে বাধ্য হয়। বলা প্রয়োজন ১ লা মার্চ থেকেই সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলনের ফলে লাগাতার হরতাল এমনিতেই চলছিল অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সারা পাবনা জেলায়।

ঢাকা থেকে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যের কিছু পরেই একটি জরুরী বার্তা পেয়ে পাবনার আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব সামরিক বাহিনী পাবনা অভিযানে রওয়ানা হয়েছে জানতে পেরে দ্রুত পরস্পর পরস্পরকে জানিয়ে শহরের দক্ষিণে পদ্মার চরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। তদানীন্তন জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান গোটা প্রশাসনকে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার, অফিস আদালত বন্ধ রাখার এবং পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সকল নির্দেশ অমান্য করার লক্ষ্যে এস.পি সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে নিজ বাংলো ত্যাগ করে নিকটবর্তী এক গোপন আশ্রয়ে চলে যান। সামরিক টিমের সাথে কোনোপ্রকার সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন। এতে প্রতিরোধ কর্মকাণ্ড নতুনমাত্রা অর্জন করে।

বলাবাহুল্য তিনি আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে গভীর সম্পর্ক রেখে চলছিলেন। এক রাত অন্যত্র থেকে তিনিও প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডে সমন্বয় সাধনের এবং কার্যকর পরিকল্পনা সমন্বিতভাবে গ্রহণের লক্ষ্যে চরে আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে একই আশ্রয়ে চলে যান। সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন যে-সকল আওয়ামীলীগ নেতা তার মধ্যে গণপরিষদ সদস্য আমজাদ হোসেন। আব্দুর রব বগা মিয়া, ওয়াজিউদ্দিন খান, ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা, ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল এবং কিছুসংখ্যক আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। অপর পক্ষে শহরে চলছিল কারফিউ।

লোকে বাইরে বেরুচ্ছে না। তবুও যারা প্রাতঃভ্রমণে অভ্যস্ত অথবা কাঁচা বাজার করার জরুরী প্রয়োজনে অথবা কারফিউ-এর খবর না জেনে বেরিয়েছেন রাস্তায়, তাদের অনেককেই রাস্তা থেকে ধরে কোমরে দড়ি বেঁধে বিসিক সামরিক হেড কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালান হয়। অপরপক্ষে তরুণেরা দ্রুত গতিতে সংগঠিত হতে থাকে। তারা গোপনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বন্ধুক, পিস্তল ইত্যাদি সংগ্রহ করে। এগুলি সবই ঐ চরে নিয়ে জমা করা হয় প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতি হিসেবে। অফিস আদালত জনশূন্য। থানাতেও পুলিশ নেই। গোটা পাবনা শহর থমথমে।

২৬ শে মার্চের সন্ধ্যা। ভুতুরে পরিবেশে অনিশ্চয়তা, ভীতি, ক্ষোভ সবই জমছে মানুষের বুকে। পাকসেনারা শহরে টহলে বেরিয়েছে। বাজারের নাইট গার্ড ছিল অবাঙালি কাবুলি। তাদেরকে সাথে নিয়ে শহরের নেতৃস্থানীয়দের বাড়ি চিনে নিয়ে হানা দিল হানাদার বাহিনী। গ্রেফতার করল মহকুমা আওয়ামীলীগ সভাপতি পাবনা বারের সম্পাদক, পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান জনাব আমিনুদ্দিন এমপিএ-কে। আরও গ্রেফতার হলেন ভাসানী ন্যাপ নেতা দন্ত চিকিৎসক অমলেন্দু দাক্ষী, মোটর মালিক ও হোটেল ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার এবং মস্তিষ্ক বিকৃত রাজেন। তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় বিসিক শিল্পনগরীতে।

সেখানে আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালান হয় তাঁদের ওপর। মিলিটারিরা ট্রাক বোঝাই হয়ে পুলিশ লাইনে গিয়ে পুলিশকে সারেন্ডার করতে বলে একই দিন সন্ধ্যায়। না, তাঁরা তা করেন নি। ঐ রাতে হাই কমান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চর এলাকাগুলোতে হাজার হাজার কৃষকের মধ্যে চলে প্রতিরোধের প্রস্তুতি। কৃষকেরা প্রতিরোধ আহ্বানে সাড়া দিলেন অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে। চরে বাড়িতে বাড়িতে প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু হয়। সংগৃহীত হয় অস্ত্রশস্ত্র ; যার মধ্যে একনলা, দোনালা বন্দুক, পিস্তল, লাঠি, ফালা, সড়কি এই জাতীয় অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় পাবনা শহরে এক ঐতিহাসিক যুদ্ধের অবতারণা হল। মাগরেবের নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই পাকসেনাদের ট্রাকগুলো বিপুল অস্ত্রসম্ভার ও সেনাসদস্যসহ বিসিক থেকে আসতে থাকল পাবনা পুলিশ লাইনের দিকে। লক্ষ্য পুলিশ লাইনের ম্যাগাজিন থেকে অস্ত্র নিয়ে নেওয়া। পুলিশ বাহিনীকে নিরস্ত্র করা। এমন একটা কিছু ঘটতে পারে, পুলিশবাহিনী তা আগে থেকেই আঁচ করছিল প্রস্তুতিও নিয়োছিল সে-আক্রমণ প্রতিরোধের। জজকোর্টের সামনে এসে পড়ার পরপরই মিলিটারির ট্রাকগুলো আক্রান্ত হয়।

পুলিশেরা রেজিস্ট্রি অফিস, জজকোর্ট, পুলিশ লাইন, প্রধান ডাকঘর, জেলখানা প্রভৃতি ভবনের ছাদে অবস্থান নিয়েছিল এবং তারাই অতর্কিত সেনাবাহিনীকে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে। শুরু হয় ভয়াবহ যুদ্ধ ; যা প্রায় আধ ঘন্টা ধরে চলে। এমন প্রতিারোধের মুখে পড়তে হবে, পাকসেনারা তা কল্পনাও করেনি। নানা অস্ত্রের ভয়ঙ্কর শব্দে সারা শহর কাঁপছিল। অবশেষে গোলাগুলির অবসান হয়। পাকসেনারা পালিয়ে যায়। এক অভূতপূর্ব বিজয় সূচিত হয় পুলিশের। অস্ত্রগারও রক্ষা পায়। পুলিশ লাইন এবং তার আশপাশের দালানগুলি গুলির অজস্র ছোট বড় ছিদ্র বহুদিন এই যুদ্ধের স্বাক্ষর বহন করেছিল। ভয়ে সারা শহর কাঁপছিল। আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল সবার মনে। সে-রাত কেউ ঘুমায় নি। কখন কি হয়, কে জানে। খবর ছড়িয়ে পড়ল বিদ্যুৎ-গতিতে। যুদ্ধের খবর। বিজয়ের খবর। পাবনা পুলিশের গৌরবের খবর। খবর পৌঁছে যায় চরেও ; যে-চর হয়ে উঠেছিল তখন প্রতিরোধযুদ্ধের যাবতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের কেন্দ্রভূমিতে। সিদ্ধান্ত হয়, পরদিন ভোরে জনতাই আক্রমণ করবে অর্থাৎ ঘেরাও করে ফেলবে মিলিটারির সব কয়টি অবস্থানকে।

২৮শে মার্চ ভোর। সমগ্র চর থেকে হাজার দশেক কৃষক “জয় বাংলা” শ্লোগানে মুখরিত হয়ে এবং লাঠি, ফালা, সড়কি ও বন্দুক নিয়ে ঘেরাও করে ফেলল বিসিক শিল্পনগরীকে। পাবনার পুরাতন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনটিকে এবং লস্করপুরের একটি সাদা দালানে পাবনা নগরবাড়ী মহাসড়ক পাহারার কাজে অবস্থানরত চার সদস্যবিশিষ্ট অস্ত্রসজ্জিত পাক সেনাদলকে। শহর ও গ্রামের আরও হাজার হাজার মানুষ লাঠি, ফালা ও সড়কি নিয়ে মাথায় বা কোমরে গামছা বেঁধে “জয় বাংলা” শ্লোগানে দিগি¦দিক প্রকম্পিত করে তুলতে থাকে। ছাত্র-যুবক, পুলিশ সম্মিলিতভাবে আগের সন্ধ্যার মতো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের চারপার্শ্বের সজ্জিত পাক সেনাদেরকে ঘিরে ফেলে। হতচকিত হয়ে তারাও পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলি বর্ষণে সারা শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। কয়েক ঘন্টার যুদ্ধে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবস্থানরত সৈন্যদলের সকলেই নিহত হয়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

বিশাল বিজয়। ঐ লাশগুলি দেখার জন্য দূর-দূরন্ত থেকে মানুষের ভিড় জমে। তারা ঘৃণায় লাথি মারে, থু থু দেয় পাকসেনাদের লাশগুলির প্রতি। মাত্র ১৫/১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে এই দুটি বিশাল বিজয় জনমনে, মুক্তিযোদ্ধাদের মনে এক বিরাট আত্মপ্রত্যয় ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। সুসজ্জিত পাকবাহিনী হেরে যাচ্ছে ভেতো এবং নিরস্ত্র বাঙালির কাছে। এ কী কম কথা। তখনও ঘেরাও হয়ে আছে বিসিক শিল্পনগরীর সেনা হেডকোয়ার্টার। পাকসেনারা জিম্মি হয়ে আছে। কিন্তু আক্রমণ করা যাচ্ছে না। একে তারা দালানের ভেতরে অপরদিকে তাদের হাতে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসম্ভার। জনগণ তাদের বেরোতে দেবে না। আগের রাত থেকে এই অবস্থা চলছে। পরদিন ২৮শে মার্চ, সারাদিন সারারাত পাকসেনা সেখানে অবরুদ্ধ।

অপরদিকে লস্করপুর। এখানেও ২৮শে মার্চ মহাসড়ক পাহারারত ৪ জন পাকসেনা অপর এক দালান আবদ্ধ। অবরুদ্ধ হাজার হাজার মানুষ দ্বারা। এক পর্যায়ে তারা বেরিয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকে। চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। এই চারজন হলেন শামসুল আলম বুলবুল, আমিরুল ইসলাম ফুনু, মুকুল ও ভাটা শ্রমিক আফসার। মানুষ এই অতর্কিত সেনা হামলায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সৈন্যরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ছুটতে থাকে। অবশেষে তারা পৌঁছায় অচেনা পথে, মালঞ্চি ইউনিয়নে। তারা ভীত, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ও পিপাসার্ত। খাবার পানি চাইলে মানুষ তাদের পানি দেয়, কিন্তু একে একে তাদেরকে হত্যা করে। এভাবেই ৩২ জন পাকসেনা ইতোমধ্যে নিহত হয়।

২৯শে মার্চ সকাল ১০টার দিকে পাবনার আকাশে হঠাৎ বিমান উড়তে দেখা গেল। বিমান এসেছে দেখে অনভিজ্ঞ কিন্তু শত্র“ নিধনে প্রত্যয়ী যুবকেরা বিমানটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে আকাশের দিকে। কিন্তু ইতিমধ্যেই বিমান থেকেই গুলি ছোড়া হচ্ছেAir-Straffing করছে। ফলে বিসিক এলাকায় হাজার হাজার মানুষের অবরোধব্যুহ ভেঙ্গে পড়ে। দেখা গেল হেমায়েতপুরের দিক থেকে সাদা পোষাকে সাদা পতাকা নিয়ে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে ১১টি ট্রাক এসে থামলো। আসলে এইভাবে তারাCamouflage বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেAir-Cover দিয়ে অবরুদ্ধ পাক সেনাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত করেছিলো। দ্রুত অবরুদ্ধ সৈন্যদের ঐ ট্রাকে উঠে পড়ে। কিন্তু উঠবার আগে আটককৃত বাঙালীদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে।

অবরুদ্ধ আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট আমিনুদ্দিন এমপিএ, ন্যাপ ভাষানী নেতা ডা. অমলেন্দু দাক্ষী, ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার ও পাগলা রাজেনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁরা শহীদ হন। একই সাথে আটক পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীর সহকারী গ্রন্থাগারিক ও পৌর কর্মচারী আব্দুল খালেক শুয়ে পড়েন এবং মৃত্যুর ভান করে থাকেন। যাবার আগে খালেক ভাইকে তারা দেখে যায় মরেছে কিনা। খালেক ভাই ও অন্যান্যরা মৃত বলে ধারণা জন্মালে তারা ও স্থান ত্যাগ করে রাজশাহীর গোপালপুর অভিমুখে রওনা হয় সর্বমোট ১১টি ট্রাকে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে।

ইতিমধ্যে হেমায়েতপুরের চরের হাজার হাজার মানুষ, ঈশ্বরদী পাকশী, রূপপুর অঞ্চলের আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে অসংখ্য যুবক একই ধরনের অস্ত্র ও হাতবোমা ইত্যাদি নিয়ে পলায়ন পর পাক বাহিনীর সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হয় মাধপুর নামক স্থানে। সে এক অসম কিন্তু দুঃসাহসিক যুদ্ধ। পাক সেনারা বেপরোয়া ভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকে জনতার গুলির জবাবে। মাধপুরের বিশাল বটগাছ ছিল ঐ রণক্ষেত্রের কেন্দ্রভূমি।

ঐ গাছে ঈশ্বরদীর ছাত্রলীগ নেতা রাজু এবং সাহাপুরের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী ওহিদ শহীদ হন। এদের ছোঁড়া ককটেলে মিলিটারীর জীপে আগুন ধরে যায় বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনা এখানে নিহত হয়। ঐ লাশগুলিকে ট্রাকে তুলে নিয়ে আমি কনভয় পাশের গ্রামগুলিতে অগ্নিসংযোগ করতে করতে মেশিন গানের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে অগ্রসর হতে থাকে। এখানে ঐ দু ছাত্র নেতা ছাড়াও আরও তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, নাম রাজ্জাক, গফুর ও নবাব।

পলায়নপর পাকসেনারা অতঃপর দাশুরিয়ার পৌঁছালে সেখানেও তারা বীর জনতা কর্তৃক অনুরূপভাবে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এ সকল স্থানেই বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। এভাবে তারা পুনরায় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় মুলাডুলিতে। এখানেও তাদের কিছু প্রাণহানী ঘটে। আক্ষরিক অর্থেই বলা চলে, পলায়নপর পাক সেনাদের তাড়িয়ে মারছিলো বীর বাঙালী জনতা।

প্রাণহানী উভয় দিকে ঘটলেও জনতার পক্ষের মৃত্যু তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। এভাবেই পাকবাহিনীর যে দুশো জন পাবনা এসেছিলো পলায়নপর অবস্থায় যেতে সর্বত্রই তারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় এবং তাদের গন্তব্যস্থল গোপালপুর পৌছে যেতে যেতে একজন পাকসেনাও আর অবশিষ্ট থাকে না। তারা সবাই ইতোমধ্যে নিহত হয়েছে। পাবনা মুক্ত হয় এভাবেই ২৯ মার্চ। এভাবে যুদ্ধ করে গোটা সেনা বাহিনীর সকল সদস্যকে নিহত করে একটি জেলা শহর মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সারা দেশের মধ্যেই পাবনাই প্রথম। এ এক বিশাল গৌরব।

এ গৌরবের দাবীদার পাবনার জনগণ, অসংখ্য কৃষক, যুবক, ছাত্র, পুলিশ, আনসার, জেলা প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ, সবাই। বস্তুতঃ ঐক্য এবং নিষ্ঠা ও প্রত্যয়ই যে সাফল্যের জন্য জাতীয় জীবনে অপরিহার্য তা সেদিন পাবনার বুকে প্রতিভাত হয়ে উঠেছিল। গোটা ৭১ সালও জাতীয় একই ভাবে সত্যকে প্রমাণিত করেছে।

পরদিন ৩০ শে মার্চ পাবনার স্বাধীন প্রশাসন দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। একদিকে পাকবাহিনীর সম্ভাব্য দ্বিতীয় দফা আক্রমণ প্রতিরোধ এবং অপরদিকে জনজীবনের শৃঙ্খলা রক্ষা এবং যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষন ও তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করাই ছিল ঐ প্রশাসনের জরুরী দায়িত্ব। কিন্তু প্রশাসন ঢাকা বা কোন কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ বিহীন। নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরকেই নিতে হচ্ছে বাস্তবায়নও তাই। হাই কম্যান্ডের নেতৃত্বাধীন এই প্রশাসন। কিন্তু হাই কম্যান্ডও নেহায়েতই স্থানীয় তার কোন কেন্দ্রীয় যোগাযোগ নেই। সারা বাংলাদেশই এখন একের সাথে অপরের যোগাযোগ বিহীন।

২৯শে মার্চের বিমান থেকে অজস্র গোলা বর্ষণের পর শহরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কখন বা দ্বিতীয় হামলা হয় এই আশঙ্কা সবার মনে। তাই নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষ ছুটলো নিরাপত্তার সন্ধানে যে যেভাবে ছিল সেই অবস্থায়ই গ্রামের দিকে অনিশ্চিত সে যাত্রা। শহরের চতুর্দিকে মানুষ ছুটছে। প্রায় সবাই ছুটছে হেঁটে, অতি লঘু সংখ্যা রিক্সায়। দেখা গেল রাস্তার দুধারে লোক বসে আছে গ্রামের লোক চিড়া, মুড়ি, দুধ, কলা ইত্যাদি নিয়ে শহরের অভূক্ত মানুষদের জন্যে। কেউ কিছু দাম দিলে দিচ্ছে না দিলেও কোন কথা নেই। দাম তারা চাইছেও না। বেশীর ভাগ লোকই দাম দিচ্ছেও না বা অপ্রয়োজনে কেউ কিছু নিচ্ছেও না। কে হিন্দু কে মুসলিম তাও কেউ ভাবছে না।

কি যাত্রীরা, কি খাদ্য সবরাহকারীরা কেউই না। গ্রামে নিয়ে কেউ বা চেনা কেউ অচেনা লোকের বাড়ীতে নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। সদর আশ্রয় পাচ্ছেন। মহিলারা এক ঘরে পুরুষেরা অন্য ঘরে। গ্রামের লোকেরা খাওয়াচ্ছে দিনের পর দিন। আবার তারা খাবার পাঠাচ্ছে শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য, অনবদ্য এক অভিজ্ঞতা। সেই ঐক্য মানবিক ঐক্য। সে দরদ মানবিক দরদ একে অপরকে বিশ্বাস করার, কাছে টেনে নেওয়ার পরস্পর পরস্পরকে আপন করে নেওয়ার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হল মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে।

স্বাধীন পাবনার প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিলেন দ্বিতীয় দফা হামলা প্রতিরোধ করা যেহেতু অত্যন্ত দুরহ কাজ, তাই ভারী অস্ত্র এবং প্রশিক্ষকের বড্ড বেশী প্রয়োজন। পাবনা যেহেতু সীমান্ত সংলগ্ন জেলা নয় তাই এখানে কোন ইপি আর ছিল না। তাই অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের জন্যে পুলিশ ও আনসারদের উপরই শুধু নির্ভর করতে হলো। দ্রুতই গ্রামে গ্রামে এঁদের মাধ্যমে যুবকদের অস্ত্রাচালনা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হলো। উল্লেখ্য ২৮ মার্চেই পাবনা জেলা কারাগার থেকে সকলকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ ও জেলা পুলিশের অস্ত্রাগার এবং আদালতের মালখানা থেকে অস্ত্র, ছাত্র নেতাদের মাধ্যমে যুবকদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই যাবতীয় অস্ত্র একত্রিত করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম। কিন্তু পাকবাহিনীর সম্ভাব্য দ্বিতীয় দফা সুসজ্জিত আক্রমণ প্রতিরোধের মত যথেষ্ট ক্ষমতা তো নেই। একদিকে পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহ থেকে ইপিআর নিয়ে আসা এবং অপরদিকে ভারী অস্ত্র ও প্রশিক্ষক সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে ভেবে পাবনার হাই কমান্ড অনুভব করলেন ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন এবং সে কারণে আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট আমজাদ হোসেন এবং ন্যাপ নেতা (বর্তমান গণফোরাম নেতা) এডভোকেট রণেশ মৈত্রকে ভারী অস্ত্র ও প্রশিক্ষক সংগ্রহের জন্য কোলকাতা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

২ রা এপ্রিল ভোরে তাঁরা উভয়েই কোলকাতা রওনা হয়ে যান। সঙ্গে কুষ্টিয়ার আওয়ামীলীগ নেতা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী আলী রেজাকে ঐ দুই সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের গাইড হিসাবে দেওয়া হয়। কয়েক বছর আগে আলী রেজা পরলোক গমন করেছেন। ইতোমধ্যে ৩০ শে মার্চেই পাবনার সাবেক টেকনিক্যাল ইনস্টিউিট (বর্তমানের ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের দ্বিতলে পাবনার হাই কমান্ডের প্রশাসনিক অফিস হিসেবে চালু করা হয়। তদানীন্তন জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান এবং রাজনৈতিক ছাত্র নেতাদের মিলনক্ষেত্র তথ্য আদান-প্রদান এবং যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় নির্দেশসমূহ প্রদান করা হতো এই প্রশাসনিক কার্যালয় থেকেই।

তখন পাবনা জেলা আজকের চেয়ে বড় ছিল। পাবনা সদর ও সিরাজগঞ্জ এই দুটি মহকুমা মিলে এই জেলাটি গঠিত ছিলো। সে কারণে ঢাকা থেকে সৈন্য এই জেলায় ঢুকবার তিনটি পথ চিলো। এক. নগরবাড়ী ঘাট দিয়ে সড়ক পথে, দুই বিমানে ঈশ্বরদী বিমান বন্দর দিয়ে এবং তিন. সিরাজগঞ্জ ঘাট দিয়ে রেল পথে। তাই এই তিনটি পথ অবরোধ করার তীব্র প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সিরাজগঞ্জের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং মহকুমা প্রশাসক দায়িত্ব নিলেন।

সিরাজগঞ্জ ঘাটের, ঈশ্বরদীর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দেওয়া হলো বিমান বন্দরটিকে অকেজো করে দেওয়ার দায়িত্ব। পাবনা, সুজানগর, সাঁথিয়া ও বেড়ার ওপর মূলত পড়লো নগরবাড়ী ঘাট প্রতিরোধের দায়িত্ব। অপর গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশ পথ পাকশী দিয়ে রেলপথে তার দায়িত্ব ঈশ্বরদী ও কুষ্টিয়ার নেতৃবৃন্দের। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিল কারণ ময়মনসিংহের পতন তখনও ঘটেনি। সেখানে ভাল প্রতিরোধ থাকায় পাক-বাহিনী তখনও ঢুকেনি।

ঈশ্বরদীর নেতা ও কর্মীরা বিমানবন্দর পাহারা দিয়ে রেখেছেন দিনের পর দিন হাজার মানুষ নিয়ে। পাকশীর ওহিদুল ইসলাম (পেপার মিলেল একজন টেকনিক্যাল বিভাগের কর্মী এবং প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সাবেক কর্মী) কিছু বিশেষ ধরনের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরি করে আনেন এবং আর ও অনেকে শক্তিশালী বোমা প্রভৃতি তৈরী করে আনলে তা দিয়ে ঈশ্বরদী বিমানবন্দরের রানওয়েটি ধ্বংস করে দেওয়ার প্রচেষ্টা নেওয়া হয় বারংবার। কিন্তু বিমানবন্দরের শক্তিশালী রানওয়ে বিধ্বস্ত করার মত শক্তিশালী বিস্ফোরক সেগুলি ছিল না। এর জন্যে শক্তিশালী ডিনামাইটের প্রয়োজন ছিল কিন্তু তা সংগ্রত করতে না পারায় রানওয়ে ধ্বংস করতে পারা যায় নি। তবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো কিন্তু তাতে বিমান নামা-ওঠা অসম্ভব হয়ে ওঠেনি। তা করতে পারা না যাওয়ায় হাজার হাজার মানুষ নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশ আনসারসহ ঐ বিমানবন্দরটি দিনের পর দিন রাতের পর রাত পাহারা দেন।

কিন্তু বিমানবন্দর প্রহরায় পূর্ব থেকেই নিয়োজিত জনৈক ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ১৩ জন পাক-সেনা অবস্থান করছিলো। তারা গণহত্যার দায়িত্বে ছিল না। ১ এপ্রিল তাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। আটককৃত সেনাদের ৬ জনকে (পাঞ্জাবী) পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ সংলগ্ন পদ্মার তীরে নিয়ে হত্যা করা হয়। এদিকে মূল প্রতিরোধ ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় নগরবাড়ী ঘাট। নগরবাড়ী ঘাটের পতন গোটা উত্তরবঙ্গের জন্যেই ভয়াবহ। তাই সকল জেলাকেই আহ্বান জানানো হয় তাঁদের শক্তির একটি অংশ নগরবাড়ী পাঠাতে সকলে তাতে সম্মতও হন। উত্তরবঙ্গের প্রধান রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নগরবাড়ী ঘাট।

এদিকে মুক্ত পাবনার বিশাল দায়িত্ব ও নেতৃত্ব প্রদানরত অবস্থায় আওয়ামীলীগের শক্তিশালী সংগঠক, এম.এন.এ এবং অবিসংবাদী জননেতা জনাব আমজাদ হোসেন দিবারাত পরিশ্রম এবং নানা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় অতিরিক্তStrain এর মুখে স্ট্রোক হয়ে ৬ এপ্রিল পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে সমগ্র পাবনা জেলায় গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর শেষকৃত্যাদি এবং অন্যান্য কারণে নেতা-কর্মীদের দু’দিন ব্যস্ত থাকতে হয়। আকাশবাণী থেকে এই খবর প্রচার করা হলে আমিও আমজাদ ভাই (বিদেশে মিশনে ব্যস্ত থাকাবস্থায়) গভীর শোক ও বেদনায় যে রাতে ঘুমাতে পারিনি। তাঁর মৃত্যুতে পাবনার নেতৃত্বের শূন্যতা যত গভীরভাবে সৃষ্টি হয় তা বর্ণনায় আনা অসাধ্য। আজও আমরা সে শূন্যতা পূরণ করতে সক্ষম হই নি। এদিকে ব্যাপক উদ্যোগ আয়োজন নগরবাড়ী ঘাটে শুরু হয়ে যায়। ৭০/৮০ জন ই.পি আর বহু পুলিশ, আনসার এবং অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাসহ হাজার হাজার মানুষ নগরবাড়ী ঘাট পাহারা দিতে থাকে। আশপাশের অজস্র গ্রাম থেকে অসংখ্য বাড়ী থেকে ঐ প্রতিরোধ যোদ্ধারে খাবার সরবরাহ করা হতো নিয়মিত।

বহু ট্রেঞ্চও কাটা হয়। উদ্যোগ আয়োজন, উদ্বেগ উৎকন্ঠার, সাহস ও উদ্দীপনার শেস নেই। অপর পক্ষে পাক বাহিনীর প্রস্তুতির অন্ত ছিল না। সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ-বাহিনী সবই নিয়োজিত হয় নগরবাড়ী ঘাট দখলের জন্যে। বিমানে এসে তারা বাইনাকুলার দিয়ে সব দেখে যায় কয়েকবার।

মুক্তিযোদ্ধাদের বিমান লক্ষ্য করে গুলিও চালায় অনেক। কিন্তু তা লক্ষ্য ভেদে সমর্থ হয় না। আসে গান বোট ইত্যাদি। এভাবে খবর পাওয়া যায় যে, ৯ এপ্রিল পাকসেনারা আরিচা ঘাট থেকে রওনা হয়েছে। ফেরী, গান বোট, বিমান সবই একযোগে সাঁড়াশি আক্রমণ। তাদের প্রস্তুতি ও রসদের যথা অস্ত্র শস্ত্রের কাছে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শক্তি একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য হয়ে পড়ে। বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ শেল বর্ষণের মুখে প্রতিরোধব্যুহ ভেঙ্গে পড়ে। সবইRetreat করতে বাধ্য হয়। এপারে এসে অবশেষে নগরবাড়ীতে নামতে পেরে পাকবাহিনী প্রথম দফা পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার লক্ষ্যে বিপুল শক্তি নিয়ে ১০ এপ্রিল পাবনা শহর অভিমুখে রওনা হয়। শহর থেকে লোক পুনরায় হাজারে হাজারে গ্রামে চলে যান।

পাকবাহিনীর ট্রাক লরী ও ভারী অস্ত্র তাক করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এবং নগরবাড়ী থেকে পাবনা অবধি বাড়ী ঘর হাট বাজার মারাত্মকভাবে অগ্নিসংযোগ করতে করতে উম্মত্ত ও পশুতুল্য ধ্বংসলীলা চালাতে চালাতে পাবনা শহরে প্রবেম করে ১০ এপ্রিল দুপুরের দিকে রাস্তার দু ধারের অতগুলি গ্রাম, স্কুল কলেজ, হাট বাজারের অগণিত পৃহ ও সম্পদ আগুনে ভস্মীভূত হয়। গ্রামের মানুষেরা প্রাণবয়ে বাড়ী ঘর সহায় সম্পদ ছেড়ে নদীতে খালে বিরে, ঝোপে জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করে হাজারে হাজারে। পাক-সেনারা পাবনা পুনর্দখল করে। পাবনার দ্বিতীয় দফা পতন ঘটে।

স্বাধীন পাবনার প্রশাসন প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। শুরু হয় নতুন অধ্যায। সে অধ্যায় অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং পাকবাহিনীর নির্মমতায় অজস্র কাহিনীতে ভরা, সে কাহিনী অজস্র জীবনহানির, সে কাহিনী হত্যা, লুট-পাট, অপহরণ ও নারী ধর্ষণের কলঙ্কজনক কাহিনীতে পুর্ণ। বিস্তারিত তথ্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও সংগ্রহ করা যায় নি। তাছাড়া স্মরণিকার একটি স্মারক নিবন্ধে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরায় পরিসরও নেই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যারা আজও গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন; সমাজকর্মী, গবেষক, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং সমাজের সকল স্তরে পরিব্যাপ্ত উৎসাহী নর-নারীর সমন্বয়ে পাবনা জেলার সকল এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আগামীতে পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার বাসনা রইলো।

১০ এপ্রিল পাবনা শহরে ঢুকবার পর পাকবাহিনী আবারও বিসিক শিল্পনগরী ওয়াপদা কলোনী, ডাক-বাংলো, এডওয়ার্ড কলেজ প্রভৃতি স্থানে বিপুল সংখ্যায় অবস্থান নেয়। ভীতি সঞ্চারক সন্ত্রাসের পথ অবলম্বন করে অমানুষিক নির্যাতন ও হত্যা লীলা চালানো শুরু করে পাবনার সকল স্তরের মানুষের উপর। ১১ এপ্রিল পাবনা শহরের গোপালপুর এক বাড়ীতে তৎকালীন কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এডভোকেট শফিউদ্দিন, তাঁর পরিবার ও পাড়ায় কয়েকটি পরিবারের নারী পুরুষ (প্রায় ৪০ জন) আশ্রয় নিয়ে থাকা অবস্থায় টহলরত পাক-বাহিনী অতর্কিত সেখানে ঢুকে পড়লে বেশ কিছু লোক পাীলয়ে গেলেও যাঁরা সেখানে ছিলেন- তাঁদের মধ্যে নারী পুরুষ নির্বিশেষে, একটি লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করলে ২০/২৫ জন শহীদ হন। এর মধ্যে এডভোকেট শফিউদ্দিন অন্যতম।

শহীদদের কয়েকজনকে একত্রে গোপালপুরেই একটি কবর কেটে সমাধিস্থ করা হয়। ঐ গণকবরটি পরে বাঁধানো হয়। একই দিন পুলিশ লাইনে কর্তব্যরত তৌহিদ পাক-বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন বলে জানা যায়। সমস্ত পাবনা শহর নিকটবর্তী হেমায়েতপুর ইউনিয়ন, মালঞ্চি ও মালিগাছা ইউনিয়ন, টেবুনিয়া দাশুড়িয়া প্রভৃতি এলাকায় পাকবাহিনী নারকীয় তাণ্ডব চালায়। তবে সর্বত্রই তারা কম বেশী প্রতিরোধের ও সম্মুখীন হয়। ফলে তাদের হিংস্রতার মাত্রাও সকল সীমা অতিক্রম করে যায়। নগরবাড়ী ঘাটের পতনের পর পরই পাবনার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জেলা প্রশাসক এবং ছাত্র ও যুব কর্মীরা একদিকে আত্মরক্ষা ও অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং সে অনুযায়ী কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন পথে ভারতের পশ্চিম বাংলায় গমন করেন। এবার আসে পাকাহিনীর ঈশ্বরদী দখলের পালা।

১১ এপ্রিল বিকেল নাগাদ ঈশ্বরদী শহর ও আশপাশের এলাকা বাঙালি শূন্য হয়ে পড়ে। হাজার হাজার অবাঙালি তখন রেলওয়েতে চাকুরির সুবাদে এই এলাকায় বাস করতো। পাকবাহিনীর আগমন বার্তায় তারা উল্লাস প্রকাশ করে। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পাকশীর বাঙালি তারুণরা। তারা পাকশী ত্যাগের পূর্বে প্রায় ৫০০ অবাঙালিকে ধরে বর্তমান পাকশী কলেজের মাঠ এলাকায় হত্যা করে। অতঃপর ওখানকার বাঙালিরাও পদ্মা পার হয়ে অথবা পদ্মা নদী দিয়ে কেউ বা কুষ্টিয়া জেলার নানা অঞ্চলে কেউ বা পশ্চিমবঙ্গে চলে যান।

এরপর পাকবাহিনীর ঈশ্বরদী, পাকশী পেপার মিল, পাকশী রেলস্টেশন, পাকশী হার্ডিজ ব্রীজ এলাকায় মজবুত অবস্থান তৈরি করে পাকসেনারা। অসম্ভব দ্রুততার সাথে পাকবাহিনী গোটা পাবনা জেলায় তাদের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করে। সিরাজগঞ্জেরও পতন ঘটে। এরপর তারা বাঙালিদের মধ্যে তাদের দোসর খুঁজে পায়। ধীরে ধীরে শান্তিকমিটি গঠিত হয় জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত। জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ দল হিসেবেই তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে।

কিন্তু গোটা এপ্রিল মাস ধরেই চলতে থাকে বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলো সাঁথিয়া থানার পাইকরহাটি ডাব বাগানের যুদ্ধ। এখানে ১৯ এপ্রিল দুপুর প্রায় একটার দিকে ১৭ খানা জীপ ও পিক আপ ভ্যানে অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাশিনাথপুর থেকে বগুড়ার দিকে রওনা হয়। তখন বেড়া অভিমুখী রাস্তায় পশ্চিম দিকের এলাকায় দুদিক থেকে ট্রেঞ্চে ও নানা বাড়িতে পূর্ব থেকে লুকিয়ে থাকা ইপিআর ও ছাত্র-যুবকেরা ঐ কনভয়কে দুদিক থেকে আক্রমণ করে। দুটি মিলিটারী ট্রাকে আগুন ধরে যায়। সেগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। প্রায় ৬০-৭০ জন পাকসেনা নিহত হয়। যুদ্ধটি অসম হওয়াতে পাক-সেনাদের ভয়াবহ আক্রমণে ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা (ইপিআর) ও তরুণ যুবক ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন।

শহীদদের মধ্যে ১৭ জন ইপিআর বাহিনীর সদস্য। অন্যান্যরা তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী। এই যুদ্ধের কম্যান্ডার ছিলেন ইপিআর সুবেদার আলী আকবর। তিনি আহত হন। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার শান্তি ডাঙ্গায়। এই ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্য দিনে পাইকারহাটি গ্রামটি হয়ে যায়। শহীদনগর এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রটির নাম শহীদ নগর ডাববাগান। এখানে নিহত পাকসেনাদের লাশ ঐ কনভয় তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এখানে একই দিন পাকবাহিনীর গুলিতে অন্যান্যদের মধ্যে পাবনার বিশ্বাস মোটর সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার শ্রী জগৎ নারায়ন বিশ্বাস, পাকসেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে হত্যা। তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁকেও শহীদ ইপিআর রাজশাহীর মোঃ ইলিয়াসকে সমাধিস্থ করা হয়। ঐ কবরের চিহ্ন আজ নেই তবে কবরস্থানে একটি সবেদা গাছ বড় হয়ে উঠেছে দাড়িয়ে আছে পাকবাহিনীর হত্যা যঞ্চের এবং দুজন হিন্দু মুসলিমের মিলিত সমাধি আত্মদানের নীরব সাক্ষী হিসেবে।

পলায়ন গ্রামবাসী তাড়াহুড়া করে ঐ দুটি শহীদদের লাশকে সমাধিস্থ করেছিলেন। এই যুদ্ধে আত্মদানকারী দেশপ্রেমিক শহীদদের স্মরণে প্রতি বছর কিছু কিছু অনুষ্ঠান ডাব বাগানে অনুষ্ঠিত হলেও আজ পর্যন্ত সেখানে কোন স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। এখানে শহীদ নগর বাজার নামে একটি সচল বাজার স্থাপিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহু দোকান পাট। সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক জনাব শামসুদ্দিন বেড়া-নগরবাড়ী এসে নগরবাড়ী প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বেশ কিছুদিন পর সন্ধান পেয়ে পাক-সেনারা তাঁকে হত্যা করেন। জনাব শামসুদ্দিন শহীদ হন। পাকবাহিনীর আক্রমণের এবং তাদের অত্যাচারের মাত্রা এই সময় থেকে চরম রূপ ধারণ করতে থাকে।

শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হওয়ায় তাদের সহযোগিতায় শহরে ও গ্রামে চলতে থাকে প্রথমত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা গুলিতে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি। সম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়া হয়। অপর পক্ষে মুসলিম যুবকদেরকে গ্রেফতার নির্যাতন মারাত্মভাবে চলতে থাকে। চলতে থাকে ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ। অতঃপর পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণকারীদের মধ্যে থেকে বাঙালী যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন মুজিবনগরে ১৭ এপ্রিল তারিকে শপথ গ্রহণকারী তাজ উদ্দিন আহমেদ সরকার। পাবনা জেলার তরুণদের জন্য মে মাসেই প্রতিষ্ঠিত হয় দুটি ইয়ুথ ক্যাম্প। এ দুটি হলো আওয়ামীলীগ-ছাত্রলীগ পারিচালিত কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্প এবং ন্যাপ সিপিবি ছাত্র ইউনিয়নের পরিচালিত করিমপুর ক্যাম্প।

তৎকালীন এমপিএ, আওয়মীলীগ নেতা, আহমেদ তফিজ উদ্দিন (বর্তমানে এমপি), কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পের পরিচালক এবং ন্যাপ নেতা রণেশ মৈত্র (বর্তমান গণফোরাম নেতা) ছিলেন করমিপুর ক্যাম্পের পরিচালক। ঐ ক্যাম্পে পরবর্তীতে তৎকালীন ন্যাপ নেতা প্রসাদ রায়ও (পরবর্তীতে সিপিবি নেতা) অন্যতম পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আজ আর তিনি বেঁচে নেই। কেচুয়াডাঙ্গা ছাড়াও বর্তমান জেলা আওয়মীলীগ সভাপতি জনাব ওয়াজিউদ্দীন খানের নেতৃত্বে জলঙ্গীতে আরও একটি ক্যাম্প এবং ঐ জলঙ্গীতেই ঈশ্বরদী তৎকালীন ন্যাপ নেতা জনাব আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে ন্যঅপ সিপিবি ছাত্র ইউনিয়ন ও আরও একটি ইয়ুথ ক্যাম্প স্থাপন করেন।

পাবনা জেলার ঐ চারটি ক্যাম্পই মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এ কারণে যে ঈশ্বরদী থেকে পদ্মা নদী দিয়ে বিপুল সংখ্যক তরুণ যুবক ওখানে যাচ্ছিল। তাই তাদেরকে রিক্রুট করার এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণান্তে আসার ঐ পথেই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর সুবিধা। তবে পাবনা জেলার ছাত্র যুবকেরা আরও অনেক ক্যাম্প থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। মে-জুন তাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার সময়। জুন-জুলাই এ প্রশিক্ষণ শেস করে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা পাবনা জেলার বিভিন্ন স্থানে ঢুকতে থাকেন মুল রুটটি ছিল জলঙ্গি পাকশীর নদীপথ।

অপরপক্ষে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মুক্তিযোদ্ধা তরুণেরা দলে দলে ভারতে চলে যাওয়া দেশের অভ্যন্তরে যে শূন্যতায় সৃষ্টি হয় সেই সুযোগে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে গঠিত রাজাকার বাহিনী পুরো মে-জুন মাস ধরে সারা জেলায় ব্যাপক লুটপাট ডাকাতি, খুন ইত্যাদি চালিয়ে যেতে থাকে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অসহায় মানুষ আজ এক গ্রামে কাল অপর গ্রামে আশ্রয় নিতে থাকে। ভারতে আশ্রয় গ্রহণ কল্পে যাত্রাপথে অসংখ্য নর-নারী ডাকাতের হাতে সর্বস্ব হারান। এমন অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে নকশালপন্থীরা দেশের মুক্তিযুদ্ধকে “দুই কুকুরের লড়াই” তত্ত্বে আবির্ভূত হলে পাবনার মানুষ আর এক বিপদের সম্মুখীন হন। পাকবাহিনী জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, রাজাকার, পাক-মিলিশিয়া, নকশাল প্রভৃতির দাপটে বিশেষত পাবনা, ঈশ্বরদী ও বেড়া থানার এক দুঃসহ অনিশ্চিত জীবনের শিকারে পরিণত হতে হয় এলাকাসমূহের জনপদগুলিকে।

ঈশ্বরদী থানা

জুনের শেষ দিক থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা দেশে প্রত্যাবর্তন শুরু করলে জনগণের মনে স্বস্তি ও নতুন আশার সঞ্চার হয়। ঈশ্বরদী থানায় ২৯ জুন তারিখে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা দলটি পাকশীর নিকটবর্তী বাঘইল গ্রামে পৌঁছে ৩৩ জন সদস্যসহ। জুলাই মাসের মধ্যে আরও বেশ কয়েকটি ব্যাচ মুক্তিযোদ্ধা পাবনা জেলার নানা জায়গায় ঢুকে পড়ে। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিটি থানার গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। ৮ জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা পাকশীর এক এলাকায় টেলিফোনের তার কেটে দিয়ে টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরবর্তীতে জয়নগরের বিদ্যুৎ টাওয়ারে শক্তিশালীExplosive নিক্ষেপ করে তার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।

ঈশ্বরদীর মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রু নিধন অভিযানের এক পর্যায়ে দাশুড়িয়া শান্তি কমিটির কুখ্যাত দালাল মওলানা আতাউর রহমান নিহত হয়। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে। জনজীবন ইতোমধ্যেই ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য অচল। আয়-উপার্জন নেই। কৃষি পণ্যের দাম পড়ে গেলেও অর্থাভাবে এক ধরনের দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে চুরি যাকাতি। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব পড়ের জনজীবনে সাধ্যমত স্বস্তি আনয়নের জন্যে দুর্বৃত্ত মুক্ত করার। এ লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা পাকুড়িয়া গ্রামের দূর্ধর্ষ ডাকাত মোকছেদ আলীকে গুলি করে হত্যা করে ৪টায় সেপ্টেম্বর তারিখে। ৬ সেপ্টেম্বরে তারা অনুরুপ ভাবে হত্যা করে সাহাপুর গ্রামের আমদ ডাকতাকে। অতঃপর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয় নকশাল ননী সরদার মন্টু, মান্নান, ভোলা প্রমুখ। ননী সরদারের ছিন্ন মস্তক সলিমপুর হাটের কাছে এক বটগাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা হয়। আরও অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ঈশ্বরদী মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত হয়। যার পূর্ণাঙ্গ তথ্য বিবরণী উদ্ধারের অপেক্ষা রাখে।

সুজানগর

পাকবাহিনী সর্বপ্রথম সুজানগর থানায় প্রবেশ করে ৩ রা মে তারিখে। ঐ দিনই পাবনার শান্তি কমিটির নেতা ওসমান গণির সহযোগিতায় সুজানগর বাজারে রাজাকারেরা ব্যাপক হামলা লুটতরাজ চালায় তারা সুজানগরের বসন্ত কুমার পাল, লক্ষী কুণ্ডু ও সুরেশ চন্দ্র কুণ্ডুকে (পিতাপুত্র) নির্মমভাবে হত্যা করে। সমগ্র সুজানগর থানা জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয় বহু মা বোন হন ধর্ষিতা। ভেতরের কিছু খবর ও তথ্য দিয়ে সংগ্রাম কমিটির নেতা আব্দুল গণি এক পর্যায়ে আব্দুল আউয়াল, শাহজাহান আলী, সুনীল কুমার সাহা ও মন্টুকে ভারতে পাঠান। কাগজ পত্র নিয়ে ভারত যাবার পথে তারা ঈশ্বরদীর আড়মবাড়ীয়া গ্রামে গিয়ে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। রাজাকারেরা আব্দুল আউয়ালকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। মন্টু ও সুনীলকে তারা পাকশী মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে দুজনকে দুটি পৃথক কক্ষে আটকে রেখে ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে সুনীল জানালার শিক ভেঙ্গে পালিয়ে যায়।

মন্টুকে তারা নগরবাড়ী ঘাটে নিয়ে গিয়ে বেয়নেট চার্জ করে হাত বাধা অবস্থায় যমুনা নদীতে ফেলে দেয়। মন্টু পরে বহু কষ্টে সাঁতারে উঠে। ইতোমধ্যে কয়েকশত প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা সুজানগর থানার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান নেয়। এর মধ্যে মুক্তিবাহিনী এবং মুজিববাহিনী উভয়ই ছিল। একদিন দুবলিয়ার বদর বাহিনীর কমান্ডার সামাদের নেতৃত্বে একদল রাজাকার আড়িয়া গোযাল বাড়ীর চর এলাকার গ্রামগুলিতে লুটপাট করতে গেলে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের উপর অতির্কত আক্রমণ চালায়। সকল রাজাকারই ধরা পড়ে এবং মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা নিহত হয়। এতে ঐ এলাকার মানুষ অনেক দিন দুর্বৃত্ত মুক্ত হয়ে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ পায়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের চলাচল বাধাগ্রস্থ করার লক্ষ্যে শ্রীকেরাল ব্রীজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। নগরবাড়ী সড়কের বদনপুর ব্রীজ ভেঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিপর্যস্ত করে দেয়।

৬ সেপ্টেম্বর রাত ভর একটি অপারেশন শেষে ক্লাব মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্রলীগ নেতা ও গণসঙ্গীতের বিশিষ্ট শিল্প পাবনার গোলাম সরওয়ার সাধন সাগরকান্দির এক বাড়িতে অবস্থান নিলে স্থানীয় রাজাকারদের হাতে আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ধরা পড়ে। পাকসেনারা অতঃপর সাধনকে নগরবাড়ী ঘাটে নিয়ে তার চোখ উপড়ে ফেলে এবং অমানুসিক নির্যাতন করে, ১০ সেপ্টেম্বর তাকে হত্যা করে। শহীদ সাধনের নামে এক সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল স্বাধীনতার পর। আজ আর সে প্রতিষ্ঠানটি নেই। মুক্তিযোদ্ধারা অতঃপর খলিলপুর হাটের উপর দুই রাজাকারকে হত্যা করে। ডিসেম্বর মাসে ঢাকা থেকে কার্গোযোগে পাক-বাহিনীর একটি দল নাজিরগঞ্জ বাজারের পাশ দিয়ে কুষ্টিয়ার দিকে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধারা নাজিরগঞ্জ তহসিল অফিসের এলাকা থেকে ঐ কার্গো আক্রমণ করলে ২৭ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। তাদের সবাইকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। কার্গো থেকে প্রচুর অস্ত্র গোলাবারুদ মুক্তযোদ্ধাদের হাতে আসে। পরে কার্গোটি ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

সাতবাড়িয়ায় বিভীষিকাময় গণহত্যা

কুখ্যাত রাজাকার টিক্কা খান ওরফে আমিন উদ্দিন খান, তার ভ্রাতুস্পুত্র মুস্তফা খান (বর্তমানে ঢাকায় সরকারী কলেজে শিক্ষকতায় রত) এবং আরও দুই ভাই আবু জাফর, আবুল খায়েরদের সহযোগিতায় ১৮/২০ টি ট্রাকে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এক বিশাল কনভয় ১২ মে তারিখে সাতবাড়িয়া গ্রামে আকস্মিকভাবে ঢুকে পড়ে ব্যাপকভাবে অগ্নিসংযোগ গণহত্যা লুটপাট চালায়। প্রায় দীর্ঘ দশ ঘন্টা সময়কাল ব্যাপী (ভোর থেকে শুরু করে) এই নারকীয় অভিযান চলে কযেকটি পরস্পর সংলগ্ন গ্রাম জুড়ে। গ্রামগুলি হলো সাতবাড়িয়া, বারাবাড়িয়া, ফকিদপুর, নারুহাটি ও কন্দর্পপুর। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে গোটা তল্লাট জুড়ে ৭০০/৮০০ নিরীহ গ্রামবাসী নারী পুরুষ শহীদ হন। গ্রামগুলি দাউ দাউ করে পুড়তে থাকে।

অনেকের লাশ পদ্মায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অনেককে কয়েকটি গণকবরে সমাধিস্থ করা হয়। ঐ এলাকা ছিল মুক্তিবাহিনীর আশ্রয় স্থল। এই খবর দিয়ে রাজাকার টিক্কা খানেরা পাক-সেনাদের নিয়ে এসে এই নির্মম হত্যা লীলা চালায়। টিক্কা খানকে পরে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করে, আবু জাফর নিজের গুলিতে নিজেই প্রাণ হারায়, আবুল খয়ের সৌদি আরবে ব্যবসায়রত। অপর একটি ভয়াবহ গণহত্যা ঘটে থানায় ২৪শে অক্টোবর তারিখে। একই কায়দায় পাকসেনারা ঐ দিন নিশ্চিন্তপুর, কুড়িপাড়া, সিন্দুরপুর, সিংহনগর, শ্যামনগর, ভাটপাড়া ও গুপিনপুর গ্রাম সমূহে একইভাবে অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা ও লুন্ঠন চালায় এক বিপুল সংখ্যক পাক-বাহিনী ঐ কুখ্যাত রাজাকারদের সহায়তায়।

তারা ঐ গ্রামগুলির অসংখ্য বাড়ী ঘর পুড়িয়ে দেয়। প্রায় ৭০০/৮০০ নারী পুরুষকে হত্যা করে এবং ব্যাপক সম্পদ লুণ্ঠন করে। পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় বস্তুতঃই সুজনগর থানায় বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের এক বিশাল আশ্রয়স্থল। তাই এই এলাকা পাক-বাহিনীর ভয়াবহ আক্রোশের মুখে পড়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন খুবই খারাপ থাকায় আরও বহু হামলা শত্র“ পক্ষ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চালাতে পারে নি।

আরও কতিপয় ঘটনা

সুজানগর থানাল মুক্তিযোদ্ধারা ৪ঠা সেপ্টেম্বর দুলাই ব্রীজের ধ্বংস সাধন করে এবং ঐ ব্রীজ পাহাড়ারত ৫ জন রাজাকারকে হত্যা করে। আগস্টে পদ্মা নদী পার হওয়াকালে সাতবাড়িয়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন শহীদ হন পাক-সেনাদের গুলিতে। ১০ই ডিসেম্বর সুজানগর বাজারের ব্যবসায়ী মানিকদির গ্রামের অধিবাসী অজিত কুন্ডু, একই গ্রামের আব্দুল হামিদ এবং থানা সংলগ্ন কালী মন্দিরে অবস্থানকারী কৃষি কর্মচারী গোপাল চন্দ্র ভাদুরীকে এক সঙ্গে হত্যা করে মন্দিরের পার্শ্ববতী কুয়োর মধ্যে লাশগুলি পাকসেনারা নিক্ষেপ করে চলে যায়।

সুজানগর মুক্ত

ঢাকায় পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের কয়েকদিন আগেই সুজানগরে মুক্তিযোদ্ধারা এক কঠিন যুদ্ধের মাধ্যমে থানাটিকে মুক্ত করে। যুদ্ধটি মুক্তিযোদ্ধারা ১১ই ডিসেম্বর ভোর ৬টায় সুজানগর থানায় অবস্থানরত পাকসেনাদেরকে আক্রমণের মাধ্যমে সূচনা করে এবং ১৪ই ডিসেম্বর সকাল সাতটায় বিজয় অর্জনের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। যুদ্ধ শুরুর দিন ১১ই ডিসেম্বর সকাল নয়টায় থানা ক্যাম্পের ৫০ গজ দক্ষিণে পাবনা শহরের নুরুল ইসলাম নুরু পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ১২ডিসেম্বর সকাল নয়টায় মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল দুলাল থানা ক্যাম্পের ২০ গজ পশ্চিমে পাকসেনার গুলিতে শহীদ হন।

১৩ ডিসেম্বর রাত ১০ টায় পাবনা দ্বীপচর নিবাসী মোঃ আবু বকর থানা থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে পাবনা-সুজানগর ট্রেঞ্চের ভেতরে লুকিয়ে থাকাকালে রাত দশটার দিকে পাক-বাহিনী কর্তৃক শহীদ হন। ১৪ ডিসেম্বর বিকেল দুইটার দিকে তারাবাড়িয়া বাজারে পাবনা থেকে আগত পাকসেনা ও রাজাকারদের সাথে এক সম্মুখযুদ্ধে ১০ জন রাজাকার নিহত হয়। একই দিন বিকেল তিনটার দিকে সুজানগর আতাইকুলা রাস্তার পাড়ে থানা ক্যাম্প থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে আর একটি সংঘর্ষ হয় এবং আতাইকুলা ফিরে যাবার পথে চরতারাপুর বাগচীডাঙ্গী গ্রামের মোঃ খোদা বখশ প্রামাণিকসহ আরও একজনকে রাজাকারেরা আড়িয়াডাঙ্গি ঘাটের পাশে হত্যা করে।

১৪ ই ডিসেম্বর বিকেলে তারাবাড়িয়া মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে একজন পাক-মিলিশিয়া নিহত হয়। সুজানগরের এই সমাপনী বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে ১৪ই ডিসেম্বর সুজানগর থানার চড়ান্ত বিজয় হয়। ঐ যুদ্ধে পাবনা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান, তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা এবং মুজিব বাহিনীর সদস্য (বর্তমান বিএনপি নেতা) জহুরুল ইসলাম বিশু তাঁর ডান বাহুতে শত্র“ বাহিনীর গুলিতে গুরুতর ভাবে আহত হলে তাঁর সহযোদ্ধারা তাঁকে দ্রুত কোলকাতা নিয়ে যান এবং সেখানে বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী তদানীন্তন শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সাহায্য সহযোগিতায় সেখানে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে তিনি দেশে ফেরেন।

ফরিদপুর থানা

যুদ্ধ, গণহত্যা, গণনির্যাতন ইত্যাদির ক্ষেত্রে ফরিদপুর থানা বহু গৌরব ও বেদনার্ত ইতিহাসের সাক্ষ্য রেখেছে। সম্ভবত জুলাই মাসে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েক একটি অংশ দেশে ফিরে ফরিদপুর থানার সেলিম, মুর্শেদ, আব্দুল মান্না, আব্দুস সাত্তার, নারায়ণ চন্দ্র শীল, দুলাল মনরিুজ্জামান আব্দুল ওয়াহাব প্রমুখ নিজ নিজ এলাকায় চলে আসে। একদিন বিকেল তিনটার দিকে বাঘাবাড়ি থেকে প্রায় দেড়শত পাকসেনা ফরিদপুরের পথে রওনা দিলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক মুকুল ও শাহজাদপুরের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রায় ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ডেমড়া ইউনিয়নের মাজটা নামক স্থানে পাক সেনাদের দলটিকে গেরিলা পদ্ধতিতে অতর্কিত আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে প্রায় ৪০ জন পাক-সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধ ঐ এলাকায় মাজাট যুদ্ধ বলে খ্যাত। মাজাট যুদ্ধের প্রায় তিন সপ্তাহ পর বাঘাবাড়ী থেকে প্রায় দুইশত জন পাকসেনা পায়ে হেঁটে ফরিদপুর আসছিলো। আব্দুর রাজ্জাক মুকুলের নেতৃত্বে এক বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ফরিদপুর থানার কালিয়ানী নামক স্থানে শত্রু-সেনাদেরকে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। তিন জন পাকসেনা খতম হয় অপরপক্ষে শহীদ হন পাবনার দু-জন মুক্তিযেদ্ধা খায়রুল ও শহীদুল। এরা ধরে পড়ে যান শত্র“সেনাদের হাতে। নির্মমভাবে বেয়নেট চার্জ করে এদেরকে হত্যা করা হয়।

ডেমরাগণহত্যা

ফরিদপুরের ডেমরাতে সংঘটিত হয় অপর ভয়াবহতম গণহত্যা। এলাকাটি হিন্দু প্রধান ছিল। জেলার নানা অঞ্চল থেকে বহু হিন্দু মুসলিম নারী পুরুষ ওই এলাকায় নিয়ে আশ্রয় ও নিয়েছিলো। সম্ভবত মে অথবা জুনের দিনে একদিন গভীর রাতে এলাকার কুখ্যাত রাজাকার প্রধান হাসান ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় বিরাট এক সেনাবাহিনী অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করতে করতে ডেমরা গ্রামটিকে ঘিরে ফেরে। ঘুমন্ত মানুষগুলির আওয়াজে নিদ্রাভঙ্গের পর হয়ে পরেন ঐ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দিশেহারা। গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। শত শত নারী পুুরুষ শিশু যুবক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কয়েকশত মানুষকে নদীর তীরে লাইন ধরে দাঁড় করিলে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। শহীদ হন এক হাজারের মত মানুষ। গ্রামটিকে তারা পুড়িয়ে দেয়। লুণ্ঠন চলে ব্যাপকভাবে।

হাদল গণহত্যা

এক কালের সমৃদ্ধিশালী গ্রাম ছিলো হাদল। বিস্তর হিন্দু মুসলমানদের বসতি। যোগাযোগ ব্যবস্থা মান্ধাতা আমলের। তাই এলাকাটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলে বিবেচিত হতো। এ কারণেই পাবনা শহর থেকে শুরু করে বহু অঞ্চলের মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলো। ডেমরার গণহত্যার প্রায় দু-সপ্তাহ পর স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী অতর্কিত একদিন এই গ্রামে ঢুকে পড়ে নারকীয় হত্যালীলা চালায়। লুুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ ও অগ্নি সংযোগও চালায় ব্যাপকভাবে। প্রায় চারশত নারী পুরুষ সেদিন হাদলের প্রত্যন্ত গ্রামটিতে শহীদ হন। সারাটি গ্রাম পরিণত হয় এক নিঝুম পুরীতে। গোপালনগর গণহত্যা আগষ্টের শেষ দিকে, জানামতে ৪ঠা ভাদ্র, ১৩৭৭ ভোর চারটার দিকে পাবনা থেকে আতাইকুলা হয়ে পাকসেনাদের প্রায় ৪০ জনের একটি সুসজ্জিত দল স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় গোপালনগর গ্রামে ঢুকে পড়ে। সেখানে তারা প্রায় ৭০০ জনকে একত্র জড়ো করে জিজ্ঞাসা করে কারা মুক্তিযোদ্ধা। ২৬ জন যুবককে বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে। অন্যদেরকে চলে যেতে বলে। এরপর ধৃত ঐ ২৬জনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। ২৬ জনই একসাথে শহীদ হন। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা আবুল কাশেম মোল্লাকে কালীমন্দিরের ত্রিশুল দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

ফরিদপুর থানা আক্রমণ ও বিজয়

পার্শ্ববর্তী উল্লাপাড়া থানার প্রখ্যাত মুক্তযোদ্ধা (বর্তমান এমপি) লতিফ মীর্জা ও শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ৪ঠা ডিসেম্বর গভীর রাতে শত্র“-সেনা ঘাঁটি ফরিদপুর থানাকে অবরুদ্ধ করে ফেরে। পূর্ব পরিকল্তি এই হামলার ক’দিন আগে থেকেই বড়াল ব্রজি ও বাঘাবাড়ী ঘাট থেকে পাক-সেনাদের ফরিদপুর আসার পথ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে কড়া পাহাড়া বসিয়ে রাখে। ৪ঠা ডিসেম্বর একটানা যুদ্ধ চলে। ২৩ জন পাকসেনা এই যুদ্ধে নিহত হয়। অতঃপর আবদুল লতিফ, শামসুল ইসলাম জিলানী ও মনসুর এগিয়ে গেলে আকস্মিকভাবে পাক-সেনারা ঐ চার জন মুক্তিযোদ্ধাদে ঘিরে ফেলে। এক পর্যায়ে আবারও যুদ্ধ হয় একটি বিলের নিকটে। এক ঘন্টা হয় এই যুদ্ধ। এখানে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ এবং শামসুল ইসলাম পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে যায়।

অতঃপর আহত দুই মুক্তিযোদ্ধাতে হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফরিদপুর থানায় আনা হয় এবং সেখানে নিহত পাকসেনাদের লাশসহ আটক দুই মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে শত্রু সেনারা ফরিদপুর থানা ত্যাগ করলে ঐ থানা স্থায়ীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ফরিদপুর থানা এভাবেই মুক্ত হয় ৫ ডিসেম্বর। কিন্তু শত্রুদের হাতে গ্রেফতারকৃত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফকে উল্লাপাড়া এবং শামসুল ইসলামকে পাবনা সেনা ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখা হয়। পাবনা ক্যাম্পে নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর সেখানে আটক শামসুলসহ ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে একটি গর্তের মধ্যে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। সকলেই মৃত মনে করে সবাইকে মাটি চাপা দিয়ে শত্রু-সেনারা চলে যাওয়ার পর আহত শামসুল বহু কষ্টে ঐ গণকবর থেকে উঠে নুরপুরে কিয়ামুদ্দিনের বাড়ীতে কয়দিন লুকিয়ে থেকে অবশেষে চিকিৎসার জন্য ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হন। অপরপক্ষে ১০/১২ দিন ব্যাপী সীমাহীন নির্যাতন চালানোর পর ১৭ ডিসেম্বর উল্লাপাড়া সেনা-ক্যাম্প থেকে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সাথে আহত আব্দুল লতিফকেও মুক্তি দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে আগের দিনই (১৬ই ডিসেম্বর) পাক-বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে।

পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ

১৪ ডিসেম্বর অত্যাসন্ন বিজয়ের দিন। ক’দিন আগেই যশোর ক্যান্টেনমেন্ট ছেড়ে পাকসেনারা অন্যত্র চলে গিয়েছে যশোর মুক্ত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা সারা দেশের বহু স্থানে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রীজ উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে বিরাজমান। মিত্র ভারতীয় বাহিনী তখন দ্রুত পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পন করার জন্য বেতারে এবং নানা আন্তর্জাতিক চ্যানেলে আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু বেঈমান পাকবাহিনীকে তো বিশ্বাস নেই। যদি উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি থেকে পাকসেনারা রেলপথে পুনরায় যশোরে চলে যায়? যশোর ক্যান্টনমেন্ট পুনর্দখলের প্রচেষ্টা নেয়? এই চিন্তায় হার্ডিঞ্জ ব্রীজ বিধ্বস্ত করার লক্ষ্যে পাবনা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দিয়ে ভারতীয় বোমারু বিমান ১৪ই ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে উড়তে দেখা যায়। হঠাৎ বিকট শব্দ।

উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ভারতীয় বিনাম বাহিনীর বোমা নিক্ষেপে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজের উপর পর পর কয়েকটি বোমা নিক্ষে করে। ব্রীজের ১২ নং স্প্যানের পশ্চিম দিকের মাথা ভেঙ্গে পদ্মার জলে পড়ে যায়। সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৯ ও ১৫ নং স্প্যানেও সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি বিশালাকার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় ব্রীজের ও পূর্ব দিকে পড়ে ছিলো। স্বাধীনতার পর ভারতীয় মিত্র বাহিনী এই শেলটি ফাটিয়ে দেয়। যখন ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকশী ব্রীজটির উপর বোমা নিক্ষেপ করছিলো ঠিক তকণই পাকবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ী ও একটি ট্যাংক ব্রীজের উপর দিয়ে পার হচ্ছিলো। ১২ নং স্প্যানটি ভেঙ্গে পড়ার পর ট্যাংকটি ব্রীজের উপরই পড়ে ছিলো কয়েকজন পাকসেনার লাশও ব্রীজের ভাঙ্গা স্প্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা গেছে।

চাটমোহর থানা

এপ্রিলে দ্বিতীয় সপ্তাহ পাক সেনারা প্রথম চাটমোহর থানার দখল নেয়। তখন কোন যুদ্ধ হয় নি। তবুও সন্ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে ঐদিনই তারা চাটমোহর বাজার পুড়িয়ে দেয়। অনেক দোকান ভস্মীভূত হয়। তারা ঐদিনই হত্যা করে কয়েকজনকে। এই দিন শহীদ হন অশ্বিনী কুমার কুণ্ডু, রঘুনাথ সাহা, যতীন্দ্র নাথ কুণ্ডু ন্যাশনাল ব্যাংকের (বর্তমান সোনালী ব্যাংক তৎকালীন ক্যাশিয়ার এবং এ ব্যাংকেরই একজন গার্ড। এরপর ঐ দিনই পাকসেনারা পাবনা ফিরে আসে।

এলাকার তরুণেরা ভারতে চলে যায়। হাজার হাজার হিন্দু মুসলমানও দেশত্যাগ করতে থাকেনা পরবর্তীতে প্রশিক্ষিত তরুণরা নানা ফ্রন্টে যুদ্ধে নিয়োজিত হন। এই থানায় নয় মাসে কোন উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ সংগটিত হয়নি। চাটমোহর মুক্ত করার লক্ষ্যে ডিসেম্বর ১২ তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা (পায় ৩০/৪০ জন) থানাকে ঘিরে ফেলে। আক্রমণও করে অত্যন্ত বীরত্বের সাথে। এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ উদ্দিন। সংগে শত শত মুক্তিযোদ্ধা।

১৫ই ডিসেম্বর ঐ থানায় অবস্থানরত সকল পাক-মিলিশিয়া রাজাকার থানার দালানের অভ্যন্তরে ঢুবে পড়ে। তারা ক’দিন ধরে ঘেরাও হয়ে থাকার। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানালে শত্র“-সেনারা সেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে থানা অভ্যন্তরে আলোচনার প্রস্তাব দিলে রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেখানে যান। সেদি.ন ১৬ ই ডিসেম্বর। আলোচনা কালে শত্র“পক্ষ জীবনের নিরাপত্তা চাইলে তার নিশ্চয়তার প্রদান করে মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে নিয়ে এসে পাবনার সেনা শিবির ওয়াপদা কলোনীতে আটক করে এভাবে ১৭ই ডিসেম্বর। এভাবেই ১৭ই ডিসেম্বর চাটমোহর থানা চূড়ান্ত ভাবে শত্রু মুক্ত হয়।

সাঁথিয়া থানা

সাঁথিয়া থানা সদরে পাক হানাদাররা প্রথম প্রবেশ করে ২১শে এপ্রিল। এর দু’দিন পূর্বে ১৯শে এপ্রিল থানার শহীদ নগরে (পাইকরহাটি) মুক্তিযোদ্ধাদের বাধার সম্মুখীন হয় হানাদাররা। দুপুর এক টায় অতর্কিত হামলা করে পাক বাহিনী শহীদনগর ডাব বাগানে অবস্থিত ইপিআর জোয়ান ও মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। উল্লেখ্য ইপিআর জোয়ানরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ইপিআর সুবেদার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবর। ডাববাগান যুদ্ধ চলে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর নিকট পরাস্ত হন মুক্তিযোদ্ধারা। এখানে শহীদ হন প্রায় দেড়শ নিরস্ত্র গ্রামবাসী ও ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। ১৪ ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালায়। রাত ২টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত চলে যুদ্ধ। পরাস্ত হয় রাজাকাররা। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারের কমান্ডার আব্দুস সামাদ ফকির সহ ৯ জনকে হত্যা করে এবং ১৪টি অস্ত্র দখলে নেয়।

এর পরবর্তী দিন পাক হানাদাররা সাঁথিয়া আসে এবং সোনাতলা, চোমরপুর গ্রামে নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর হামলা চালায় নির্যাতন চালায় হিন্দু, মুসলমান সকল বয়সের মানুষদের। পুড়িয়ে দেয় প্রায় ৫০টি বাড়ীঘর। হত্যা করে ৬ জন নিরস্ত্র মানুষকে। ২৭শে নভেম্বর রাতে অতর্কিত হামলা করে হানাদার দস্যুরা ধুলাউড়ি গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। রাত প্রায় ৩টায় রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার দস্যুরা ধুলাউড়িতে ৯ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ২৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। একই স্থানে রয়েছে জন মুক্তিযোদ্ধার কবর। ১৪ই মে হানাদাররা সাঁথিয়া রূপসী ও ফরিদপুর থানার ডেমরায় হামলা করে প্রায় সাড়ে ৮শ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করে।

৭ ই ডিসেম্বর সাঁথিয়া থানা শত্র“ মুক্ত হয়। এদিন সকাল ১টায় মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্দিকে দিয়ে থানা ঘিরে ফেলে। থানায় অবস্থানরত পুলিমরা আত্মসমর্পণ করে বিনা যুুদ্ধে। ৮ই ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় পাক বাহিনী সাঁথিয়া তানা সদরে প্রবেশ কালে কোনাবাড়িয়া ব্রীজের নিকট বাধাপ্রাপ্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সারাদিন যুদ্ধ করে। হানাদাররা একটি ট্রাক ও জীপ ফেলে পিছু হটে পাবনায় চলে যায়। পরদিন ৯ ই ডিসেম্বর সকালে আবার হানাদাররা দলে ভারী হয়ে সাঁথিয়া প্রবেশের চেষ্টা করে। জোড়গাছা এবং নন্দনপুরের মধ্যাবর্তী ব্রীজটি মুক্তিযোদ্ধারা বিধ্বস্ত করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখায় সেখানেই বাধাপ্রাপ্ত হয় হানাদাররা। সকাল ৯টা সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে শহীদ মতিয়ার এবং সন্টু মন্টুর বিরাট অবদান রয়েছে। সবচেয়ে বড় যার অবদান সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ভানু নেছা এখন অবহেলিত।

গরীব এই বীর মহিলা মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি তেঁথুলিয়া (সাঁথিয়া) গ্রামে। তার বয়স এখন ৭০ বছর। বিধবা এই মহিলা এ পর্যন্ত কোন সরকারী সাহায্য পাননি। তিনি ঐ দিন (৫ই ডিসেম্বর) যুদ্ধে সাঁথিয়া থানায় এসে প্রায় ২ মন ওজনের গুলির বস্তা কাধে পিঠে করে যুদ্ধস্থলে যান এবং বাংকারে বাংকারে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি সরবরাহ করেন। ২টি ছেলে তার। তারা দিনমজুর। বীর মুক্তিযোদ্ধা ভানু নেছা এখন বিধবা। তিনিও দিনমজুর। এই মহিরা কারে নিকট হাত পাতেন না। তারা এখনো দৃপ্ত কণ্ঠে গর্ব তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কোন রকম মাথা গোঁহার ঠাঁই কুড়ে ঘরে তার বসবাস। শীত নিবারনের বস্ত্র নেই। নেই পেট পুরে খাবার ব্যবস্থা।

আটঘরিয়া থানা

পাবনা জেলার একটি ক্ষুদ্র থানা আটঘরিয়া। জনসংখ্যাও কম। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। এতৎ সত্ত্বেও এখানে যুদ্ধ হয়েছে বীরত্ব সূচক। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। গণহত্যা হয়েছে লক্ষীপুর গ্রামে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে চলছিল মালিগাছাতে যুদ্ধ। এলাকাটি পাবনা সদর থানার অন্তর্গত। কিন্তু আটঘরিয়া থানার সীশান্তে। আটঘরিয়া থানার দারোগা আব্দুল জলিল ঐ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন। তিনি একটি কড়ই গাছের আড়াল থেকে এই গ্রুপ সহযোদ্ধা নিয়ে কেতাব মোল্লার রান্নাঘরের নিকটই বাংকার থেকে পাক-সেনাদের সালের যুদ্ধ চালাতে চালাতে এক পর্যায় পাক সড়কে উঠে পড়লে সাথে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন।

যুদ্ধ চলেছিল সারাটি দিন ব্যাপী। অবশেষে স্থানীয় লোকজন দারোগা আবদুল জলিলের লাশ আটঘরিয়া থানায় নিয়ে যাওয়ার পতে দেবোত্তর বাজারের দক্ষিণ পাশে মসজিদ সংলগ্ন মাঠে তাঁকে কবরস্থ করেন। জানা যায় শহীদ দারোগা আব্দুল জলিলের বাড়ী যশোর জেলায়। আটঘরিয়া থানার মাঝপাড়া ইউনিয়নের সোনাকাদর ও বংশী পাড়ার মাঝখানে অবস্থিত বংশীপাড়া ঘাট। মুলাডুলি থেকে তিন মাইল পূর্ব-দক্ষিণে খিদিরপুর বাজার হতে মাইল খানেক উত্তরে চন্দ্রাবতী নদীর ঘাট। চন্দ্রাবতী নদীর দুই তীরে রক্ত ক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেখানে রামচন্দ্রপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের এক শক্তিমালী ঘাঁটি ছিল। সেখানে গোকুলনগরের আনোয়ার হোসেন রেনুর নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীর একটি দল এবং ঈশ্বরদী ওয়াছেফ আলী কমান্ড্যারের নেতৃত্বে অপর একদল (এফ.এফ) মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলো।

৬ নভেম্বর রাজাকারদের মাধ্যমে গোপন খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন তাহেরের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ জন পাকসেনা সেখানে নিয়ে পৌছালে হতচকিত মুক্তিযোদ্ধারা অপ্রস্তুত অবস্থায়ই পাকসেনাদের আক্রমণ করে বসে। কয়েক ঘন্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত তুমুলযুদ্ধে ক্যাপ্টেন তাহের গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় কিন্তু তার বাহিনী মরিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, আবদুল খালেক, ইউসুফ আলীসহ মোট নয় জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকসেনাদের মধ্যে ১৬ জন মারা যায়। কয়েকজন গ্রামবাসীও শহীদ হন। এই যুদ্ধ বংশীপাড়ার যুদ্ধ বলে পরিচিতি। এই যুদ্ধে শহীদ আবুল কাশেমের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বেরুয়ান গ্রামের নাম কাশেমনগর রাখা হয়েছে অপরদিকে খিদিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম শহীদ আব্দুল খালেকের নামানুসারে।

লক্ষ্মীপুরের গণহত্যা

আগষ্ট মাসের দিকে রাজাকারদের সহায়তায় পাক-বাহিনীর এক সুসজ্জিত দল হিন্দু প্রধান গ্রাম লক্ষ্মীপুরে অতর্কিত প্রবেশ করে ২৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। যাঁরা শহীদ হন তাঁদের যে নামগুলি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তাঁরা হলেন লক্ষ্মীপুর গ্রামের তারাপদ দাশ, নরেশ চন্দ্র দাশ, অবনী কুমার দাশ, সুরেন চন্দ্র দাশ, অনীল চন্দ্র দাশ, সূর্য্য কুমার দাশ, কানাই লাল দাশ, ধীরৈন্দ্র নাথ কর, সদা কর, অশ্বিনী কুমার কর, নির্মল কর, সনাতন দত্ত, আশুতোষ দত্ত, কেশু দত্ত, গোপাল দাশ, অধির কুমার, কমল পাল, অহিত কুমার পাল, নিরঞ্জন কুমার, মনোরঞ্জন পাল। লক্ষ্মীপুর কালীবাড়ী প্রাঙ্গণে ধরে এনে এদেরসহ ২৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আহতদের মধ্যে ভবানী লালের নাম জানা গেছে।

অতঃপর পাকবাহিনীর ঐ ক্ষিপ্ত দলটি একই দিনে লক্ষ্মীপুর থেকে চলে যায় কৈজুরী শ্রীপুর গামে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, রাজশাহী বেতারের এবং পাবনার খ্যাতমান পল্লী সঙ্গীত শিল্পী ও আওয়ামী নেতা আব্দুল গফুরের বাড়ীতে। পাক-বাহিনী আব্দুল গফুরকে তাঁর বাড়ীর নিকটেই নির্মমভাবে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। শহীদ হন সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী আব্দুল গফুর।

শত্রু নিধন ও আরও কতিপয় ঘটনা

আটঘরিয়া থানার শান্তি কমিটি ও জামাতে ইসলামী নেতা মৌলভী আব্দুল লতিফকে মুক্তিফৌজ গুলি করে হত্যা করে। অত্যাচারী এই জামাত নেতার হত্যার পর ঐ এলাকায় মানুষের মনে অনেকটা স্বস্তিবোধ ফিরে আসে। আটঘরিয়া থানার গোড়ড়ি খেয়াঘাটের মাঝি নাথু পাটনি একজন পাক-বাহিনীর দালাল। সে কিছু কিছু লোককে পাক-সেনাদের দ্বারা গ্রেফতার করায়। মুক্তিসেনারা একদিন রাত দশটায় তার বাড়ী আক্রমণ করে বাড়ীর কয়েকজন পার্শ্ববর্তী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালায় কয়েকজন নিহত হয়। অতঃপর ঐ দালাল মাঝির বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রতিশোধ নিতে উম্মত পাকবাহিনী ঐ ঘটনার কিছু দিন পরই দালালদের সহায়তায় আকস্মিকভাবে গোড়ড়ি গ্রামে ঢুকে মাস্টার প্রদ্যোৎ কুমার সাহা, অরুণ প্রসাদ সাহা, কালিকিংকর সাহাসহ বহু গ্রামবাসীর বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর বাড়ীগুলি ব্যাপক লুট পাটের কবলে পড়ে।

বেড়া থানা

আসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই তৎকালীন এমপিএ (বর্তমান তথ্য প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক আবু সাইয়িতের নেতৃত্বে একদল যুবক অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। বেড়ার সাহসী সন্তান আব্দুল মজিদ মোল্লা ছিলেন প্রশিক্ষক। এই বাহিনীতে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সামছুল হক টুকু (বর্তমান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী), মোঃ আব্দুল খালেক, জানে আলম, সুজাউদ্দিন, আব্দুস সাত্তার, বোরহান উদ্দিন, শুকুর আলী, জয়নাল আবেদিন, চাঁদ মিঞা, মজনু, জয়গুরু, মানিক প্রমুখ। ৩১ মার্চ থেকেই বেড়ায় প্রশিক্ষিত অ-প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা তরুণেরা এবং অনুরূপভাবে পাবনা শহর সুজানগর, সাঁথিয়া, শাহজাদপুর প্রভৃতি এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীবৃন্দ পুলিশ, আনসার, এলাকার জনঘন, বগুড়া থেকে আগত ইপিআর বাহিনীর সদস্যবৃন্দ সবাই মিলে নগরবাড়ী ঘাটে দ্বিতীয় দফা পাকসেনা প্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে শুরু করেন। ৯ই এপ্রিল এই প্রতিরোধব্যুহ পাকিস্তানী, বিমান, নৌ ও সেনাবাহিনীর সাঁড়িশি আক্রমণে ভেঙ্গে পড়লে ১০ই এপ্রিল পাক বাহিনী পাবনা শহর পুনর্দখল করে। এই পর্যায় ইপিআর সদস্যগণ এবং মুক্তিযোদ্ধারা পাইকারী হাটি ডাববাগানে ট্রেঞ্জ কেটে পাক-সেনাদেরকে আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে সংঘটিত হয় (পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে) পাইকরহাটি বা শহীদনগরের ডাববাগান যুদ্ধ।

অতঃপর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বেড়া থানা পাবনা পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। মুক্তিকামী তরুণেরা নানাপথে ভারতে প্রশিক্ষণার্থে চলে যেতে থাকে। বেড়া থানায় ঢুকে সেই দিনই পাক-সেনারা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শামসুল হক টুকুর বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বেড়া বাজারের অসংখ্য দোকান পাট ও তার অগ্নিদগ্ধ করে। নগরবাড়ী ঘাট তখন হয়ে পড়ে পাক-বাহিনীর অত্যান্ত শক্তিশালী ঘাঁটি। পুরা যমুনা নদীর বিস্তীর্ণ এরাকা ও উত্তর বঙ্গ হাইওয়েকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতো। মাঝে মধ্যে বেড়া থানায় এসে টহল দিতো। এক পর্যায়ে তারা বেড়ায় বৃশালিখা গ্রামে (আগস্ট মাসে) সোহরাব হোসেন সহ ১২ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তাঁরা শহীদ হন। আর এক উৎপাত ইতোমধ্যেই শুরু হয়।

একদিকে ইতোমধ্যেই গঠিত শান্তিকমিটি ও রাজাকার বাহিনী আপরদিকে নকশালীদের সশস্ত্র উৎপাতে মুক্তিকামী যুব তরুণদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে একদিন সম্ভবতঃ জুলাই আগস্টে একদল মুক্তিযোদ্ধা কৈটোলা থেকে নাকালিয়া যাওয়ার পথে হঠাৎ নকশাল নেতা ফরমান ও তার বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং নকশাল বাহিনী ৫/৭ টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়। নভেম্বরের দিকে ঐ নকশাল নেতা ফরমানকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে এবং বেশ কিছু অস্ত্রও উদ্ধার করে। রাজাকার বাহিনী বেড়ায় অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। তারা বারবার বেড়া ও নাকালিয়াসহ অসংখ্য গ্রামে লুটপাট অগ্নিসংযোগ করে হাট-বাজার বন্দর ও গ্রামকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার কয়েকদিন পর শত শত মুক্তিযোদ্ধা শাহজাদপুর ও আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে বেড়াকে শত্র“ মুক্ত করে। বেড়ায় উদিত হয় স্বাধীনতা সূর্য। ইতোমধ্যে বেড়ায় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক, গুরুজয়, আমজাদ হোসেন ও পুলিশের কনস্টেবল নাজিমুদ্দিন নানা ফ্রন্টে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে শহীদ হন।

পাবনা সদর

পাবনা শহরসহ পাবনা সদর থানার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও গৌরবময় যুদ্ধ সংঘটিত হয় পাকবাহিনীর প্রথম দফা পাবনা প্রবেশের অব্যবহিত পরপরই। ২৯শে মার্চ পাবনায় প্রথম দফা বিজয় সূচিত হয়। পাবনার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পুলিশও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভারতে চলে যেত শুরু করেন ১০ই এপ্রিল পাবনায় দ্বিতীয় দফা পতনের পর থেকে। তবুও কোথায় কোথাও মে এপ্রিল মাস জুড়েই খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে, আগেই তার উল্লেখ করা হয়েছে। পাবনাতে শুধু পাকসেনারাই নয়, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, নকশালপন্থী এক বিশাল শক্তিতে আবির্ভূত হয় এবং পরস্পর মিলেমিশে যারা পাবনা শহর এবং আশপাশের ইউনিয়নসমূহ এবং চর এলাকাগুলিতে ভয়াবহ হত্যালীলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নির্যাতন, নারী অপহরণ ও ধর্ষণ ইত্যাদি চালাতে থাকে।

পাবনা শহরে মুক্তিযোদ্ধারা নভেম্বর পর্যন্ত ঢুকতেই সক্ষম হয় না। রিদ্দিক, তার ভাই প্রশিক্ষণ নিয়ে পাবনায় ঢুকবার পরপরই গ্রেফতার হয়। ওয়াপদার সেনাক্যাম্পে নির্যাতন করে তাঁদের হত্যা করা হয়। তাঁরা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথম ব্যাচ পাবনা জেলায় যারা ঢুকেছিল তাদের নেতৃত্বে ছিলো মোঃ ইকবাল (সাবেক এমপি) বেবী ইসলাম প্রমুখ। পরপর আরও বহু ব্যাচ নানা পথে ঢুকতে থাকে। পাবনা থানার চরকাতরায় জফির ঢালির বাড়িতে বরাবর ১০০/১৫০ মুক্তিযোদ্ধা থাকতো। দ্বীপচরের ফৈজ মালিথা, তাজ বিশ্বাস প্রমুখের বাড়িতেও তাই। সানিকদিয়ার চরে ২৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও নকশালীদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হলে উভয় পক্ষে বিপুল সংখ্যক লোক হতাহত হয়। এমনকি ১৮ ডিসেম্বর তারিখেও পুরাতন পলিটেকনিক স্কুলের নিকট পাকবাহিনী ও নকশালদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।

নাজিরপুর গণহত্যা

পাবনা সদর থানার নাজিরপুরে নভেম্বরের ২৯ তারিখে এক নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত করে বর্বর পাক-বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা মিলে এক যৌথ অভিযানে। অসংখ্য নিরীহ গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়াও এই থানায় ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয় টিকোরি, দাপুনিয়া, মাধপুর প্রভৃতি অঞ্চলে। এ সকল গণহত্যায়ও অসংখ্য গামবাসী নিহত হন Ñ শহীদ হন। অনেক মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন গ্রামগুলিকে বাঁচাতে গিয়ে।

পাবনার চূড়ান্ত বিজয় : পাবনা মুক্ত দিবস

১৬ ডিসেম্বর পাক-বাহিনী মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করলেও পাবনায় পাকবাহিনী সেদিন আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়নি। তারা জানায়, তারা ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতিতেই শুধু আত্মসমর্পণ করবে। জেনেভা কনভেনশনের নিয়ম মোতাবেক আত্মসমর্পণকারী পাকবাহিনীর দৈহিক নিরাপত্তা ব্যহত হতে পারে এই আশংকায় তারা আমাদের মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাই, আরও তিনদিন পরে অর্থাৎ ১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭১, মিত্রবাহিনীর একজন অফিসারের উপস্থিতিতে ওয়াপদা কলোনীতে (নূরপুর) তারা আত্মসমর্পণ করে। ইতোপূর্বে জেলার সকল ঘাঁটি থেকে তারা এসে ওয়াপদা কলোনীতে সমবেত হয়েছিলো। তাই ১৯ শে ডিসেম্বর পাবনা মুক্ত দিবস হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত থাকবে।

পাবনা জেলার যুদ্ধ ক্ষেত্রসমূহ

পাবনা থানা : পাবনা পুলিশ লাইন, টেলিফোন একচেঞ্জের পুরাতন ভবন, লষ্করপুর, বালিয়া হালট, মালিগাছা, বাঙ্গাবাড়িয়া, নাজিরপুর, মাধপুর ও তারাবাড়িয়া।

ঈশ্বরদী থানা : দাশুড়িয়া, মুনসিদপুর, পাকশী হার্ডিঞ্জ সেতু এলাকায় পদ্মাতীরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিমানবন্দর প্রভৃতি এলাকা।

আটঘরিয়া : বংশীপাড়া, হাপানিয়া, আটঘরিয়া থানা, বেলদহ প্রভৃতি এলাকা।

চাটমোহর থানা : কৈডাঙ্গা ব্রীজ, চাটমোহর থানা। ফরিদপুর থানা : মাজাট, কালিয়ানী, ফরিদপুর থানা।

সাঁথিয়া থানা : শহীদনগর ডাব বাগান, ধুলাউড়ি প্রভৃতি এলাকা।

বেড়া থানা : নগরবাড়ী ঘাট ও বাঘাবাড়ী ঘাট এলাকা।

সুজানগর থানা : সুজানগর, নিয়োলীল বনগ্রাম, বালিয়া ডাঙ্গি, সাতবাড়িয়া, সুজানগর থানা। তখন ভাংগুড়া থানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভাংগুড়া ছিল ফরিদপুর থানার অন্তর্গত। পাবনা জেলায়

পাক-বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার স্থানসমূহ

পাবনা সদর : বিসিক শিল্পনগরী, নূরপুর ডাকবাংলো, ওয়াপদা কলোনী, এডওয়ার্ড কলেজ, নাজিরপুর, বাঙ্গাবাড়িয়া, শ্রীকৃষ্ণপুর, সমশপুর, মনোহরপুর, মাধপুর, টিকোরী।

ঈশ্বরদী থানা : ঈশ্বরদী শহর, পাকশী, পাকুড়িয়া, দাশুড়িয়া, দাদাপুর, বাঁশের বাদা, মীরকামাড়ি, মুলাডুলি ও বিমানবন্দনর এলাকা।

আটঘরিয়া : গড়োড়ী, লক্ষীপুর।

চাটমোহর থানা : চাটমোহর বাজার, ফৈলজানা। ফরিদপুর থানা : ডেমরা ও হাদল।

সাঁথিয়া থানা : ধুলাউড়ী ও শহীদনগর ডাব বাগান।

বেড়া থানা : বেড়া সদর ও নগর বাড়ী ঘাট।

সুজানগর থানা : সাতবাড়িয়া, সুজানগর প্রভৃতি এলাকা।

বিবিসি বাজার

মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে গড়ে ওঠা বিবিসি বাজার। ঈশ্বরদী থানার রূপপুর এলাকার একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থান। নিকটেই হার্ডিঞ্জ ব্রীজ এবং পাকশী পেপার মিল। দুটি স্থানই পাক-বাহিনীর বিশাল বহরে সদা সজ্জিত। রূপপুরের অধিবাসীরা ঐ জঙ্গলটিকে একটি স্থান তৈরি করে নেয় Ñ যার চারদিকে বৃক্ষকুজ্ঞ। এলানেই সন্ধ্যা থেকে রেডিও নিয়ে নিয়ে মানুষ গোপনে জড়ো হতো শুনতো বিবিসির খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর আকাশবাণীর খবর। চুপে চুপে এই খবর শুনার সুবাদে কাশেম মোল্লা ওখনে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দেয়। মুক্তিযুদ্ধের দৃঢ় সমর্থক দরিদ্র সন্তান কাশেম মোল্লা। নয় মাস ধরে চলে এই খবর শোনার পালা। আস্তে আস্তে বিজয়ের পরে এখানে গড়ে উঠে ছোট্ট বাজার গ্রামবাসীর নাম দেয় বিবিসি বাজার। ধীরে ধীরে বাজারটি আজ এক বৃহৎ বাজারে পরিণত হয়েছে।

বিবিসি কর্তৃপক্ষ লন্ডনে এই খবর জানতে পেরে বছর চারেক আগে বিবিসি’র ঢাকা কেন্দ্রকে ওখানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বললে হাজার দর্শক শ্রোত-মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন হয়। বিবিসি’র ঢাকা কেন্দ্রের তৎকালীন প্রধান এবং খ্যাতনামা সাংবাদিক আতাউল সামাদসহ এক শক্তিশালী টিম বিবিসি বাজারে এসে এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। এ অনুষ্ঠানটি পরিবর্তে বিবিসি লন্ডন থেকে প্রচার করে এক বিশেষ প্রোগ্রামে। বিবিসি বাজার তাই ইতিহাসের তাৎপর্যময় স্থানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কাশেম মোল্লার দোকানটি আর নেই। কাশেম মোল্লা এখন দোকান দিয়েছেন পাকশীতে।

শহীদনগর বাজার

সাঁথিয়া থানার পাইকরহাটি গ্রাম ১৯ এপ্রিল ডাববাগান যুদ্ধের পর শহীদনগর নামে নামান্তরিত হয়েছে। আর সেখানে গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে একটি বাজার নাম, শহীদনগর বাজার। আজ এ বাজারটি শুধু এক বৃহৎ বাজারেই পরিণত হয় নি, তার চারপাশে অসংখ্য শহীদের কবর থাকায় এবং ভয়াবহ যুদ্ধ ডাবনাগানে অনুষ্ঠিত হওয়ায় তা গৌরবজনক স্মৃতির স্বাক্ষর হিসেবে বিরাজ করছে।

মুক্তিযুদ্ধে পাবনার মহিলাদের ভূমিকা

পাবনার মেয়ে শিরীন বানু মিতিল। বাবা এককালের বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশন নেতা কেএম শাজাহান। মা খ্যাতনাম্নী সেলিনা বানু (যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত এমএলএ) সাবেক পুর্ব পাকস্তিান আওয়ামীলীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সহ সভানেত্রী এবং এক পর্যায়ে পাবনা জেলা ন্যাপের সভানেত্রী। এঁদের কন্যা শিরীন বানু মিতিল পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র তখন। পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী। অমন গর্বিত মা বাবার এই সন্তানটি ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী থাকাকালে এবং তার আগে থেকেই এখানকার ছাত্র আন্দোলনে এক বিশিষ্ট ভূমিকা রাখছিলো। এসে পড়ে ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান।

পাবনা টাউন হলের ময়দানে অন্যান্য ছাত্র নেতাদের মত নিয়মিতই শুনা যেত মিতিলের কণ্ঠস্বর। আবেগ উদ্দীপনায় কাঁপিয়ে তুলতো পাবনার ছাত্র-যুব সমাজকে। এসে গেলো মুক্তিযুদ্ধ। শিরীন বানু শহরের যুদ্ধে যোদ্ধাবেশে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েদেরকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নিলো। ২৯ মার্চে স্বাধীন হলো পাবনা শহর। মিতিল মুক্তিযুদ্ধের কাজেও আরও বেশী করে সম্পৃক্ত হলো। ১০ ই এপ্রিল দ্বিতীয় দফা পাবনা পতনের পর সেও চলে যায় পশ্চিম বাংলায় তদানীন্তন ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশার সাথে। সেখানে গিয়েও বসে থাকেনি মিতিল। আওয়ামীলীগ নেত্রী বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে গোবরা ক্যাম্পে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মেয়েদের সাথে মিলিতও অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষন নেয় এবং নির্দেশমত মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে।

২৯শে মার্চে পাবনায় প্রথম দফা বিজয়ের পর কোলকাতা থেকে বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা ভারতীয় সাংবাদিক পাবনা এসেছিলো। তাঁরা পাবনার প্রথম দফা বিজয় এবং যুদ্ধ সমূহের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপিয়েছিলেন কোলকাতার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায়।Statesman পত্রিকায় বিশেষ সংবাদদাতা মানস ঘোষ বিশেষ সাক্ষাৎকার নেন শিরীন বানু মিতিলের। এই সাক্ষাৎকারের বিবরণ ওStatesman এ গুরুত্বসহকারে ছবিসহ ছাপা হয় এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে। সেলিনা বানুও মুক্তিযুদ্ধের নানাকাজে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা ন্যাপনেত্রী এবং বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সেলিনা বানু পরলোকগমন করেছেন বেশ কয়েক বছর আগেই।

মিতিলের বাবাও আজ আর বেঁচে নেই বেঁচে নেই সেই প্রাণবন্ত শাজাহান ভাই। মিতিল পরে মস্কো যায় উচ্চ শিক্ষার জন্যে। সে তার স্বামী সহ এখন ঢাকায়। আমরা পাবনাবাসীরা সেলিনা বানুকে, শিরীন বানু মিলিতে ভুলেই গেছি। মিতিল কিন্তু পাবনাকে ভুলে নি। অভিমান ক্ষুব্ধ, তাই তেমন একটা পাবনাতে আসে না। যদিও সে দেশ জুড়ে সমাজকর্মী নারী সংগঠক হিসেবে অক্লান্ত কাজ করে চলেছে।

দিনমজুর ভানু নেছা : একজন মুক্তিযোদ্ধা

সাঁথিয়া আমার থানা। পৈতৃক নিবাস ছিলো ঐ থানার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। সাঁথিয়ার সাংবাদিক অনুজ প্রতিম হাবিবুর রহমান স্বপনকে ধন্যবাদ। একটি গৌরবের তথ্য আবিষ্কারের জন্যে। তথ্যাটি মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখার গৌরবদীপ্ত দিনমজুর ভানু নেছা সংক্রান্ত। ৭ ডিসেম্বর সাঁথিয়া মুক্ত হয়েছিলো। ৮ ডিসেম্বর পুনরায় পাক-বাহিনী সাঁথিয়া দখল করতে যায়। সাঁথিয়া নন্দনপুরের মাঝে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা শত শত মুক্তিযোদ্ধা ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রু সেনাদের উপর। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধের পর পাক-বাহিনী পশ্চাদ অনুসরণ করে চলে আসতে বাধ্য হয়। অনেক হতাহতও হয়। তারা পালিয়ে আসে যুদ্ধ স্থলে একটি জীপ এবং একটি মিলিটারী ট্রাক রেখে। পরে আবারও আক্রমণ হতে পারে আশংকায় সাঁথিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা জোড়গাছা ব্রীজটি ভেঙ্গে ফেলে।

পরদিন ৯ ডিসেম্বর ঐ এলাকায় পুনরায় ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর গোলাগুলি ফুরিয়ে গেলে তারা গোপনে নিকটস্থ এলাকায় লুকিয়ে থাকা দিনমজুর ভানু নেছাকে লোকজন পাঠিয়ে সাঁথিয়া থানা থেকে গুলি এনে দিতে বলে। ভানু নেছা অনেককে অনুরোধ করে। কেউ সাহস পায় না। অবশেষে ভানু নেছা নিজেই ছুটে যায়। আওয়ামীলীগ নেতা আবদুল ওয়াহব মিয়া ওরফে জিতু মিঞা এবং পুলিশের কনস্টেবল হযরতের কাছ থেকে এক বস্তা ভর্তি গুলি এনে ট্রেঞ্চে ট্রেঞ্চে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাকেরকে সরবরাহ করে। শুরু হয়। পুনরায় যুদ্ধ। চলে সারাদিন। হেরে যায় পাক-বাহিনী। বিজয় ঘটে চূড়ান্তভাবে। এরপর আর পাক-সেনারা সাঁথিয়া সে সাহস করেনি। ভানু নেছা, বয়স ৭০। স্বামী আব্দুল প্রামাণিক মারা গেছে। দুই ছেলে এক মেয়ে। সবাই বিবাহিত। বাড়ী তেঁতুলিয়া গ্রামে। ভানুনেছা নিজেও দিনমজুর। মুক্তিযুদ্ধে এভাবে অংশ নিতে পেরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াতে সে আনন্দিন আজও। আমার মনের কোনে প্রশ্ন : ‘ভানু নেছাদের জন্য আমরা কি করলাম এতদিন এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে?’

শহীদদের স্মৃতিতে একটি মাত্র স্মৃতিসৌধ পাবনার পুলিশ মাঠে

খুঁজছিলাম আমরা কি কোথাও শহীদদের অর্থাৎ ৭১-এর শহীদদের বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কোন মিনার বা স্মৃতিসৌধ কোথাও কিছু করেছি? ২৫ বছর পর এই রজত জয়ন্তীতে এ প্রশ্নটি স্বাভাবিক। এই নিবন্ধ রচনার দায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পিত হওয়ার পর সাংবাদিক এবাদত আলীকে সঙ্গে নিয়ে আমি পাবনা জেলার ৪-৫টি থানা ঘুরেছি। না, কোথাও কিছু নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের অল্প কয়েকটি কবর আছে পাকা। আর সবই কাঁচা অর্থাৎ নিশ্চিহ্ন। কত বধ্যভূমি, কতো গণকবর। সেগুলো চিহ্নিত করাই আজ মুশকিল। তবুও ধন্যবাদের পাত্র পাবনার পুলিশ প্রশাসন।

পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হয়েছেন ২৯ জন পুলিশ ও পুলিশ কর্মকর্তা। এই ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা পুলিশের স্মরণে পাবনা পুলিশ মাঠে পাবনা জেলা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার একমাত্র নিদর্শন হিসেবে তাঁরা একটি মিনার নির্মাণ করেছেন তার চারদিককার গাত্রে শহীদদের নাম স্পষ্টাক্ষরে লিখে রেখেছেন। স্পষ্ট করেই উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন পাবনার পুলিশকে পাবনার মুক্তিকামী জনগণের পক্ষ থেকে আবারও অভিনন্দন। তাঁরা নানা জেলা নানা অঞ্চল থেকে এখানে এসে পাবনার মুক্তিযুদ্ধে নির্বিবাদে মুক্তিকামী জনতার সাথে মিলে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বুকের রক্ত ঢেলেছেন আত্মাহুতি দিয়েছেন। আবার তেমনই দেশ মুক্ত হওয়ার পর তাঁরা তাদের সহকর্মী শহীদ পুলিশদের স্মৃতিকে সবার মনে অম্লান রাখার লক্ষ্যে একটি বিরাট মিনারও নির্মাণ করেছেন।

এই মিনার আমাদের জেলায় সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং সকল শহীদের স্মৃতি আমাদের প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিলে, তাঁদের আবদ্ধ ও আকাঙ্খিত স্বাধীন এই মাতৃভূমিকে সুখী সুন্দর দেশে পরিণত করার নব নব অঙ্গীকার আমাদের স্মৃতিতে আনতে পারলে ও শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জাগরুক করতে পারলে, তা নির্মাণ এবং শহীদদের আত্মদানের উদ্দেশ্য সফল হবে। আর সফল হবে যদি আমরা অনুপ্রাণিত হয়ে সকল থানায় একটি করে শহীদ স্মৃতিসৌধ এবং পাবনা জেলা শহরে একটি বিশাল শহীদ স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠা করি আগামী এক বছরের মধ্যে, ৯৭-এর ১৬ই ডিসেম্বরের আগেই।

দু’জন শ্রদ্ধেয় শহীদ শিক্ষক

মুক্তিযুদ্ধে পাবনা জেলার বহু শিক্ষক বহু ছাত্র শহীদ হয়েছেন কিন্তু একান্ত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাঁদের নাম সংগ্রহ করা গেল না প্রধানত সময়ের স্বল্পতার কারণে। তবে সংগ্রহ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তবু যে দু-জন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক পাবনা শহরে শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁদের নাম উল্লেখ করছি। একজন হলেন পাবনা জেলা স্কুলের হেড মওলানা এবং স্কাউট শিক্ষক মওলানা কসিমুদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন পাবনাবাসী সকলেরই আপনজন Ñ সকলেরই শ্রদ্ধাভাজন একজন নিষ্ঠাবান সমাজসেবক। সমাজের স্বার্থে যে-কোনো কাজে যে- কোনো সময় তাঁকে পাওয়া যেত।

১৯৭১ এর ১০ জুন তাঁকে পাবনা ময়লাগাড়ির নিকটস্থ চেক পোস্টে বাস থেকে নামিয়ে পরে সাঁথিয়া থানার মাধপুরে নিয়ে বাঁশঝাড়ের মধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শহীদ মওলানা কসিমুদ্দিনের বাঁধানো কবর আছে সাঁথিয়া থানার মাধপুরের জঙ্গলে। পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের ইংরেজি শিক্ষক শিবাজী বাবুকেও পাবনার শালগাড়িয়ার এক বাসা থেকে রাজাকারেরা ধরে নিয়ে যায় এবং পরে অমানুষিক অত্যাচার করে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়। তাঁর মৃত দেহটি শ্মশানে দাহ পর্যন্ত করা যায় নি। কেবল শিবাজী মাস্টার নয়, আরও অসংখ্য হিন্দুর মৃতদেহেরও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। বহু মুসলিম মৃতদেহ তেমনি বিনা জানাজায় শুধু পুঁতে ফেলতে বা পানিতে ভাসিয়ে দিতে হয়েছে। শিবাজীবাবুর শহীদ হওয়াতে ক্ষতি হয়েছে পাবনার ছাত্রদের। অমন একজন ইংরেজী শিক্ষক আর খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও। আরও উল্লেখযোগ্য, এরা দুজনেই কিন্তু রাজনীতি করতেন না। রাজনীতির কাছেও ঘেঁষতেন না। তবুও পাক-পশুদের হাত থেকে তাঁরা নিস্কৃতি পাননি।

যাঁদের অবদান স্মরণে রাখতে হবে

পাবনা জেলার যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে প্রশিক্ষণ নিতে ও যুদ্ধ করতে নেতৃত্বের ভূমিকায় এগিয়ে এসেছিলেন আজও তাঁদের নাম কোথাও সংগৃহীত নেই। তবু স্মৃতি থেকে যতটা সম্ভব তাঁদের নাম এখানে উল্লেখ করছি। যাঁদের নাম বাদ পড়লো তাঁদের প্রতিও রইল শ্রদ্ধা। স্মৃতিনির্ভর বলেই ভুল-ত্র“টি থাকবে, তবে তা আদৌ ইচ্ছাকৃত নয়।

গণ-পরিষদ সদস্য আমজাদ হোসেন শহীদ এডভোকেট আমিনুদ্দিন এপিএ, জনাব আহমেদ তফিজ উদ্দিন এমপিএ, জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ এমপিএ, আব্দুর রব বগা মিয়া, ওয়াজি উদ্দিন খান, আব্দুস সাত্তার লালু, আমিনুল ইসলাম বাদশা, রফিকুল ইসলাম বকুল, মোঃ ইকবাল হোসেন, বেবী ইসলাম, এডভোকেট আমজাদ হোসেন, এডভোকেট গোলাম হাসনায়েন এমপিএ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমপিএ, অধ্যক্ষ আব্দুল গণি, এডভোকেট শামসুল হক টুকু, এডভোকেট রণেশ মৈত্র, জহুরুল ইসলাম বিশু, সাড়া মাড়োয়ারী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইসহাক আলী, প্রসাদ রায়, নুরুল ইসলাম ফকির, শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, জসিম উদ্দিন মণ্ডল, সাহাপুরের লুৎফর হোসেন, আবদুল হালিম চৌধুরী, মাহবুব আহমেদ খান, তোজাম আলী, আজিম উদ্দিন, নায়েব আলী বিশ্বাস, ডা. আব্দুর রশিদ, মাহমুদার রহমান, শামসুজ্জামান সেলিম শহীদুজ্জামান নাসিম, রেজাউল আলম মিন্টু, এডভোকেট সদরুল হক মৃধা, সিরাজুল ইসলাম মন্টু, আবুল কাশেম বিশ্বাস, আকমল হোসেন, মোশারফ হোসেন, আমজাদ হোসেন মণ্ডল, আমজাদ হোসেন, রবিউল আরম মাস্টার, শামসুদ্দিন আহমেদ, মজিবর রহমান বিশ্বাস, মাস্টার তোফাজ্জল হোসেন, আব্দুল গফুর, সিরাজ উদ্দিন, চাঁদ আলী, আজিমুদ্দিন, ইসমাইল হোসেন, মকবুল হোসেন সন্টু, মনু সরদার, গোলাম আলী কাদেরী, এডভোকেট ডা. পরিতোষ সাহা, গোলাম মাহমুদ, আব্দুর রাজ্জাক রিদ্দিক (শহীদ), ফজলুল হক মন্টু, শাজাহান রেজা, চঞ্চল, উজ্জ্বল, আব্দুর রাজ্জাক মুকুল, ফখরুল ইসলাম, আব্দুল লতিফ, শামসুল ইসলাম, জাহিদ হাসান জিন্দান, আওরংগজেব বাবলু, আব্দুল বাতেন সাঁথিয়ার নিজাম উদ্দিন, আনসার কমান্ডার, আবেদ আলী, গোলজার হোসেন, ঈশ্বরদীর খায়রুল ইসলাম, চাটমোহরের ময়েজ উদ্দিন পাবনার মোঃ ইসমত, মোঃ ইলিয়াস, আহমেদ করিম, ঈশ্বরদীর মোখতার হোসেন ভাল্টু, ফজলুর রহমান ফাল্টু, সুজানগরের সুলতান মাহমুদ, আবদুস সামাদ, আব্দুল হাই, তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, আবুল কাশেম, চাটমোহরের মোজাহারুল হক, ময়েজ উদ্দিন, উজ্জল, চঞ্চল প্রমুখ।

পুনর্বার উল্লেখ করি, যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম তাঁদের ছাড়াও আরও অসংখ্য নাম বাদ রইলো না জানায় অথবা স্মরণে না থাকায়। কিন্তু ইচ্ছাকৃত আদৌ নয়। তাই আনিচ্ছাকৃত এই ত্র“টি কেউ কোনো ভ্রান্ত অর্থে গ্রহণ না করলেই খুশি হবো। এবারের এই লেখাটি আগামী দিনের একটি বিরাট লেখার সূচনা হিসেবে গ্রহণ করলেই বাধিত হব। এবারে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের পালা। তথ্য সংগ্রহ ছবি সংগ্রহ ইত্যাদি নানাবিধ কাজে যাঁদের অকৃত্রিম সহযোগিতা পেয়েছি তাঁরা হলেন সাংবাদিক ও লেখক এবাদত আলী, অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, সাংবাদিক দীপক দত্ত (বেড়া), সাংবাদিক হাবিবুর রহমান স্বপন (সাঁথিয়া), ফরিদপুরের সাংবাদিক আবু বাসেদ, সাহারুল হক সাচ্চু, চাটমোহরের ময়েজ উদ্দিন, সাঁথিয়ার নিজাম উদ্দিন, কাশীনাথপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুশীল কুমার দাস, সাহাপুর ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান এবং কয়েকজন উৎসাহী সরকারী কর্মকর্তাও। এঁদের কাছে এই লেখাটির জন্য আমি ঋণী। ভবিষ্যতেও এঁদের সহযোগিতা পাবার আশা করি।

পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন, বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার নর-নারী শিশুকে নিজেদের জীবন বাজি রেখে যাঁরা আশ্রয় দিয়েছেন, যাঁরা শত্রু-শিবিরের খবরাদি ও তাদের গতিবিধির তথ্য সরবরাহ করেছেন এবং যাঁরা নানাস্থানে অপারেশনের খবর বহন করে ভারতে পৌছেছেন তাদের নামের তালিকা যেমন দীর্ঘ তেমনই অজানা। অথচ তাঁদের সহেযাগিতা ব্যতিরেকে আদৌ এ লড়াই সম্ভব হতো না সফলও হতো না। আগামীতে তাঁদেরও তালিকা সংগ্রহের ইচ্ছে রইলো। জেলাবাসীর পক্ষ থেকে আজ তাদেরকে এই লেখার মাধ্যমে রজত জয়ন্তীতে রক্তিম শুভেচ্ছা জানাই।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।